জয়গুন নিষেধ করে থাউক, আইজ আর কামে যাওন লাগব না। কথা গায়ে দিয়া হুইয়া থাক। তোরে পইপই কইর্যা নিযুধ করি ভারী পোঝা মাতায় নিস না। তা হুনবি না।
বেশী লোভ করার জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে ধিক্কার দেয় জয়গুন। তের বছরের এতটুকু ছেলে কামাই করে খাওয়ায় এই ত বেশি।
রোজগার করে সব পয়সা তার হাতে এনে দেয়। একটা পয়সাও এদিক-ওদিক করে না। এমন কি এক পয়সার চিনেবাদাম খেলেও তার হিসেব দেয় তার কাছে।
জয়গুন সর্ষের তেলের শিশি থেকে একটু তেল নিয়ে হাসুর ঘাড়ে মালিশ করতে করতে বলে—পায়ে তুঁইত্যার পানি দিছিলি কাইল?
–উহুঁ।
—হেইয়া দিবি ক্যান। দেহি কেমুন অইছে?
জয়গুন পায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে বলে— দ্যাখ, ক্যাদায় চামড়া খাইয়া ঝাঁজরা কইরা দিছে।
একটা নারকেলের মালায় তুঁতে গোলা নিয়ে আসে জয়গুন। হাঁসের পালক ভিজিয়ে হাসুর পায়ের তলায়, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে এঁতের পানির পো দেয়।
হাস উ-হু-হুঁ করে ওঠে। বলে—আর দিও না, মা। বড় পোড়ায়।
—না দিলে চামড়া পইচা যাইব এক্কেরে। আঁটতে পারবি না। রাস্তা-ঘাটে যেই ক্যাদা।
জয়গুন নিজের পায়েও পুঁতে গোলা দিয়ে প্রলেপ লাগায়। মায়মুনের পায়েও লাগিয়ে দেয়। বাড়ীর উঠানে পর্যন্ত কাদা হয়েছে। পায়ের পাতা অবধি ডুবে যায় কাদায়। তুঁতের প্রলেপ দিলে পায়ের তলা অত হেজে যেতে পারে না।
পরের দিন চমৎকার রোদ ওঠে। জয়গুন হাসুর কপালে ও বুকে হাত দিয়ে দেখে। তার মুখের ওপর থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যায়। প্রভাতী রোদের মত তার মুখ আনন্দে চিকচিক করে। হাসুকে ডেকে সে বলে—ওঠ, দ্যাখ আইজ কেমুন রউদ ওঠছে!
হাসু উঠে বসে।
জয়গুন বলে—আমার ত ডরেই ধরছিলো। কাইল যেই রহম গরম আছিল শরীল। জ্বর ওডে নাই কপালের ভাগ্যি। কেমুন লাগছে রে শরীল?
—ভালা। আইজ কামে যাইমু, মা?
—আত-মুখ ধুইয়া আয়। খাইয়া তারপর চল যাই। আমিও যাইমু। চাউল ফুরাইছে। আহজ চাউল না আনলে ওই বেলা চুলা জ্বলব না।
হাসু, হাসুর মা কাজে বের হয়। হাসুর মা বার বার হাসুকে নিষেধ করে দেয়, খবরদার, ভারী পোঝা মাতায় নিবি না কিন্তুক। গর্দান ভাইগা যাইব।
কিন্তু হাসু দু’দিনের কাজ একদিনে করার সঙ্কল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়েছে। কাল কাজ হয়নি। আজ বেশী কাজ করে অন্তত কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া তার চাই-ই।
হাসু নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে আসে।
আজকাল যাত্রীর সংখ্যা খুবই বেড়েছে। বাইরের থেকে যেমন বহুলোক আসছে, আবার বাইরেও যাচ্ছে তেমনি। বিশ্রামঘরে গাদাগাদি হয়ে আছে লোক। জাহাজে গাড়ীতে জায়গা হয় না। অনেক যাত্রীকেই দু-তিন দিন স্টেশনে পড়ে থাকতে হয়। ছেলেমেয়ে মা-বউ নিয়ে আবার অনেক বিদেশী আশ্রয় নিয়েছে স্টেশনের চালা ঘরে।
হাসু মোটের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘোরে আর এদের দিকে চায়। তার অদ্ভুত লাগে এদের পোশাক। এদের কথাও বোঝা যায় না—হাসু কাছে দাঁড়িয়ে শুনেছে! এক জায়গায় একটি স্ত্রীলোক রুটি সেঁকতে শুরু করেছে। দুটি ছেলেমেয়ের লোলুপ দৃষ্টি তার ওপর। রেল লাইনের পাশেও এক জায়গায় সে এরকম আরো অনেক লোক দেখেছে আজ। হাসুর মনে পড়ে দুর্ভিক্ষের বছরের কথা। এরকম ভাবে মায়ের সাথে সাথে গাছ তলায় কত রাত কেটেছে। বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় নিতে গিয়ে কত লোকের তাড়া খেয়েছে। হাসু অনুমান করে, নিশ্চয় ওদের দেশে আকাল এসেছে।
যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও হাসু সুবিধা করতে পারে না। নম্বরী কুলিদের জন্যে মোট ধরবার যো নেই। যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় বরং অসুবিধা হয়েছে। ভিড়ের জন্যে ঘাটে জাহাজ। ধরবার আগেই জেটির গেট বন্ধ হয়ে যায়। নশ্বরী কুলি ছাড়া অন্য কুলিরা ঢুকতে পারে। না। সে পানি সাঁতরে স্টীমারে ওঠে। কিন্তু নম্বরী কুলিরা দেখতে পেলে মাথার ওপর গাট্টা মারে। হাসু এই কুলিদের খুবই ভয় করে।
ট্রেন ও স্টীমারের সময় হাসুর মুখস্থ হয়ে গেছে। একটা ট্রেন আসবে দশটায়। দশটা বাজবার এখনো দেরী। হাস রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে যায়। এগারোটার জাহাজে যারা যাবার তারা সাধারণত এখানেই নামে রিক্সা থেকে।
এক ভদ্রলোকের মালপত্র নিয়ে দু’জন নশ্বরী কুলির মধ্যে বচসা শুরু হয়েছে। হাসু দুরে দাঁড়িয়ে দেখে।
একটা কুলি বলেছোড়দে। আপনি কিসকো লিবেন, বাবুজি?
আর একটা রিক্সা এসে থামে। চড়নদার ভদ্রলোকের সাথে ছোট একটা স্যুটকেস ও বিছানা। বোঝাটা বেশী ভারী হবে না। হাসুর মাথার পক্ষে উপযুক্ত বোঝাই। হাসু এগিয়ে যায়। সুটকেস ধরে জিজ্ঞাসা করে—কলি লাগব নি, বাবু?
ঝগড়ায় রত কুলিদের একজন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কুলিকে বোঝাটা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে আসে। হাসুকে হাত দিয়ে সরিয়ে বলে—ভাগ ব্যাটা।
হাসু নিঃশব্দে সরে যায়। একটা লাইটপোস্টে পিঠ ঠেকিয়ে সে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। রিক্সায় কোন যাত্রী এলে সে আগেই আন্দাজ করে, ঘাডে কুলাবে কিনা। তার উপযোগী মোট না হলে সে এক পা নড়ে না, লাইট পোস্টের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনেকক্ষণ পরে যদি বা মোট পাওয়া যায়, তাও নম্বরী কুলিদের ফাঁকি দিয়ে লওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দুরে হুইসিল শোনা যায়। একটা ট্রেন আসছে। হাসু স্টেশনে ঢোকে। ট্রেনেই যা কিছু সুবিধা করা যায়। এখানে নশ্বরী কুলিদের ফাঁকি দেওয়া যায়। পেছনের দিকের গাড়ীগুলোর থেকে মোট নিয়ে সরে পড়লে তারা দেখতে পায় না। কিন্তু এখান থেকে মোট বয়ে রিক্সায় তুলে মোট পিছু দু’আনার বেশী পাওয়া যায় না। পথ কম বলে দু’আনার বেশী আশাও করা যায় না। জাহাজের মোটে পয়সা বেশী। মোট পিছ চার আনা। এখানকার দুই মোটের সমান। কিন্তু খাটুনিও ডবল।