—কি মিয়া, কাছিম নাহি? একজন জিজ্ঞেস করে।
—আর কইও না মিয়া। আইজ যাত্রাড়াই খারাপ।
—যাত্রা খারাপ! ক্যাঁ? বউর মোখ দেইক্যা যাত্রা কর নাই মিয়া?
হারুন ও কাসু দু’জনেই উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। হারুন নিজের মাথা থেকে মাথলাটা। কাসুকে দিয়ে বলে—ঘাম দিছেরে, ইস! মাথলাডা মাথায় দে, রউদ লাগব না।
আরো কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে যখন আর মাছের সাড়া পাওয়া যায় না, তখন করিম বক্শ বলে—কি জানি এইরম আইতাছে ক্যান। তোরা কাপড় উড়া কইর্যা পিন্দা নে, দেহি কি অয়।
করিম বক্শ নিজেও গামছা পরে লুঙ্গি ছাড়ে। লুঙ্গির দিক পালটিয়ে নিয়ে আবার পরে।
এবার করিম বক্শ এক চাক গজার মাছের পোনার পেছনে লাগে। কিন্তু গজারটা খুবই চালাক। পোনার কাছাকাছিও ঘেঁষে না। মাছটা বড়ই হবে খুব, করিম বক্শ অনুমান করতে। পারে। পোনাগুলিও বড় হয়েছে। অনেকক্ষণ পরে পরে এক সঙ্গে ভেসে ওঠে। এক জায়গায় থাকলেও কথা ছিল। এই এখানে দেখা যায়, তারপর আর নেই। কোথায় গেল? কোথায় গেল? করিম বক্শ এদিক-ওদিক তাকায়। কিছুক্ষণ পরে ভুস করে ভেসে ওঠে। করিম বক্শ মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। হারুন আস্তে আস্তে অনুসরণ করে।
পোনাগুলি খেতের পর খেত পার হয়ে চলেছে। ঘোলাপানি ছেড়ে আসে কালো পানিতে। করিম বক্শ তবুও হাল ছাড়ে না।
এবার একটা জলা খেত পার হয়ে পোনাগুলি ধানখেতে ঢোকে। করিম বক্শ কেঁচটা রেখে যুতি হাতে নিয়ে আবার মনোযোগ দেয়। পেছনে হাত দেখিয়ে নৌকার গতি মন্থর করার নির্দেশ দেয়। নিজেও সে নুয়ে এক হাতে ধানগাছের গোছা ধরে নৌকার গতিরোধ করে।
কাসু!
হাসুর ডাক। করিম বক্শ চমকে ওঠে। চেয়ে দেখে সে জয়গুনের বাড়ীর কাছাকাছি এসে পড়েছে।
জয়গুন, মায়মুন ও হাসু দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে, এদিকে জয়গুন এখন গাছের আড়ালে চলে গেছে।
কাসু ডাক শুনে দাঁড়িয়েছিল। করিম বক্শ বলে—ব’ হারামজাদা। বইয়া পড়! পইড়া যাবি।
তারপর হারুনের কাছ থেকে লগি নিয়ে জোর ঠেলায় সে নৌকা ছুটায় বাড়ীর দিকে।
জয়গুন চেয়ে থাকে যতক্ষণ নৌকাটা দেখা যায়। কাসুকে তিন বছরের রেখে সে এসেছিল। এখন সে বড় হয়েছে। কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু দূর থেকে মুখখানা আদৌ দেখা গেল না। এখন বড় হয়ে সে মুখখানা কেমন হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও মনে মনে তা গড়তে পারে না জয়গুন।
০৬. হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি
১৫ই আগষ্ট শুক্রবার, ১৯৪৭ সাল।
হাসু মা-কে মোড়ল পাড়ায় নামিয়ে দিয়ে রেল-রাস্তার পাশে আসে। রোজ সেখানে কোষা ডুবিয়ে রেখে সে কাজে যায়।
রাস্তায় উঠেই সে চমকে ওঠে। চারদিক থেকে চিৎকারের ধ্বনি শোনা যায়। হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি শুরু হল না ত!
রেল-রাস্তা ধরে সে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। মারামারি বাধলে কোন কাজই হবে না আজ। গত বছর এমন দিনে মারামারি বেধেছিল। পনেরো দিন সে ঘরের বার হতে পারেনি। তিনদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে।
একটা গাড়ী আসছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। ইঞ্জিনের সামনে একটা নিশান পতপত করছে। বাতাসে। সবুজ রঙের বড় নিশান। মাঝে চাঁদ ও তারা।
গাড়ীর মাঝেও চিৎকার। চারদিকের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠেছে। গাড়ীটা কাছাকাছি আসতে স্পষ্ট বোঝা যায়—
আজাদ পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!
কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!
হাসুর গা রোমাঞ্চিত হয় আনন্দে। সে চেয়ে থাকে। গাড়ীর প্রত্যেকটি লোক আনন্দ-চঞ্চল। অনেকের হাতেই নিশান। বাইরে মুখ বাড়িয়ে নিশান নেড়ে তারা চিক্কার করছে। প্রত্যেক কামরায় ঐ একই আওয়াজ।
হাসু হাত উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে আওয়াজ তোলে ঐ সাথে।
মানুষের বিরাট মিছিল চলছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হিন্দু-মুসলমান ছেলে বুড়ো—সবাই আছে মিছিলে।
হাসু দাঁড়িয়ে দেখছিল। মিছিল সে বহু দেখেছে। কিন্তু এরকম আর দেখেনি। একজন কাগজের একটা নিশান ওর হাতে দিয়ে দাড় করিয়ে দেয় লাইনে। হাসু মিছিলের সাথে মিশে যায়। কাজের কথা তার মনেই হয় না।
মিছিল শহরের সমস্ত রাস্তা ঘোরে। চিৎকার করে জানায় স্বাধীনতার বার্তা।
মিছিল ভাঙে দেড়টায়। হাসু তাড়াতাড়ি স্টেশনে আসে। মেল স্টীমার এখনও আসেনি। হাসুর ভাগ্য ভালো। আর দিন আসে একটার মধ্যেই।
তিনটার সময় মেল আসে। জাহাজের সামনে ঠিক ছাদের ওপর উড়ছে সবুজ নিশান। জাহাজের ডেকে লোক ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। ছাদেও উঠেছে অনেক লোক, সেখান থেকে আওয়াজ ওঠে–
পাকিস্তান জিন্দাবাদ!
কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!
পাড়ের থেকে একদল তাদের ধ্বনির প্রতিধ্বনি করে। জাহাজখানা যেন কেঁপে ওঠে। সমস্ত মিলে একটা নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয় হাসুর মনে।
দুটো মোট বয়ে আজ দশ আনা পায় হাসু। অন্য দিন দর কষাকষি হয়। তিন আনা বড় জোর চার আনার বেশী মোট পিছু দিতে চায় না। কিন্তু আজ আর পয়সার দিকে যেন খেয়াল নেই কারো।
আজ আর কাজ করবে না হাসু।
পথে আসতে আসতে সে দেখে, শহরের প্রত্যেক বাড়ীতে নিশান উড়ছে বড় বড়। সে তার হাতের কাগজের নিশানটার দিকে চায়, আবার চায় দুই পাশে। ডানে হিন্দু পাড়া, বাঁয়ে মুসলমান পাড়া। সব বাড়ীতেই আজ সবুজ নিশান।
হাসু বাড়ী আসে। চিৎকার করে সে গলা ভেঙেছে আজ। ভাঙা গলায় সে সমস্ত দিনের কথা বলে যায় মা-র কাছে। জয়গুন হাসুর হাত থেকে নিশানটা নিয়ে দেখে আর শুনে যায়। হাসুর কথা এক মনে।
হাসু বলে—আর আমাগ কষ্ট অইব না, কেমুন গো, মা? মাইনষে কওয়াকওয়ি করতে আছে ঘাডে পথে। দ্যাশ স্বাদীন অইল। এইবার চাউল হস্তা আইব। মানুষের আর দুখ থাকব না।