—উহুঁ, আমি যাই।
–বাড়িতে কে আছে তোর?
হাসু কোন উত্তর দিতে পারে না।
রশীদ-গৃহিণী একটা টাকা এনে হাসুর হাতে দেন। অনেক দ্বিধার সঙ্গে টাকাটা নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। রশীদ-গৃহিণী চেয়ে থাকেন ছেলেটার মুখের দিকে। তার মেজ ছেলের কিছুটা ছাট আসে ওর মুখে। তখন কলকাতায় দাঙ্গা। ছেলেটি একদিন তার সাথে রাগ করে সামনের ভাত ফেলে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। আর ফিরল না…
হাসু সিঁড়ির গোড়ায় নেমে একবার ফিরে তাকায়। রশীদ—গৃহিণীর চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
ঢং-ঢং, ঢং-ঢং–এগারোটার ঘণ্টা। পথে আসতে আসতে হাসু শোনে।
যেখানটায় রোজ কোষা রাখা হয়, সেখানে এসে দেখে, মা বসে নেই। কোষাটাও নেই।
মা তার উপর রাগ করেই চলে গেছে, সে বুঝতে পারে।
হাসু অন্ধকারের মধ্যে হাত কচলাতে শুরু করে। রাতটা কোথায় কাটান যায়? দোস্তের বাড়ী অনেক দূরে, তাও আবার নদীর ওপারে। এত রাতে খেয়া পাওয়া যাবে না।
নিরুপায় হয়ে হাসু কয়েক পা হেঁটে ছোট রেলস্টেশনটার চালা ঘরে গিয়ে ওঠে। রাতটা এখানে কাটান যাবে। কিন্তু ক্ষুধা পেয়েছে খুব। এত রাত্রে খাবার কিছু পাবার যো নেই। দু’মাইল হেঁটে চাষাড়া পর্যন্ত গেলে কিছু কিনে খাওয়া যেত। কিন্তু তার এক পা হাটতেও আর ভালো লাগে না।
হাসু বসে পড়ে। যখন বসতেও খারাপ লাগে তখন এক সময়ে গামছা বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে সে বাড়ীর কথা মনে করে।
মায়মুনকে খাইয়ে মা নিজে না খেয়ে শুয়ে শুয়ে তার কথাই ভাবছে। তাকে না খাইয়ে সে কোনদিন একমুঠো ভাত মুখে দেয়নি, আজও দিতে পারে না। মায়ের কথা ভাবতেই আরো একজনের কথা তার মনে পড়ে। মায়ের মুখের পাশে, মায়ের মর্যাদা নিয়ে যে একখানা মুখ। তার চোখের সামনে ভাসে, সে মুখখানা রশীদ-গৃহিণীর।
রাত বারোটার পরে আর কোনো ট্রেন নেই। ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর স্টেশনে লোক দেখা যায় না।
সব নিস্তর। মাঝে মাঝে দুর থেকে সমবেত চিৎকার ভেসে আসে—আল্লা আল্লা বল ভাইরে মোমিন
কোথাও কলেরা-বসন্ত লেগেছে। তার জন্যেই খোদাই শিরণী হচ্ছে, হাসু বুঝতে পারে। চিৎকার শুনে তার শরীরের লোম কাটা দিয়ে ওঠে।
জয়গুন সন্ধ্যার পরেই এসেছিল। পথ চেয়ে চেয়ে তার মেজাজ গরম হয়ে ওঠে ছেলের ওপর। ন’টার সময় সে নিজেই কোষাটা বেয়ে বাড়ী চলে যায়। কিন্তু বাড়ীতে পা দিয়েই তার ধারণা পাল্টে যায়। হাসু তার সে ছেলে নয়! তার কাছে না বলে কোথাও সে যায় না। দোস্তের বাড়ী গেলে তার কাছে বলেই যেত।
জয়গুনের মাথার মধ্যে নানা রকমের দুশ্চিন্তা তাল পাকাতে আরম্ভ করে।
কাল শরীর গরম ছিল, আজ হয়তো জ্বর হয়ে কোন গাছতলায় পড়ে আছে। পানি সাঁতরে স্টীমারে উঠতে হয়। তবে কি স্রোতে ভেসে গেল? নদীতে কুমীর থাকে। কুমীরেও টেনে নিয়ে যেতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।
জয়গুন কুপি জ্বালে। মায়মুন ভূতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে।
জয়গুন কাঁথা সরিয়ে দেখে মায়মুন ঘুমিয়ে আছে। সে আর মায়মুনকে ডাক দেয় না। এখন ওকে তুললেই ভাতের জন্যে কাঁদবে। ঘুমিয়ে থাক, সেই ভালো। আজ জয়গুনের চুলো ধরাবার শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। খাঁচার নিচে বড় ইসি দুটোও দেখা যায় না। বর্ষার দিনে পাতিশিয়ালে নেওয়ার কথাও নয়। বোধ হয়, কেউ ধরে রেখেছে কিম্বা জবাই করে খেয়েছে।
জয়গুনের কাছে সমস্ত দুনিয়াটা এলোমেলো মনে হয়।
মায়মুনের পাশ দিয়ে সে শুয়ে পড়ে। এবার দুশ্চিন্তার দুর্বার স্রোত মাথায় ঢুকবার সুযোগ। পায়। জয়গুন ভাবে—তবে কি গাড়ী চাপা পড়ল? হয়তো কিছু চুরি করায় পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
এমনি আরো অনেক চিন্তা তার মনে আসে। একটা কিছুক্ষণ ভাবার পর সেটাকে সরিয়ে আর একটা নতুন দুশ্চিন্তা এসে আঁকিয়ে বসে মনে।
১১. মোরগের ডাক শুনে
কুউ—কুরু—ত—কু—উ–
মোরগের ডাক শুনে জয়গুন আর বিছানায় পড়ে থাকে না। তাড়াতাড়ি উঠে আগে ফজরের নামাজ পড়ে, তারপর মায়মুনকে ডাকে—গা তোল, মায়মুন। আত-মোখ ধুইয়া জলদি কইর্যা চুলা জ্বাল।
—মিয়াভাই আহে নাই, মা?
–উহুঁ।
জয়গুন আর কিছু না বলে কোষায় ওঠে। অনভ্যস্ত হাতে লগি বেয়ে সে রেল-রাস্তার পাশে আসে।
বিলের শেষ প্রান্তে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য উকি দিচ্ছে।
আবছা আলোয় দুর থেকে জয়গান দেখতে পায় স্টেশনের চালাঘরে হাসু চোলি হয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে হাত রাখতেই হাসু ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মা-কে সামনে পেয়ে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।
জয়গুন দেখে, হাসুর সারা মুখে মশার কামড়ের দাগ। চোখ দুটোও লাল। মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছায়া! সে বলে—ডরে ধরছিল, অ্যাঁ?
হাসু মাথা নেড়ে স্বীকার করে।
—ডরে ধরছিল! কিছু দেখছিলি নি?
—হ। কি দুড়দুইডা আন্ধার গো মা! একটা মাইনষের আলয় নাই। এইহানে ওইহানে। এটটু পরে পরে কিয়ের জানি খচখচানি। বিলের মধ্যে কিয়ের যেন বাত্তি—এই জ্বলে, এই আবার নিবে। আবার কিয়ের বিলাপ হুনলাম। মাইনষের মন কান্দে। ডরে আমি এক্কেরে মাডির লগে মিশ্যা আছিলাম। এই আলোগুলা আলৈয়া, না মা?
—যাউক, অই হগল কওয়ন ভাল না। তোর অহনও ডর করে অ্যাঁ?
হাসু হাঁ-সুচক মাথা নাড়ে।
—না—না, ওগুলা কিচ্ছু না।
পথে আসতে আসতে হাসু কালকের সমস্ত ঘটনা মা-র কাছে বলে। রশীদ—গৃহিণীর দেয়া টাকাটা মা-র হাতে তুলে দেয়।
বাড়ীর ঘাটে কোষ ভিড়ার শব্দ পেয়ে মায়মুন দৌড়ে আসে। শফি, শফির মা-ও আসে।
শফির মা জিজ্ঞেস করে—কোনখানে পাইলি গো?