—হুঁ। জয়গুন সায় দেয়। সে-ও সেদিন গাড়ীতে শুনেছে, দেশ স্বাধীন হবে। ভাত-কাপড় সস্তা হবে। কেউ না খেয়ে মরবে না।
জয়গুনের সুখের স্বপ্ন আজ সফল হলো। সত্যি সত্যি স্বাধীনতা এল আজ।
হাসু বলে—টাউনে আইজ বেবাক বাড়ীতে নিশান ওড়তে আছে, মা। কি সোন্দর বড় বড় নিশান! তুমি একটা বানাইয়া দ্যাও, মা।
জয়গুন হাতের নিশানটা দেখিয়ে বলে—এই যে আছে একটা। আর দিয়া কি অইব?
—এইড়া যে এক্কেরেই ছোড়। গাছের ডাইলে বাইন্দা উপরে তুলতাম, মা। গেরামের বেবাক মাইনষে দ্যাখতে পাইব। টাউনে কত বড় বড় নিশান ওড়তে আছে আইজ!
জয়গুন ঘরে যায়। একটা গাঁটরি নামায় মাচার ওপর থেকে। লাল কাপড়ের একটা টুকরো বের করে হাসুকে দেখায়।
উহুঁ, রাঙ্গায় অইব না, মা। এই রহম কচুয়া অওয়ন চাই। হাতের নিশানটা দেখিয়ে প্রতিবাদ করে হাসু।
—ক্যাঁ? রাঙ্গায় দোষ কি? কী সোন্দর খুনী রঙ! মীরপুরের শাহ সাবের দরগায় দেইক্যা আইলাম লাল নিশান।
—টাউনের এক বাড়ীতেও রাঙ্গা নিশান দ্যাখলাম না। বেবাক এই রহম কচুয়া।
আসমানী রঙ্গে অইব?
—উহুঁ, কইলাম যে এই রঙ। তোর লাইগ্যা এই রঙ বানাইলে পারি অহনে। জয়গুন রাগ করে। সে আর একটা গাঁটরির জন্যে উঠতেই হাসু খুশী হয়।
গাঁটরি খোলে জয়গুন। পুরাতন কাপড়ের গাঁটরি। কালিঝুলি মেখে বিশ্রী হয়ে গেছে টরিটা। খুলতে খুলতে তার হাত অবশ হয়ে আসে। বুকের ভেতর স্পন্দন বেড়ে যায় অসম্ভব রকম। জীর্ণ পুরাতন কাপড় ভাজ করে করে সাজান। জয়গুনের বিগত জীবনের অনেক কাহিনী কাপড়গুলোর মধ্যে পুঞ্জীভূত। ভাঁজ খুলতে খুলতে তার স্মৃতির ভাঁজও খুলে যায়। এই টুপিটা তার প্রথম স্বামীর—হাসুর বাপের। ঢোলা পাঞ্জাবীটাও তার। জয়গুনের চোখে ভাসে, কিশতি টুপি মাথায় পাঞ্জাবী গায়ে জবর মুনশীর চেহারাখানা।…এই বোম্বাই শাড়ীটা তার প্রথম বিয়ের। ঘোমটা-টানা বধু জীবনের সুমধুর স্মৃতি এখন শুধু ব্যথাই দেয়।…এই ছোট্ট জামাটা কাসুর। এই জামা আর কানটুপিটা ছোট খুকীর।
জয়গুনের চোখ আর বাধ মানে না। চোখের পানিতে গঁাটরির কাপড়গুলো ভিজে ওঠে।
ছোট খুকী!
তখন দুর্ভিক্ষ সবে দেখা দিয়েছে। দুর্নামের ভয়ে স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন তখনও ঘরের বার হয়নি। খেতে না পাওয়ায় তার বুকে দুধ ছিল না। দুধের শিশু দুধ না পেয়ে শুকনো পাটখড়ির মত হয়েছিল। শেষে ধুকতে ধুকতে একদিন মারা গেল। তাকে কবর দিতে কাফনের কাপড় জোটেনি। এই বোম্বাই শাড়ীটার অর্ধেক দিয়ে কাফন পরিয়ে যখন কবরে নামান হয় তখন জয়গুন বিলাপ করতে করতে বলেছিল—”আইজ তোরে বউ সাজাইয়া দিলাম।”
জয়গুন আর ভাবতে পারে না। একমাত্র সবুজ বোম্বাই শাড়ীটার অবশিষ্ট পাটটা হাসুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে কাপড়গুলোর মধ্যে মুখ লুকায়।
হাসু ও মায়মুন অবাক হয়ে চেয়েছিল মা-র দিকে। তারা কিছু বুঝতে না পেরে শাড়ীর পাটটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।
মায়মুন সুঁই নিয়ে আসে। সাদা কাপড়ের চাঁদ ও তারা কেটে নিশানের মাঝে জুড়ে দেয়।
বেশ সুন্দর নিশান হয়েছে। ঠিক সায়েব বাড়ীর নিশানটার মত। মায়মুন উৎফুল্ল হয়। হাসুর চোখে-মুখে হাসি ফোটে।
জয়গুন যখন বাইরে আসে, তখন হাসু আম গাছে উঠে নিশানটা বেঁধে দিয়েছে। মায়মুন ও শফি চেয়ে আছে ওপর দিকে। গাছের থেকে হাসু ডাকে—মায়মুন! শফি! আমি যা কই আমার লগে লগে আওয়াজ করবি, কেমন?
শফি বলে—কি কইমু?
—পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!
হাসুর সাথে গলা মিলিয়ে শফি ও মায়মুন আওয়াজ তোলে। জয়গানের মনে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে কথাগুলো।
জয়গুন নিশানটার দিকে তাকায়। সবুজ নিশান নতুন জীবনের আভাস দিয়ে যায়। মনে জাগে বাঁচবার আশা।
০৭. চারদিকে আনন্দকোলাহল
চারদিকে আনন্দকোলাহল। মায়মুন ডাকে—মা, চান ওঠছে বুঝিন, ঈদের চান।
মায়মন দৌড়ে যায় বাড়ীর পশ্চিম দিকে। শফি এসে দাঁড়ায় এর পাশে। পশ্চিম দিগন্তের রঙিন মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ওরা তন্ন তন্ন করে খোঁজে চাদ। জয়ন এসে যোগ দেয়।
মায়মুন বলে—কই মা?
—অই সাঁকুয়া তারাডার কাছ দিয়া দ্যাখ। ওডার নিচে দিয়াই দ্যাহা যায় হগল বচ্ছর।
—অই, ঐ যে দ্যাহা গেছে, ঐ ঐ ঐ! শহি লাফিয়ে ওঠে আনন্দে, মায়মনকে টেনে আঙুল দিয়ে দেখায়—ঐ যে তারাডার একটু নিচে। কালা মেঘড়ার পাশে।
মায়মুন দেখতে পেয়ে আনন্দে হাত তালি দেয়। জয়গুন এখনও দেখতে পায়নি। সে বলে—আমাগ কি হেই দিন আছে! তোগ নতুন চউখ। তোর দ্যাখতে পাবি।
—তুমি অহনও দ্যাহ নাই মা! মায়মুন এবার মাকে দেখাতে চেষ্টা করে। জয়গুন দেখতে পায় অনেক পরে। ভক্তিতে সে মাথা নোয়ায়, দু’হাত তুলে মোনাজাত পড়ে।
—এক্কেরে কাচির মতন চিকন এইবারের চান। সিদা অইয়া ওঠছে। আর হগল বচ্ছরের মতন কাইত অইয়া ওড়ে নাই। মোনাজাত সেরে বলে জয়গুন।
চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে গেলে জয়গুন আবার বলে—চুল, ইফতার খুলি গিয়া।
শফির মার ঘরের কাছে যেতে সে ডাকে—চান দেখলিনি, হাসুর মা?
—হ বইন। দ্যাখলাম। বড় ছোড এইবারের চান।
তোরাই দ্যাখ বইন, তোগ চইখ দিছে খোদায়। আমার একটা চউখ, হেইডাও বুঝিন বুইজ্যা গেল।
শফির মা নিশ্বাস ছাড়ে। এমনিতেই সে লবেজান। তার ওপর রোজা রেখে সে বিকালের দিকে খুবই কাহিল হয়ে যায়। সে আবার বলে—চাইর-পাঁচদিন পরে ছাড়া আমি দ্যাকতে পারমু না। চান্ডা সিয়ানা অউক। আ-গো হাসুর মা,—এইবার কোন মুহি কাইত অইয়া ওঠছে গো চান? দহিণমুহি?
—এইবারে সোজাসুজিই ওঠছে বইন। ব্যাকা-ত্যাড়া ওড়ে নাই। লক্ষণ ভালা, না?