শামুক খাজারে, আমার বাড়ী আয়,
কুচি কুচি শামুক দিমু হলদি দিমু গায়,
ওরে শামুক খাজারে।
তোর বাড়ী অনেক দূরে, সাত পাক ঘুইরে ঘুইরে
আমার বাড়ী আয়।
শফি এসে পাশে দাঁড়ালে মায়মুনের গান বন্ধ হয়ে যায়।
শফি বলে—এগুলা দিয়া কি করবি?
মায়মুন কিছু না বলে হাঁসের বাচ্চা দুটো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
—দে আমি কাইট্যা দেই।
—উহু আমিই পারি কত কাটতে।
মায়মুন একটা পাতায় করে কুচি কুচি করে কাটা শামুক নিয়ে বাচ্চা দুটোর সামনে ধরে। বাচ্চা দুটো কয়েকবার ঠোঁট দিয়ে নেড়ে খেতে শুরু করে।
শফি বলে—বাহ খাইতে শিখছে রে! কেমন ক্যাং ক্যাৎ কইরা খায়! দ্যাখ চাইয়া।
—দেখছি।
মায়মুন বসে বসে দেখে।
শফি বলে—আমারে একটা বাচ্চা দিবি?
—ইশ!
—পয়সা দিমু আষ্ট খান।
—উহু এক ট্যাহা দিলেও না।
—ফুলঝুরি দিমু। আর চুলের কিলিপ।
মায়মুন বলে—উহু সাত রাজার ধন মাণিক্য দিলেও না।
—না দিলে চুরি কইর্যা লইয়া যাইমু তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন এবার চেঁচিয়ে ওঠে—মামানি, ও মামানি, দ্যাখ তোমার পোলা কেমুন লাগাইছে। তারপর হাঁসের বাচ্চা রাখবার গর্ত থেকে পানি ছিঁটিয়ে দেয় শফির চোখেমুখে।
শফির মা-ও শফিকে ডাক দেয়—অ্যাঁরে শফি, কি শুরু করলি? আমি আইলে ঠ্যাঙ ভাঙুম কিন্তু।
-না মা, ফাঁকিজুকি দিলাম আমি।
কলাগাছের ভেলায় চড়ে শফি ও মায়মুন মোড়লদের ছাড়া ভিটয় যায় লাকড়ি কুড়াতে। শফি জঙ্গলের ভেতর দিকে নিয়ে যায় মায়মুনকে। শফি গাছে উঠে শুকনো ডাল ভেঙে নিচে ফেলে। মায়মুন কুড়িয়ে জড়ো করে এক জায়গায়।
শফি গাছে চড়তে বেশ ওস্তাদ। এক গাছের ডাল বেয়ে সে আর এক গাছে চলে চায়। মায়মুন বলে—আর ওই মুহি যাইও না শফি ভাই, ওই গাবগাছে—
—কি ঐ গাবগাছে?
—আলেক মোড়লের বউ গলায় দড়ি দিছিল ঐ গাবগাছে, তুমি বুঝিন জান না?
—হেতে কি অইছে?
—উঁহু, আমার ডর করে। তুমি নাইম্যা আহ হবিরে। শফি গাছ থেকে নেমে বলে—মায়মুন চাইয়া দ্যাখ দেহি, ঐ দিক ঐ গাবগাছে কালা একটা কি দ্যাহা যায়।
মায়মুন ঐ দিকে না চেয়েই ওগো মাগো বলে শফিকে জড়িয়ে ধরে। শফি জোরে হেসে ওঠে। বলে—আরে কিছু না, ফাঁটকি একদম ফাঁটকি। দিনে-দুপরে কিয়ের ডর? চাইয়া দ্যাখ। দ্যাখ না ছেড়ি। কিছুই না, চউখ মেল এইবার।
মায়মুন তবু চোখ খোলে না।
শফি ওকে কোলে তুলে ভেলার কাছে নামিয়ে দেয়। মায়মুন এতক্ষণে চোখ মেলে। সে বলে তুমি কি ফাজিল। খামাখা ডর দেহাইলা।
শফি হাসে হিঁ-হিঁ করে।
মায়মুন বলে—তুমি গিয়া লাকড়ি লইয়া আহ। আমি আর যাইতে পারতাম না।
শফি বাগানে যায়। শুকনো ডালগুলো একটা লতা দিয়ে বেঁধে মাথায় করে নিয়ে আসে। তারপর বাড়ী এসে দুটো ভাগ করে। নিজের ভাগের থেকে কয়েকটা ডাল মায়মুনকে দিয়ে। বলে—তোরা মানুষ বেশী। এই কয়ডা বেশী নে তোরা।
বিকেল বেলায় মায়মুন তেঁতুল তলায় বড়শী নিয়ে বসে। তার কোলের কাছে হাঁসের বাচ্চা লুটো। আবার শফি এসে জোটে সেখানে। একটা ছিল ওর বড়শীর কাছে ছুঁড়ে শফি তেঁতুল গাছের আবডালে পালায়।
মায়মুন কিছু দেখতে না পেয়ে দাঁড়াতেই হেসে ওঠে শফি— হিঁ-হিঁ-হিঁ!
মায়মুন বলে—তুমি বড় শয়তান। চাইঙ্গা মারলা ক্যান?
-কই চাইঙ্গা! মাছে ডাফ দিল ছেঁড়ি। জবর মাছ অইবরে! বোয়াল মাছ।
মায়মুন মাথা নেড়ে বলে—হুঁ, বোয়াল মাছ।
—হ রে হ। কি মাছ পাইছস?
—কিচ্ছুই না। একটা তিঁত পুডিও না।
—কিছুই না?
–উঁহু।
শফি আশ্চর্য হয়। তারপর গম্ভীরভাবে বলে—তোর বড়শীতে কার জানি মোখ লাগছে রে! কেও নষ্ট না করলে এমুন অয়? আমার মনে অয়, কেও ডিঙ্গাইয়া গেছে তোর ছিপ। হেই-এর লাইগ্যা মাছ ওঠতে আছে না।
মায়মন শফির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
শফি বলে—পোড়াইয়া নে আগুনে। ঠিক অইয়া যাইব।
শফি ও মায়মুন মাটির হাতায় আগুন নিয়ে বড়শীটা পোড়া দেয়।
তারপর একসঙ্গে সুর করে বলে—
বড়শী পুড়ি, বড়শী পুড়ি,
ট্যারা পড়শীর মোখ পুড়ি,
মাছ ধরমু দুই কুড়ি।।
লোয়ার বড়শী সুতার ডোর
পুঁডি পাবদা, শিং মাগুর।।
বড়শী আমার প্যাদা
ধইরা আনব ভ্যাদা–
ভ্যাদা মাছে ক্যাদা খায়,
পুডি মাছে পান চাবায়।
অ-হো-হো হি-হি-হি-হি!
শফি ও মায়মুন দুজনে হেসে লুটোপুটি। শফি মাটি খুঁড়ে কেঁচো তুলে দেয়। মাছ কেঁচোর টোপ খায় ভাল।
মায়মুন আবার বড়শী নিয়ে বসে।
সন্ধ্যার পর সে শফির মা’র ঘরে যায়।
শফির মা বলে—আমার পানডা ছেইচ্যা দে তো, ময়ম। তুই ভালা ছেঁচতে পারস। শফি পারে না। ও দিলে কোনদিন খর বেশী অয়, আবার কোনদিন চুনা বেশী পড়ে।
প্রশংসায় মায়মুন খুশী হয়। কলাপাতায় জড়ানো পান খুলতে খুলতে মায়মুন বলে—কতটুকু নিমুগো, মামানি?
—আধ খান নে। তয় অডুকে গাল ভরে না। গাল না ভরলে কি পান খাইয়া সুখ আছে? কিন্তু কি করমু আর। গাছের পাতা, হেই-এর যে দাম! হোনলে মাথা ঘোরে। দুইডা পান
একটা পয়সা। আগে এক পয়সায় এক বিড়া পাওয়া যাইত।
মায়মুন ঠনর ঠনর করে পান ছেচতে আরম্ভ করে।
শফির মা আবার বলে—আইজকাইল বেবাক জিনিসই আক্রা। আগে এক টাকায় আধামণ চাউল মিলত। আমার বয়সেই দেখছি। আর অহন বেবাক জিনিসের উপর তন খোদার রহমত উইট্টা গেছে। আগে এক টাকার বাজার কিনলে এক মরদের এক পোঝা অইত আর অহন এক টাকার বাজার আতের তালুতে লইয়া বোম্বাই শহর যাওয়ন যায়।
শফির মা বলেই চলে—তোর মামু একটা ইলশা মাছ আনছিল দুই পয়সা দিয়া কিন্যা। তহন শফি অয় নাই। মফি আমার পেড়ে। এই এত বড় মাছটা। হেইডার একজোড়া আণ্ডা যা অইছিল—এই এক বিঘৎ লমফা। তখন আমার বুক জুইড়্যা ওর ভাই বইনে চাইর জন। কত খুশী অইছিল হেই আণ্ডা দেইখ্যা!