শফির মা বলে—দু পরধান মানুষ ভালা। তার পাঁচটা বলদ, তিনডা গাই। দশ মরাই ধান পায় বচ্ছর। জাগা-জমিনের ইসাব-কিতাব নাই। কাম আছে মানি। তয় আমি কই, যেইখানে কাম আছে হেইখানে ভাতও আছে। আর তোর ত একলা কাম করতে অইব না। আগের তিন জননা আছে পরধানের। চাইড্যা পোলার বৌ আছে। এক্কেরে সোনার বাগিচা হাজাইয়া রাখছে। ওরাই বেবাক কাম করব! তুই হুকুম দিয়া খাডাবি।
জয়গুনের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কিছু বলতে পারে না।
শফির মা আবার বলে—পরধান কাইলও আমারে ধরছিল। আমি কইলাম, পোলা আর মাইয়াড়ার লেইগ্যাই যত মুস্কিল। হে কইল, তা পোলা আর মাইয়াডারে আমার বাড়ীতে লইয়া আইলেই ত অয়। কত মানুষ খাইয়া বাচে আমারডা। দুইডায় আর কি অইব! এইবার বিবেচনা কইরা তুই মোখ ফুইটা একটু হুঁ করলেই অইয়া যায়। সুখে থাকবি, কইয়া দিলাম।
খড়ের আগুনের মত দপ করে জ্বলে ওঠে জয়গুন—হুঁহ, আমারে তাড়াইতে পারলে লুইট্যা-লাপইট্যা ফলার কইর্যা খাইতে পারবা। তা মনেও জাগা দিও না, কইয়া দিলাম।
—তোবা! তোবা! তোর চীজ ছুঁইলে যেন আত খইয়া পড়ে, তোগ গাছের একটা পাতা ছিঁড়লে যেন রাইত না পোয়ায় আমাগ।
জয়গুন যেমন জ্বলে উঠেছিল, শফির মা-র কথায় আবার নিবে যায়। সে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে এবার বলে—না বইন, বিয়া ত দুই খানেই অইল। অনেক দ্যাখলাম, অনেক শিখলাম, আর না। পোলা মাইয়ার মোখ চাইয়া আর পারুম না, মাপ করো। পোলা আর মাইয়াডার বিয়া দেইখ্যা যেন চউখ বুজতে পারি, দোয়া কইরো।
শফির মা নিরাশ হয়ে বলে—তোর ময়মনের বিয়া দে এইবার। একটা সম্বন্ধ আছে আতে।
—না, এত শিগগির কি অইল! যাউক আর দুই বচ্ছর।
—না, না। মাইয়া তোর বিয়ার লায়েক অইছে। আর ঘরে রাখন ঠিক না।
জয়গুন একটু চিন্তা করে বলে—কোথায় সম্বন্ধ আছে?
—সদাগর খাঁরে তুই ত চিনসই। তার নাতি-সোলেমানের ব্যাডা, নামড়া যেন কি! ভুইল্যা গেলাম বুঝিন, অহো মনে পড়ছে, ওসমান। ওসমান।
-ওঃ, ওসমান। ওসমান ত বিয়া করছে!
করছিল। বউ মইরা গেছে চৈত মাসে ভেদের ব্যারামে।
—কিন্তু পোলার বয়স যে অনেকখানি।
—তোর মাইয়াড়ার বয়সই কম কি।
—কম না? আমার মাইয়ার বয়স মোড়ে দশ, ধরতে গেলে দুধের মাইয়া আমার।
—দুধের মাইয়া! কি যে কস তোরা ছাই-মুণ্ডু। মাইয়ারা এই বয়সে বাচ্চা বিয়ায়। আমার মা-র এগারো বছরের কালে আমার জর্ম অয়।
শফির মার সাথে কথায় পেরে ওঠে না জয়গুন। সে বলে—আইচ্ছা ভাইব্যা চিন্তা দেহি। পরে কইমু। নছিবে যদি ঐখানে ভাত লেইখ্যা থাকে, তয় অইব। কার কোনখানে দানাপানি লেহা আছে, খোদা জানে। অহন যাই। ওদিকে আবার ভাতের আঁড়ি না ভাইঙ্গা চালায়।
বাইরে নামতেই চোখে পড়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সে চারদিকে চেয়ে বলে—উত্তরে আর পুবে যে মেঘা করছে, ভাজ! আইজ বুঝিন আসমান শুদ্ধ ভাইঙ্গা পড়ব। আইজ আর উপায় নাই। এই বষাকালডা ভিজতে ভিজতে গেল। তোমার ঘরের চাল ত ভালা আছে। আমার চালে ছনই নাই।
—আমার চালে আর কই আছে? হেই কবে, গেল বচ্ছরের আগে ঠিক করছিলাম। তব বিষ্টি পড়ে ছয় সাত জায়গায়।
—কি করমু আর! কপালে আছে ভিজতে অইব, ভিজমুই। পাচটা ট্যাকাও একখানে করতে পারলাম না। ঘরের চাল ছাওয়াই কি দিয়া। উদর লইয়া আর পারলাম না। উদরেই যায় বেবাক টাকা।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। জয়গুন ধরে যায়। মায়মুন রান্না শেষ করেছে।
—চালাক কইর্যা ভাত খা তোরা। আসমানের দিগে চাইছিলি? কাউয়ার আণ্ডার মতন কালা অইছে আসমান। আইজ আবার ঘরের মধ্যে সোত ছুটব। খাইয়া লইয়া উত্তরমুখি বিছানা সরা।
অসংখ্য ছিদ্রপথে বৃষ্টির পানি ঝরতে থাকে ঘরের ভেতরে। তা ছাড়া দক্ষিণে বাতাসের জন্য বৃষ্টির ঝাপটা দক্ষিণ দিকটায় লাগে বেশী। তাড়াতাড়ি খেয়ে তারা বিছানা সরায় উত্তর দিকে।
জয়গুন বলে—একটা কাঁথাও পাইড়্যা নেগ্যা। তারপর কুঁকড়ি মুকড়ি অইয়া শুইয়া থাক ভাই-বইনে।
বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে জোরে। সত্যি সত্যি আকাশটাই ভেঙে পড়ছে যেন। এশার নামাজ পড়ে ছেলেমেয়ের শিয়রের কাছে তসবী হাতে বসে জয়গুন। সে তসবীর দানা গুণছে কি সময় গুণছে বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ পরে বৃষ্টির বেগ কমে। কিন্তু বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় না একেবারে। এখন যে রকম অলস বর্ষণ শুরু হয়েছে, তাতে সারা রাতেও বৃষ্টি থামবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। জয়গুন কাঁথার ওপর হাত দিয়ে দেখে, কথাটা ভিজে গেছে। সে এক পাশে শুয়ে পড়ে।
হাসু হঠাৎ জেগে উঠে বলে—পায়ের কাছটা একদম ভিজ্যা গেছে, মা।
—তুই অহনো ঘুমাস নাই?
–উহুঁ।
–আত-পা কাঁকড়ার মত গুডিসুডি মাইরা পইড়া থাক।
১০. সূর্যের মুখ দেখা যায় না
এমন দিন পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্যেও সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সারাদিন টিপিরটিপির বৃষ্টি পড়ে। হাসু ঘরের বার হয় না। শরীরটাও ভালো নেই। শরীরের সমস্ত গিঁঠে গিঁঠে বিশেষ করে ঘাড়ে টনটনে ব্যথা হয়েছে।
হাসু মা-কে বলে—গর্দানডায় বেদনা করেগো, মা। শীত শীত লাগে।
হাসুর গায়ে হাত দিয়ে জয়গুন শঙ্কিত হয়। ছেলেটা জ্বরে পড়লে উপায় নেই আর। বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে ছেলেটাকে যে ভাবে সে কাজে পাঠায় তাতে এই ছোট শরীরটার ওপর জুলুমই করা হয়। কচি ঘাড়টার ওপরেই জুলুমটা হয় বেশী। অথচ এই ঘাড়টা তাদের জীবন-মরণের কল-কাঠি। তিনটি প্রাণীর জীবনের বোঝা মাথায় নিয়ে হাসুর এই কাঁচা ঘাড়টা মাঝে মাঝে ব্যথাকাতর হয়ে পড়ে।