হাসু এবার চুপ করে। মায়মুনের পাতেরটা শেষ হয়ে গেছে। সে আঙুল দিয়ে তখনও চাটছে থালাটা।
জয়গুন বলে—অহন আত ধো। তুই দ্যাখতে আছি বাসন ভাইঙ্গা খাইতে চাস।
মায়মুন লজ্জিত হয়। থালায় পানি ঢেলে সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।
জয়গুন হাসুকে বলে—মাচার উপরতন কালা কাপড়ের গাট্টি নে। ওড়ার ভিতরে একটা টুপি আছে। ওড়া তুই নে, আর নতুন কাসুরে দিয়া আয়।
—আমি পারতাম না মা। হাসু বলে।
–ক্যাঁ।
ঐ দিনের চরকি দিতে যাওয়ার বিপদের কথা হাসু মা-কে বলেনি।
সে বলে—আমি ঈদগায় যাইমু, মা। নামাজের ওকত অইয়া গেছে। তুমি আর কেই বে দিয়া
—আর কারে পাডাই? তুই-ই যাওনের কালে এটটু ঘুইর্যা ওইহান অইয়া দিয়া আয়।
হাসু আর গোপন রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলে সেদিনের সব কথা।
জয়গুন অসহায়ের মত তাকায় ছেলের মুখের দিকে। শেষে বলে—আগে কস নাই ক্যাঁ? এত পয়সার টুপিড়া ফ্যালাইয়া দিমু? তোর মাতায়ও লাগব না।
—কানা মামানীরে দিয়া পাড়াইয়া দ্যাও।
কথাটা জয়গুনের পছন্দ হয়। শফির মা বুড়ো মানুষ। সে নিয়ে গেলে করিম বক্শ লজ্জায় কিছু বলবে না হয়তো। রাখতে পারে। তা ছাড়া ঈদের দিন। খুশীর দিনে সে হয়ত রাগ করবে না।
হাসু গাঁটরি খোলে। বাপের কিশতি টুপিটা বের করে মাথায় দেয়। টুপিটা অনেক বড় হয়েছে। কান পর্যন্ত ডুবে যায় টুপির মধ্যে।
জয়গুন হাসুর দিকে এক নজর চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে আর তাকাতে পারে না।
হাসু গামছাটা কাঁধে ফেলে কোষায় চড়ে। শফির মা এবং শফিও ওঠে কোষায়। হাসকে ঈদগার রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে শফির মা শফিকে নিয়ে করিম বকশের বাড়ীতে যাবে। এখন যাওয়াই ভালো। করিম বক্শ এখন বাড়ীতে নেই। নামাজ পড়তে গিয়েছে নিশ্চয়ই।
শফির মা টুপিটা দিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসে।
জয়গুন খুটে খুটে জিজ্ঞেস করে কাসুর কথা।
—টুপিডা ঠিক অইল নি মাতায়?
—হ, টুপিডা মাথায় দেওনে এমন সেদর দেহাইল কাসুরে! কি কইমু তোমারে—যেন একটা পরীর বাচ্চা!
শফির মা আবার বলে—সময় বুইঝা গেছিলাম গো। করিম বকশা বাড়ীতে আছিল না। নামাজ পড়তে গেছিল। ওর বউরে তালিম দিয়া আইছি। টুপি যে তুমি দিছ, তা হে কইব না। হে কইব, হে-ই কিন্যা দিছে।
জয়গুন নিশ্চিন্ত হয়। তার ভয় ছিল করিম বক্শ হয়তো ছেলেটাকে মারতে শুরু করবে।
শফির মা বলে—করিম বকশের বউ মানুষ ভালা, খুব হাসিখুশী। আমারে পিঁড়ি দিল বসবার। নিজেই এই এত বড় একটা আস্ত ধলডোগ পান ঘেঁইচ্যা দিল।
জয়গুন বলে—কাসু কিছু কইল?
—উহুঁ। ও আমার মোখের দিগে চাইয়া আছিল! এক্কেরে এতিমের মতন—যেন বাপ-মা নাই।
–তুমি কোলে নিলা না?
—নিলাম। আমার কোলের তন আর কি নামতে চায়! এক্কেরে বুকের লগে মিশ্যা, আছিল। তারপর কত কোস্তাকুস্তি কইর্যা কান্দাইয়া নামাইয়া থুইয়া আইলাম। কি জানি, করিম বক্শ আইলে আবার কি কাণ্ড কইরা ফালায়।
জয়গুন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করবার চেষ্টা করে।
০৯. জয়গুন ও হাসু
জয়গুন ও হাসু আজ সকাল সকালই বেরিয়ে গেছে।
মায়মুন হাঁস দুটো খাঁচা থেকে বের করে পানিতে ছেড়ে আসে।
এবার সে হাঁসের বাচ্চা দুটো বের করে ঘরের মেঝের ওপর ছেড়ে দেয়। নিজেও হাত দুটো মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে চেয়ে থাকে। হলুদ রঙের বাচ্চা দুটো কেমন সুন্দর হাঁটে আর চিপচিপ করে। মায়মুনের আনন্দ হয়।
কাল,মায়মুন বাচ্চা দুটো নিয়ে এসেছে। সোনাচাচী বলে দিয়েছে—আমারে এক আলি আণ্ডা দিবি। আমারে না খাওয়াইলে পাতিহিয়ালে ধইর্যা লইয়া যাইব তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন স্বীকার করে এসেছে। সোনা চাচীকে প্রথম দুই দিনের ডিম সে দেবে। তাকে আগে না খাইয়ে নিজেরা ছোবেও না ডিম।
কাল বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসার পর থেকে মায়মুন এগুলোকে নিয়েই কাটিয়ে দেয়। কখনও মাটির ওপর ছেড়ে দেয়, আবার কখনো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও সে বাচ্চা দুটো কাছ ছাড়া করতে চায় না।
জয়গুন ধমক দিয়ে বলে—সুখে থাকতে ভূতে কিলায়? খাঁচার নিচে রাইখ্যা আয় জলদি। না’ লে চুল ছিঁড়া ফ্যালাইমু ট্রাইন্যা।
মায়ের ধমকের কাছে মায়মুন এতটুকু হয়ে যায়।
বাচ্চাদুটো খাঁচার নিচে রেখেই সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত সজাগ থেকে সে শুনতে পায় বাচ্চা দুটোর ডাক। মাঝে মাঝে চিপচিপ করে ওঠে ওগুলো। শিশুর কান্নায় অসহায় মায়ের মত অবস্থা হয় মায়মুনের।
মা চলে যাওয়ার পর মায়মুনের পূর্ণ স্বাধীনতা। এবার তাকে বলবার কেউ নেই। বাচ্চা দুটোকে খাঁচার মধ্যে রেখে সে উঠানের দক্ষিণ পাশে লাউ মাচার নিচে একটা জায়গা বেছে নেয়। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চৌকা একটা গর্ত করে। পানি ঢেলে সেটাকে ভরে। তারপর বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দেয় তার মধ্যে।
হাঁসের বাচ্চা দুটোর নতুন অভিজ্ঞতা। জন্মাবার পর এই প্রথম তারা পানির পরশ পায়। সেজন্যে পানিতে ছেড়ে দিতেই ভয় পেয়ে ওপরে উঠে আসে। মায়মুন ভাবে—দু’দিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বড় হাঁসের মতই সঁতরাবে তখন।
মায়মুন গতটার চারদিকে কতগুলো লম্বা পাটখড়ি পুঁতে দেয়। এমনি ভাবে লাউ মাচার। সমান উঁচু করে সে একটা বেড়া বানিয়ে ফেলে। চিল বা বাজ ছো মেরে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যে এ সতর্কতা।
মায়মুন বাড়ীর চারপাশ ঘুরে ছোট বড় নানা রকমের শামুক কুড়িয়ে আনে। দা দিয়ে সেগুলোর খোসা ছাড়ায়। তারপর কুচি কুচি করে কাটতে কাটতে গান গায়–