শফির মা আর পুরাতন স্মৃতি ঘাটতে সাহস পায় না। সে সব সময় ভুলে থাকতেই চেষ্টা করে। কিন্তু কথায় কথায় বা একা বসে থাকলে যখন সে স্মৃতি এসেই পড়ে, তখন সে আর সহ্য করতে পারে না। বিনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতে শুরু করে। তার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে সে নয় সন্তানের জননী। কিন্তু একমাত্র শফিই বেঁচে আছে—বাকী আটটির চারটি আঁতুড়েই শেষ হয়। এটি কলেরায় আর একটি বসন্তে মারা যায়। আর একটি—তার নাম মফি, শফির দুই বছরের বড় ছিল—দুর্ভিক্ষের বছর সে কোথায় হারিয়ে গেল! শফির মা আজও এ ছেলেটির আশা ছাড়ে নি। তার ধারণা মফি এখনও বেঁচে আছে।
মাঝে মাঝে শফির মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে—আমার ওরা বাঁইচ্যা থাকলে এই দশা আমার? আইজ আমি খরাত কইর্যা খাই! ওরা বাঁইচ্যা থাকলে আমার বাদশাই কপাল আছিল। ওরা কামাই করত। ও বউ আইত ঘরে। ওরা রাইন্দা-বাইড়া সামনে ধরত। সোনার খাটে বইস্যা, রূপার খাটে পাও রাইখ্যা আমি সব দ্যাখতাম আর হুকুম করতাম। নাতি-নাতকুড় ঘিরা বইত চাইর পাশে। ক্যাচম্যাচ করত কিচ্ছা হোননের লেইগ্যা।
শফির মা-র চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। মায়মুন দেখে আশ্চর্য হয় না। কারণ, এ আজ নতুন নয়। কখন সে কাঁদবে আর কখন কাঁদবে না—কেউ বলতে পারে। না। মায়মুন ছেচনীর থেকে ছেচা পান তুলে ধরে। শফির মা মুখে দেয়।
মায়মুন এবার বলে—একখান কিচ্ছা কও না, মামানি?
—না লো। আইজ আর পরাণড় ভালা ঠেকে না।
মায়মুন আর অনুরোধ করে না। শফির মা বলে—তুই একটু দেইখ্যা আয় তো শফি কি দিয়া কি রানদে। কয়ডা কলমীর শাক রানব আর ভাত। কাইল ভাত ফুটছিল কম। চাউল চাউল ভাত গিল্যা গিল্যা খাইছি। দাঁতদন্ত না থাকা আর এক জ্বালা।
মায়মুন রান্না ঘরে যায়। চুলোর ওপর বসানো ভাতের হাঁড়ি থেকে কয়েকটা ভাত। তুলতে তুলতে শফিকে বলে—একটা শোলক ভাঙ্গাও দেহি শফি ভাই–
মাছ করে ঝক ঝক ছোট্ট এক ঝিলে
একটা মাছে টিপ দিলে বেবাকগুলা মিলে।
ইশ, জবর শোলক ত। এইডা শিখা রাখছি কুট্টিকালে—ঝিল অইল আঁড়ি আর মাছ অইল ভাত! কেমুন? অইছে? এই বার একটা মাছে টিপ দিয়া দ্যাখ দেখি ফোটলনি?
মায়মুন একটা ভাতে টিপ দিয়ে বলে—অইয়্যা গেছে। দ্যাখত কেমুন মজা! একটা ভাতে টিপ দিলে বুঝা যায় ফোটলনি না ফোটল না।
—আর একটু ফোটতে দে। মা আবার শক্ত ভাত খাইতে পারে না।
—কাইল তুমি শক্ত শক্ত চাউল চাউল ভাত রানছিলা, মামানি কইছে। ভাত রানতেও জান না?
—আমি জানি না, কে জানে রে? টিক্কাদার সাবের বাসায় এতকাল পাক করলাম আমি। আইজ তুই আমারে হিগাইতে আইছস?
রান্না সেরে শফি ও মায়মুন ঘরে এলে শফির মা বলে—তোর মা অহনো আইল না, ময়মন? রাইত যে অনেক অইল!
বাইরে চ্যাবর চার পায়ের শব্দ শোনা যায়। উঠানে কাদার মধ্যে দিয়ে কে যেন আসছে।
শফির মা ডাকে—হাসুর মা?
—হ ভাজ, আমি অই।
—আহো আমার ঘরে।
জয়গুন এসে দরজায় দাঁড়ায়। শফির মা বলে—তোর হায়াত আছে। অনেক দিন বাছবি তুই। এই এটটু আগেই তোর নাম নিছিলাম।
—অহন যাই বইন। আখা ধরাইতে অইব আবার।
-আইচ্ছা যাও। আখা ধরাইয়া এটটু এদিকে আইও, তোমার লগে কতা আছে।
—কি কতা?
—পরে কইমু। অহন যাও চাউল কি দর আনলাগে?
—দুই সের, বইন। দর চইড়া গেছে। আর যা মছিবত আইজ কাইল। টারেনে যা মানুষের ভিড়। জেরের এই দুই কিস্তি ধইর্যাই এই রহম। আগে এমন ভিড় আছিল না।
জয়গুন পাক চড়িয়ে শফির মার ঘরে আসে। শফির মা বলে—কয়দিন ধইরা একটা কথা কইমু কইমু করতে আছি। কিন্তু সময় মত এটটু একখানে বইতে পারি না। তুমি থাকলে আমি থাকি না, আমি থাকলে আবার তোমার দাহাই মিলে না।
—কি কতা?
—কই, সবর কর। পান খাইলে একটু খা, ঐ দ্যাখ তোর পিছে পাতার মধ্যে।
জয়গুন পান খেতে খেতে বলে–কি কতা এই বার কও দেখি ভাজ।
—রাখ না, কই। আমার এই কাপড়ভা একটু তালি দিয়া দিবি। আমি আবার সুঁইয়ে সূতা গাঁথতে পারি না। ছাই, চউখটা এক্কেবারে গেছে।
—আইচ্ছা।
—ছিঁড়া কাপড় পিন্দা বাইরে যাইতে লজ্জা করে। তুই একটু সিলাইয়া দিলে তবু বেড় দিয়া পিনতে পারমু। তোর আতে সিলাইডা অয় ভালা।
–শফিরে দিয়া পাড়াইয়া দিও। এই এর লাইগ্যা বোলাইছিলা? জয়গুন উঠতে উদ্যত হয়।
—না, আরো কত আছে, ব’।
-কও কি কতা।
–ফকিরের লগে তোর দেহা অয় না, আঁ? তোরা ত কত দূরে দূরে যাস। একদিনও চউখে পড়ে না?
–উঁহু।
—দ্যাখ দেখি কেমুন বে-য়াক্কেইল্যা! কতদিন গুজারিয়া গেল, বাড়ীর পাহারা আর বদলাইয়া দিয়া গেল না। আমার ত রাইতে ঘুমই আহে না ডরে। তুইও আমল দিবি না।
—উহুঁ, পাহারা বদলাইতে অইব না আর। পাহারা না ছাই। ফুক্কা দিয়া টাকা নেওনের ছল—চক্কর।
—ছল-চক্কর! তুই যে কী কস্! আইচ্ছা সূর্যু-দীগল বাড়ীতে থাকতে তোর কি পরাণে ডর-ভয় লাগে না?
জয়গুন আবার উঠতে উদ্যত হয়।
শফির মা বাধা দেয়—ব’। আদত কথা তো অহনো কই নাই।
—কী আদত কতা, কও।
—তোরে আগেও কয়বার আমি কইছিলাম। তুই আমার কতা ঠেইল্যা দিলি।
—ঠেলমু না কি করুম?
—এইডা কি ঠেলুনের মত কতা!
–তয় কি?
—তোর ভাই বাইচ্ছা থাকলে তার কতা ঠেলতে পারতি? ধইরা বাইন্ধা কবে তোর নিকা দিয়া দিত।
—তুমি মোখ বোজ দেহি। তোমার ঐ এক বুলি আমার আর কানে সয় না।
—হেইয়া সইব ক্যাঁ? আমি তোর ভালার লেইগ্যা কই কি না। বয়স ত অহনো তিরিশ অয় নাই। অহনো গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা-কাচ্চা পেড়ে ধরনের বয়স আছে।
জয়গুন শ্রান্ত। সে মুখ নিচু করে বসে থাকে।