প্রথমে গদু প্রধান ভ্রূক্ষেপ করেনি। পরে যখন পায়ের কাছে ঢিল পড়তে শুরু করে, তখন তার হাত থেকে মাছ দুটো খসে পড়ে যায়। সে ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়তে পড়তে কোনো রকমে বাড়ী এসেই অজ্ঞান।
রহমত কাজী রাত দুপুরের পর তাহাজ্জদের নামাজ পড়বার জন্যে ওজু করতে বেরিয়ে ফুটফুটে জোছনায় একদিন দেখেছে সূর্য-দীঘল বাড়ীর গাবগাছের টিকিতে চুল ছেড়ে দিয়ে একটি বউ দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে দেখছিল। চোখের পলক ফেলে দেখে আর সেখানে বউ নেই। একটা ঝড়ো বাতাস উত্তর-পশ্চিম কোণাকুণি করম আলী তার বাড়ীর ওপর দিয়ে চলে গেল। পরের দিনই করম আলী হাজীর ‘পুতের বউ’ কলেরায় মারা যায়। দু’দিন পরে তার হালের তিনটা তরতাজা গরু কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে খতম।
আরও অনেকের সাথেই নাকি অনেক বেশে ভূতের দেখা হয়েছে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর ভুতের গল্পের অন্ত নেই। তাই দিন-দুপুরেও পারতপক্ষে এ বাড়ীর পাশ দিয়ে কেউ হাঁটে না।
বাড়ীটার বড় আকর্ষণ একটা তালগাছ। এত উঁচু তালগাছ এ গায়ের লোক আর কোথাও দেখেনি। কত শিশুর পরিচয় হল তালগাছটির সঙ্গে। তারা বুড়ো হল, জীবন-লীলা সাঙ্গ করল। তাদের কত উত্তরপুরুষও গেল পার হয়ে। কিন্তু তালগাছটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মত। কালের সাক্ষী হয়ে শত ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে।
তালগাছটি এ-এলাকার গর্বের বস্তু। চর-অঞ্চলে বিশেষ করে বক্তবলীর চরে গেলে কথায় কথায় যখন কুল-কৌলীন্যের তক ওঠে, তখন এখানকার লোক এ তালগাছটির নজির দেখায়। কেউ কেউ নিজেদের বনেদীপনা জাহির করে। তারা এরকম করে বলে—আমরা অইলাম গিয়া সাবেক মাড়ির ভর্নলোক, বুঝলানি মিয়া? আমাগো ঘর বহুত পুরানা। ঐ আসমাইন্যা তালগাছটা সাক্ষী। দেহাও দেহি, অত বুড়া আর ডাগর গাছ একটা তোমাগ মুল্লুকে? ও হো, ঠন ঠন। তোমাগ এইদিগের বড় তালগাছ আমাগ গেরামের খাজুর গাছের হমান। আমাগড়া সেই মইযখালির হাটের তনে দেহা যায়। তোমাগড়া অত বড় অইব ক্যামনে? এইত হেদিনের চর এইডা। এইহানে আগে আছিল গাঙ। তোমরা অইলা চরুয়া ভূত—বাইল্যা মাডির তরমুজ, ইত্যাদি।
অপর পক্ষ রাগ করে না। তারা সব সময় এ সাবেক মাটির বাসিন্দাদের কৌলীন্য স্বীকার করে। বহু টাকা খরচ করেও এদের ছেলে-মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করে। এখানকার বহু কালো কুৎসিত মেয়ে চরের সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরে বিকিয়ে যায় এ কারণেই।
জয়গুন ও শফির মা সাত-পাঁচ ভেবে এ বাড়ীতে বাস করার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। ছেলেমেয়ের অমঙ্গল আশকা করেই নিরস্ত হয়েছিল বিশেষ করে। কিন্তু একদিন এক নামকরা ফকির—জোবেদ আলী এ সঙ্কট থেকে তাদের উদ্ধার করে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর চারকোণে চারটা তাবিজ পুঁতে এসে সে জানিয়ে দেয়—এই বার চউখ বুইজ্যা গিয়া ওড বাড়ীতে। আর কোন ডর নাই। ধুলাপড়া দিয়া ভূত-পেত্নীর আচ্ছা ভাইঙ্গা দিছি। চাইর কোণায় চাইড্যা আলীশান আলীশান পাহারাদারও রাইখ্যা আইছি। সব আপদ-বিপদ ওরাই ঠেকাইব। বাড়ীর সীমানার মইদ্যে ভূত-পেত্নী; জিন-পরী, ব্যারাম-আজার—কিছু আইতে পারব না।
জয়গুন ও শফির মা খুশী হয় ফকিরের ওপর। শফির মা তার ভিক্ষার ঝুলি খালি করে সোয়া সের চাল দেয় তাকে। জয়গুন দেয় সোয়া পাঁচ আনা পয়সা। কিন্তু ফকিরের মন ওঠে না। শফির মা অনুনয় করে—আমরা গরীব-কাঙ্গাল মানু। এই এর বেশী আর কি দিতে পারি?
—বাড়ীতে যখন ঠিকঠাক অইবা তখন একটা পিতলের কলসী দিও। আর হোন, তোমাগ বাঁশ ঝাড়ে বড়্ড়া বাঁশ দ্যাখলাম। এক জোড়া বাঁশ দিও আমারে অরে দিলে আখেরে কাম দিব।
জয়গুন ও শফির মা আপত্তি করে না।
ফকির আবার বলে—হোন, আর এক কথা। বচ্ছর বচ্ছর কিন্তু পাহারা বদলাইতে অইব। যেই চাইরজন এইবার রাইখ্যা গেলাম, হেইগুলা কমজোর অইয়া যাইব সামনের বচ্ছর। বোঝতেই পার, দিনরাইত ভূত-পত্নীর লগে যুদ্ধ করা কি সোজা কাণ্ড!
সূর্য-দীঘল বাড়ী মানুষের হাত লেগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। জয়গুন ও শফির মা আজেবাজে গাছ-গাছড়া বিক্রি করে টাকার আমদানী করে। তাতে অন্ধকার বাড়ীটায় আলোর আমদানীও হয় বেশ। নিজেদের ঝড়ের বাঁশ কেটে খুঁটি হয়। খড়ের চালা ও পাটখড়ির বেড়া নিয়ে দু’ভিটেয় দু’খানা ঘর ওঠে। ঘর নয় ঠিক—ঝুপড়ি। রোদ-বৃষ্টি ঠেকানোর আদিম ব্যবস্থা।
বছর বছর পাহারাদার বদলিয়ে তিনটি বছর কেটে গেল সূর্য-দীঘল বাড়ীতে। কোনো বিপদ-আপদ আজ পর্যন্ত আসেনি। ম্যালেরিয়া জ্বর ছাড়া অসুখ-বিসুখও হয়নি ছেলেমেয়েদের। এ জন্যে ফকিরের দোষ দেয়া যায় না। ম্যালেরিয়া জ্বর কোন বাড়ীতে
এবার আবার পাহারাদার বদলাবার সময় হয়েছে। একদিন জয়গুনের ঘরে বসে শফির মা বলে—ফকিরের যে আর দ্যাহা মিলে না আইজকাইল। হেইযে কবে আইয়া গেছে। আর একবার হাত-হপনেও দাহা দিয়া গেল না, আমরা বাঁইচ্যা আছি না মইরা গেছি। কেমনতরো মানু। এদিকে বছর যে ঘুইরা গেল। কলসীডা না দেওনে বেজার অইছে বুঝিন্।
ফকিরকে তাদের প্রতিশ্রুত পেতলের কলসী দেয়া হয়নি এ পর্যন্ত। সাত-স্বপনেও তার দেখা না পাওয়ার কারণ এটা নয়। কারণ অন্য একটা। জয়গুন ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
কলসীর তাগাদা দিতে ফকির মাঝে মাঝে আসত। জয়গুন ও শফির মা নিজেদের উপস্থিত অক্ষমতা জানিয়ে কিছুদিন সবুর করবার অনুরোধ জানাত। শফির মা বাড়ী থাকলে কখনো লাউ-কুমড়ো, কখনো শসা-বেগুন—যখনকার যা নিয়ে সে খুশী মনে ফিরে যেত। শফির মা বাড়ী না থাকলে সেদিন জয়গুনের ঘরের দোরগোড়ায় যেন শিকড় গেড়ে বসত সে। উঠবার নামও করত না। কোনোদিন সে বলত—এক খিলি পান দ্যাও বেয়ান।