হাসুকে বলে যান—তুই বোস এখানে বাইরে।
হাসু মোট নামিয়ে বসে থাকে। ক্যাফের ঘড়িতে ন’টা বাজে। কিন্তু সাহেবের বের হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বসে থাকতে থাকতে হাসুর বিরক্তি ধরে যায়। একবার মনে হয়—স্যুটকেসটা নিয়ে ভেগে গেলে কেমন হয়? কিন্তু তারপরই সে নিজেকে শুধরে নেয়।
রশীদ সাহেব বাইরে এসে চলতে আরম্ভ করেন। হাসু অনুসরণ করে। ওভারব্রিজের কাছে আসতে হাসুর পা আর চলতে চায় না। বোঝা মাথায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা খুবই কষ্টকর। ক্ষুধায় হাসুর শরীর দুর্বল। তার ওপর এমন ভারী বোঝা।
হাসু বলে—একটু ধরেন, জিরাইয়া লই।
—চলে আয়। এতটুকুর জন্যে জিরিয়ে কাজ নেই, বাবা। বেশী দূরে নয়, কাছেই আমার বাড়ী-রশীদ সাহেবের মুখ দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বের হয় কথাগুলো।
রশীদ সাহেব না থেমে ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে যান। হাসু এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি করে উঠতে থাকে। তার পা কাঁপে। ঘাড়টা চাপ খেয়ে মচকে যাবার মত হয়।
রশীদ সাহেবের আগমনে তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। তাদের আনন্দ কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে বাড়ীখানা। ছোট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য দুটির হাত ধরে তিনি অন্দরে ঢোকেন। একটি চাকরাণী এসে হাসুর মাথার মোট নামিয়ে নেয়। হাসু দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে!
রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। কিন্তু তাকে পয়সা দেয়ার কথা বোধ হয় মনে নেই কারো।
অনেকক্ষণ পরে হাসু সাহস করে বলে—আমারে বিদায় করেন সা’ব।
রশীদ সাহেবের ছেলে মজিদ হাসুকে ডেকে নিয়ে যায় ভেতরে।
রশীদ সাহেব তখন বিরাট বপু বিস্তার করে শুয়েছেন। মজিদকে বলেন, পকেট থেকে তিন আনা বের করে দিতে।
হাসু আপত্তি করে—তিন আনা কম অইয়া যায় সা’ব।
—কম! বলিস কী, অ্যাঁ!
—জাহাজের তন রিকসায় উড়াইয়া দিলেই ত চাইর আনা দেয়। আর এইডা ত অনেকখানি দূর। আবার দেরী অইল কত!
—নে তোল পয়সা।
—না সাব, পাঁচ আনার কম নিমু না।
মজিদ বলে—বাপরে! এখান থেকে এখানে পাঁচ আনা! এক মিনিটের পথ না, এত পেলে ত রাজা হয়ে যাবি।
হাসু নাছোড়বান্দা।
রশীদ সাহেব এবার ডাকেন—এই ছোঁড়া, আয় পাঁচ আনাই দেব। তবে হাত-পাগুলো টিপে দে ত আমার। ভালো করে তেল মালিশ করে দে।
–না সাব আমি পারতাম না। আমার দেরী অইয়া গেছে।
–অ্যাঁ, পারবিনে? গর্জে ওঠেন রশীদ সাহেব। বিছানার ওপর মেদবহুল শরীরখানা দুলিয়ে তিনি বলেন—এমনি এমনি তোমাকে পাঁচ পাঁচ গণ্ডার পয়সা দেব? আমি কন্ট্রাক্টর। কড়ায় গণ্ডায় কাজ আদায় করে পয়সা দিই। হ্যাঁ—হ্যাঁ—হ্যাঁ।
ইসু রশীদ সাহেবের পায়ের কাছে বসে তার পায়ে তেল মালিশ করতে শুরু করে।
তেল-মালিশ নেওয়া রশীদ সাহেবের অনেক দিনের অভ্যাস। শোবার আগে রোজ হাত পা টিপিয়ে না নিলে তাঁর ঘুম হয় না। কালকাতা থাকতে এ ব্যাপারে সুবিধে ছিল অনেক। চার আনা দিলে অব ঘটা বেশ হাত-পা বানিয়ে নেয়া যেত। রাত ন’টার সময় বাসার দরজায় এসে রোজ চীৎকার করে উঠত-মালিশ, তেল মালিশ। বাড়ীতে সে সুবিধে না। থাকায় কি-চাকর দিয়েই চলে সে কাজ।
দশটা বাজে। পা টিপতে টিপতে হাস অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মা-র কথা মনে পড়ে। রেল-রাস্তার ধারে মা তার পথ চেয়ে আছে। এতক্ষণ এ লোকটার ব্যবহারে তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা তার মনেই ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষুধায় তার হাত-ল অবশ হয়ে আসে। পেটটা ব্যথা করতে আরম্ভ করে।
মা-র কথা ভাবতে ভাবতে পাটেপা এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।
রশীদ সাহেব বলেন—কিরে, থামলি কেন? কি টেপা টিপিস? গায়ে কী জোর নেই বাপ? খোট্টারা এ কাজে ভারী ওস্তাদ। কলকাতায় ভুলুয়া বলে একটা খোট্টা রোজ আসত আমার বাসায়। চমৎকার টিপতে পারত সে। আর তুই টিপিস, আমার গায়েই লাগে না। মনে হয় পিপড়ে হাঁটছে শরীর বেয়ে।
কতক্ষণ পরে আবার বলে—এবার হাতের দিকে আয়।
রশীদ-গৃহিণী চা হাতে থমকে দাঁড়ান। তিনি রুক্ষস্বরে বলেন—ওঃ সব কাজেই ঠিকাদারী! আচ্ছা কি আক্কেল তোমার! কার ছেলেকে তুমি এ রকম করে আটকে রেখেছো?
রশীদ সাহেব বলেন—আমার নাম রশীদ কন্ট্রাক্টর। কড়াক্ৰান্তি পর্যন্ত আদায় করা চাই আমার। এই ছোড়া, এবার হাতগুলো টিপে তারপর যাবি।
চায়ের কাপটা রেখে রশীদ-গহিণী বলেন—থাক আর হাত টেপাতে হবে না। কেন তুমি পরের ছেলেকে কষ্ট দেবে?
হাসুর দিকে ফিরে আবার বলেন—আয় ত বাবা। আহা! কার ছেলে গো! তোর কি মা-বাপ নেই?
সহানুভূতির কথায় এবার হাসুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে।
রশীদ—গৃহিণী হাসুর মুখ দেখে বিস্মিত হন। নিজের আঁচলে চোখ মুছিয়ে তিনি বলেন—দুপুরে খাসনি কিছু? আহা! মুখখানা শুকিয়ে কেমন হয়েছে।
মায়ের মন ক্ষুধাতুর সন্তানের জন্যে ব্যথিত হয়। তার চোখও শুকনো থাকে না।
তিনি হাসুকে খাবার ঘরে নিয়ে যান। একটা থালায় ভাত ও দুটো পেয়ালায় তরকারী দিয়ে হাসুর সামনে দেন।
ভাতের দিকে চেয়ে হাসর চোখে ভাসে—মা তার আশায় সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। মায়মুন বাড়ীতে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। বাড়ী গেলে রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে সকলের। হাসুর চোখ দিয়ে এবার বেশী করে পানি ঝরতে থাকে।
রশীদ-গৃহিণী বলে চলেন—খেয়ে নে বাছা আমার। কাঁদিস নে আর।
হাসু জোর করে এক মুঠো ভাত মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ক্ষুধার তাগিদ চাপা পড়ে গেছে।
সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। বলে—আমি যাই।
—কিছুই তো খেলিনে। শান্ত হয়ে খেয়ে এখানেই থেকে যা আজ।