ট্রেন থামতেই হাসু চটপট উঠে পড়ে পেছনের একটা গাড়ীতে। একটা মোট দু’আনায় ঠিক করে। যাদের মালপত্র কম তারা এ রকম ছোট কুলিই খোঁজে। এদের দু’আনা দিলেই খুশী হয়। বড় কুলিরা চার আনার কমে রাজী হয় না।
হাসু গাড়ী থেকে নেমে দেখ-না-দেখ সরে পড়ে।
বারোটার মেল ও একটার স্পেশাল জাহাজ ধরে হাসু রোদে এসে দাঁড়ায়। তার সমান আকারের আরো পাচ-ছ’টি কুলিও গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আসে। ওভারব্রিজের রেলিং-এ সকলে সারি সারি গামছা রোদে দেয়।
গামছা পরে সাঁতার দিয়ে স্টীমারে উঠতে হয় তাদের। নশ্বরী কুলি ছাড়া জেটির দরজা দিয়ে অন্য কুলিরা ঢুকবার সুযোগ পায় না। তারা সাঁতার দিয়েই অনেক সময় স্টীমারে ওঠে।
হাসু ও অন্যান্য খুদে কুলিরা বসে বসে গল্প করে। একজন একটা বিড়ি ধরায়, কয়েকজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে চেয়ে থাকে, কে কার আগে নিয়ে টানবে। একজন বলে—শীত লাগছেরে। দে দেহি বিড়িডা, একটা টান দিয়া লই।
আর একজন বলে-ওয়াক থু ওর মুখের বিড়ি টানিস না। ছি! ও মেথরের পোলা।
—মেথর বুঝি মানুষ না? রমজান বলে।—পয়সা পাইলে মেথর-গিরিও করতে পারি চাই পয়সা। রমজান হাতে তুড়ি দিয়ে দেখায়।
জনপ্রতি দুটো করে টান দেয়ার পর ফেলে দেয়া হয়েছিল বিড়িটা। যে ছেলেটা মেথর বলে থুক ফেলেছিল, সে এবার বিড়িটা তুলে টানতে আরম্ভ করে।
একটা ছেলে গলা ছেড়ে সিনেমার গানে টান দেয়–মালতী লতা দোলে—
রমজান হাসুকে ডাকে—ও দোস্ত খুব ভালা একটা সিনেমা আইছে। যাইবেন নি আইজ?
হাসু বলেনা দোস্ত মা রাগ করব।
—চলেন না আইজ। তিন আনার পয়সা মোডে। আমার গাঁটের পয়সায়ই না অয় দেখবেন।
–উহুঁ।
রমজান আর পীড়াপীড়ি করে না।
রমজান হাসুর বন্ধু ও খুদে কুলিদের সরদার। রমজানকে সবাই ভয় করে। তার কথামত সবাইকে চলতে হয়। তবে হাসুকে খুবই খাতির করে সে।
রমজান বলে—তরশুর তন তোরা আমার লগে এক জায়গায় কামে লাগবি।
হাসু জিজ্ঞাসা করে—কোনখানে দোস্ত?
—হোসেন দালালের নাম হোনছেন? নতুন ধনী হোসেন দালাল?
একজন বলে—হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনছি। পাডের দালালি কইর্যা বস্তাবস্তা ট্যাকা করছে ব্যাডা।
রমজান বলে–হ্যাঁ, হেই হোসেন দালাল! খানপুরে তেতলা দালান খিঁচব এইবার। হেই জায়গায় কাম আছে।
—ইট ভাঙ্গবি, ইট টানবি, পানি তুলবি। এক ট্যাকা কইর্যা রোজ।
সবাই রাজী হয়।
রমজান আবার বলে—আমারে মাথা পিছু সরদারি দিবি এক আনা কইর্যা। দ্যাখ, যদি মনে খাডে লাইগ্যা যা তোরা সবাই।
এখানে সারাদিনে দশ বারো আনার বেশী পাওয়া যায় না। কোনোদিন তার চেয়েও কম পাওয়া যায়। সুতরাং কেউ অমত করে না।
ছয়টার ট্রেন ধরে হাসু পয়সার হিসাব করে। মাত্র তেরো আনা হয়েছে। একটা টাকার কাজও হল না। কোমরে বাঁধা জালির মধ্যে পয়সাগুলো খুঁজে সে এক জায়গায় বসে। হাসুর সাথীরা সব চলে গেছে। রোজ এমন সময় সেও বাড়ীর দিকে পথ নেয়। কিন্তু আজ সাতটার স্টীমারটা দেখেই যাবে সে। মা হয়তো বসে থাকবে তার জন্যে। দেরী হলে রাগ করতে পারে। কিন্তু একটা টাকা পুরিয়ে নিলে রাগ না করে সে হয়তো খুশীই হবে।
ছড়ি হাতে এক ভদ্রলোক হাসুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাত থেকে সিগারেটের শেষাংশ ছুঁড়ে ফেলতেই হাসু মাটি থেকে তা কুড়িয়ে নিয়ে টানতে আরম্ভ করে। দোস্তের পাল্লায় পড়ে কয় দিন হয় সে বিড়ি টানতে শিখেছে। ঠাণ্ডার মধ্যে বিড়ি টানতে মন্দ লাগে না হাসুর।
সাড়ে সাতটার পরে স্টীমার আসতে দেখা যায়। হাসু তিন নম্বর জেটির দিকে দৌড়ায়। গেট বন্ধ হয়ে গেছে। হাসু ফিরে এসে গামছা পরে লুঙ্গিটা বেঁধে নেয় মাথায়।
স্টীমারটা ঘাটে ধরতেই সে তার দেয়। আজ একা একা তার ভয় করে। অন্য সময় ছয় সাত জন মিলে নদীর পানি তোলপাড় করতে করতে তারা জাহাজে ওঠে।
যে ফ্লাটের গায়ে স্টীমারটা ধরেছে তার একটা কাছি বেয়ে বেয়ে সে আগে ফ্লাটের ওপর ওঠে। লুঙ্গি পরে গামছার পানি নিঙরে সে শরীরটা মুছে নেয়। তারপর ফ্লাটের কিনারার সরু পথ ধরে ধরে স্টীমারে উঠবার সিঁড়িতে যায়। ভিড় গলিয়ে এবং নম্বরী কুলিদের চোখ এড়িয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে।
এক মোটা ভদ্রলোক কুলির সাথে দরাদরি করছেন—চার আনায় যাবে? অল্প মাল আমার, সব শুদ্ধ দশ সেরও হবে না।
—ছয় আনা রেট আছে সাব। কমে অইব না।
—না, যাও। চার আনার বেশী দেব না আমি। কুলিটা চলে যেতেই হাসু এগোয়—কুলি লাগব নি, বাবু।
লাগবে ত। কত নিবি? —আপনে খুশী অইয়া যা দ্যান।
—তবে মাথায় নে। চল জলদি।
মোট মাথায় নিয়ে হাসু অনুমান করে—কোথায় দশ সের? স্যুটকেসটার ওজনই বিশ সেরের কাছাকাছি হবে। যেন সীসা ভরা আছে স্যুটকেসটায়। তার ওপর বিছানা। হাসুর মাথায় ভারী লাগে বোঝাটা। ভদ্রলোক এবার ওপর থেকে খবরের কাগজ ও একটা হাতব্যাগ নিয়ে হাসুর হাতে চাপিয়ে দেন।
জেটি পার হবার সময় একজন ডাকেন—আরে রশীদ, তোর জন্যে সাড়ে ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছি। তোর বাড়ীতে খবর নিয়ে জানলাম তুই আজ আসছিস।
দু’জনের করমর্দন ও কুশলবার্তার পরে আলম সাহেব বলেন—তোর জন্যে অপেক্ষা করছি কেন জানিস?
—আরে হ্যাঁ—হ্যাঁ। কোথায় বল দেখি?
প্যারাডাইসে, হজ্জতুল্লা আর নির্মল বসে আছে। তুই না হলে যে জমেই না।
রশীদ সাহেব বলেন—যে রকম দেখছি তাতে পাকিস্তানে সোমরস পান বুঝি আর সম্ভব হবে নারে।
সব বে-রসিক।
আলম সাহেবের সাথে রশীদ প্যারাডাইস ক্যাফেতে গিয়ে ওঠেন।