বাবা দীর্ঘসময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যাকে বলে বাক্যহারা। মুনিয়া অস্বস্তি নিয়ে একবার মার মুখের দিকে একবার বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বাবা বললেন, দেখি এক গ্লাস পানি। মুনিয়া পানি আনতে গেল। তার ফিরে আসতে বেশ সময় লাগল। এই সময়টুক বাবা চুপচাপ রইলেন। বোধহয় কি বলবেন, গুছিয়ে নিচ্ছেন।
রঞ্জ!
জ্বি।
আমার অনেকদিন থেকেই মনে সন্দেহ তুমি মানসিক দিক দিয়ে ঠিক স্টেবল নও। আজ নিশ্চিত হয়েছি।
ও।
ইনসেনিটি এক ধরনের অসুখ যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
আমি হাসির একটা ভঙ্গি করলাম। বাবা হতভম্ব হয়ে বললেন, হাসছ কেন? চুপ করে থাকবে না। বল কেন হাসছ?
মুনিয়া বলল, বাবা, তুমি বেশি রেগে যাচ্ছ। মা, মিটিংটা আজ থাক।
বাবা বললেন, না আমার কথা শেষ হয়নি। এই বদছেলে সাদা চামড়ার এক মেয়ে বিয়ে করে ধরাকে সরা দেখছে। ওকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বল। সে যেন কালই তার বৌয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে বিদেয় হয়।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ফিরে এলাম। রূপা বলল, কি ব্যাপার তোমাদের কিসের মিটিং?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তেমন কিছু না।
কোন সমস্যা হয়েছে?
না।
সমস্যা হলে আমাকে বলতে পার। আমি যেহেতু তোমাদের পরিবারের কোন সদস্য না, আমি তোমাদের সমস্যা অবজেকটিভলি দেখতে পারব।
আমি সফিকের বই হাতে নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। রূপা বলল, বইটা রাখ তো। আমার দিকে তাকাও।
আমি তাকালাম।
রূপা বলল, বাবুর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। সে বলল, তুমি নাকি একটা খুন করতে চাও? এ পারফেক্ট মার্ডার। সত্যি?
আমি জবাব দিলাম না।
রূপা বলল, কাকে খুন করতে চাও, আমাকে?
আমি চুপ করে রইলাম।
আপত্তি না থাকলে বলতে পার। আমরা দুজন ব্যাপারটা নিয়ে ডিসকাস করতে পারি। মানুষ হিসেবে তুমি বেশ অদ্ভুত। এই জন্যেই তোমাকে আমার এত পছন্দ। তোমাকে যে আমি প্রচণ্ড রকম ভালবাসি সেটা কি তুমি জান?
না।
তুমি আসলে কিন্তু জান। শুধু মুখে বলছ না। তুমিও আমাকে প্রচণ্ড রকম। ভালবাস, তবে ভালবেসে সুখ পাচ্ছ না। তাই না?
আমি চুপ করেই রইলাম। রূপা বলল, সত্যিকার ভালবাসার একটা বড় লক্ষণ। কি জান? ভালবেসে সুখ পাওয়া যায় না, কখনো না। আমি সারাক্ষণ তোমার পাশে থাকলেও তোমার মনে হবে–নেই নেই। পাশে কেউ নেই। আর তখনি ভালবাসার মানুষকে খুন করে ফেলার ইচ্ছা হয়।
আলোচনা অগ্রসর হল না, লাবণ্য এসে ঢুকল। তার কোলে ছোট্ট বালিশ। রূপা বলল, কি খবর লাবণ্য?
লাবণ্য গম্ভীর গলায় বলল, তোমাদের বিছানায় কি জায়গা আছে?
কেন বল তো?
আমি তোমাদের সঙ্গে ঘুমুব।
প্রচুর জায়গা আছে লাবণ্য, প্রচুর জায়গা।
আমি ঘুমিয়ে পড়লে মা যদি নিতে আসে তাহলে কিন্তু মাকে নিষেধ করবে।
অবশ্যই নিষেধ করব।
লাবণ্য বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুনিয়া উপস্থিত হল। সে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছে। রূপা বলল, মেয়েকে তো দেয়া যাবে না।
দেয়া যাবে না মানে?
ও ঘুমুতে যাবার আগে বলে গেছে ওকে যেন তোমার হাতে তুলে দেয়া না হয়। আমি ওকে কথা দিয়েছি।
রাতে ঘুম ভাঙ্গলে কাঁদবে।
কাঁদলে তোমার কাছে দিয়ে আসব। এখন তুমি একে নিতে পারবে না।
আমি আমার মেয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। তুমি কি বলছ?
আজ রাতে পারবে না। অসম্ভব।
সম্ভব অসম্ভব তুমি আমাকে শেখাতে এসো না।
মুনিয়া তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বলল, ঘুমুতে আস।
আমি বললাম, তুমি ঘুমাও। আমি একটু পরে আসছি। আমি সফিকের উপন্যাস নিয়ে বসলাম।
উপন্যাসটা গত দশদিন ধরে পড়ার চেষ্টা করছি। কয়েক পাতা পড়ার পরই বাধা পড়ে, আবার গোড়া থেকে শুরু করি। প্রথম সাত পাতা আমার দশবার পড়া হয়েছে। এতে মজার একটা ব্যাপার হয়েছে, কোন্ লাইনের পর কোন্ লাইন আমার জানা হয়ে গেছে। একটা পরিচিত গান শুনতে যেমন ভালো লাগে, পরিচিত উপন্যাস পড়তেও দেখি তেমুনি আনন্দ।
রূপা বলল, সত্তর পৃষ্ঠার একটা বই শেষ করতে তোমার এতোদিন লাগছে?
আমি বললাম, বইটা মুখস্ত করার চেষ্টা করছি।
ও আচ্ছা।
রূপা বিছানায় শুতে শুতে বলল, সফিক কি কি তোমার খুব ভালো বন্ধু?
একসময় ছিলো, এখন না।
তোমার বন্ধু বান্ধব তেমন নেই, তাই না?
কিছু কিছু আছে।
নাম বলো তো।
আমি চুপ করে গেলাম। পড়ার মাঝখানে বাধা পড়েছে। আবার গোড়া থেকে পড়া শুরু করা দরকার। ঠিক মন বসাতে পারছি না। রূপা চুল আঁচড়াচ্ছে। বার বার ঐদিকে চোখ চলে যাচ্ছে।
রূপা বলল, চা খাবে?
না।
রূপা বলল, মনে হচ্ছে উপন্যাসটা আবার গোড়া থেকে শুরু করেছে।
হুঁ।
মুখস্ত হয়েছে খানিকটা?
এখনো না। লিখে লিখে প্র্যাকটিস করো। তাড়াতাড়ি হবে।
উপন্যাসটা খুব সুবিধার লাগছে না। নায়ক কোন কাজকর্ম করে না। ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায়। কখনো সাইকেলে, কখনো পায়ে হেঁটে। মনে হচ্ছে তার হাঁটাতেই আনন্দ। ঝা ঝা দুপুরে শুধু হাঁটে। মাঝে মাঝে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ সেই বাড়ির বারান্দায় একজন রূপবতী তরুণীকে দেখা যায়। তাদের মধ্যে কোন কথা হয় না। দেখা হল–এই একমাত্র আনন্দ। রূপবতী তরুণীর যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে রূপার খুব মিল। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। মিল আরেকটু কম থাকলে ভাল হত। বাঙালী মেয়ের নীলবর্ণ চোখ খুব বিশ্বাসযোগ্যও নয়।
বই বন্ধ করে আমি বারান্দায় এসে দেখি অনিদ্রারোগে আক্রান্ত আমার জাজ সাহেব বাবা ইজিচেয়ারে বসে আছেন। বাবার ঘর থেকে ইজিচেয়ার আবার ট্রান্সফার হয়েছে বারান্দায়। বাবার হাতে চায়ের কাপ। তিনি নিঃশব্দে চা খাচ্ছেন। গভীর রাতের এই চা তিনি নিজে বানান। তার বানানো চা একদিন খেয়ে দেখতে হয়। তাকে কি বলব, বাবা এক কাপ চা বানিয়ে দাও? যদি বলি তিনি কিভাবে রিএক্ট করবেন?