- বইয়ের নামঃ নৃপতি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নৃপতি – প্রথম দৃশ্য
প্রথম দৃশ্য
[অন্ধকার মঞ্চ। বেদীর মত একটি স্থান। কেউ একজন গর্বিত ভঙ্গিতে বসে আছে সেখানে। মঞ্চ ক্রমে ক্রমে আলোকিত হচ্ছে। ভারী ও গম্ভীর গলায় নেপথ্য থেকে কেউ একজন কথা বলবে।]
নেপথ্য কণ্ঠ: মহিম গড়ের মহামান্য রাজা প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্যে পথে নেমেছিলেন। সন্ধ্যার আগেই তার রাজপ্রাসাদে ফেরার কথা তিনি ফিরলেন না। পথ হারিয়ে ভূষণ্ডি মাঠে বসে রইলেন। রাত বাড়তে লাগলো। আমাদের আজকের গল্প মহিম গড়ের নৃপতির গল্প। গল্প শুরু করছি এইভাবে– এক দেশে এক রাজা ছিল।
[কয়েকজন ছেলে ও দুটি মেয়ে সমবেত কণ্ঠে গাইতে থাকবে। সম্মিলিত কণ্ঠের বিলম্বিত সুরের গান ক্রমে উচ্চগ্রামে উঠবে। দেখা যাবে মঞ্চ আলোকিত হচ্ছে।]
একদেশে এক রাজা ছিল।
হাতীশালে হাতী ছিল।
ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল।
টাকশালেতে টাকা ছিল।
একদেশে এক রাজা ছিল।
একদেশে এক রাজা ছিল।
[মঞ্চ আলোকিত। উপবিষ্ট রাজাকে দেখা যাচ্ছে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে আছেন। মঞ্চের অন্য প্রান্ত থেকে একজন বেরিয়ে এসে বেদীতে উপবিষ্ট রাজাকে অবাক হয়ে দেখবে।]
[প্রায় অন্ধকার মঞ্চে প্রবেশ করছে চোর। তার গায়ে কাঁথা, এক হাতে একটি পুটলি। অন্য হাতে বিড়ি। হাতে কিছু থাকবে না কিন্তু বিড়ি টেনে টেনে আসছে এমন একটি ভঙ্গি করবে। হঠাৎ সে রাজাকে দেখে থমকে দাঁড়াবে। দু’পা পিছিয়ে আসবে।]
রাজা : তোমার নাম, তোমার পরিচয়?
প্রজা : হুজুর আমারে জিগাইতেছেন? আমার নাম হইল গিয়া….
রাজা : তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
প্রজা : আপনেরে চিনুম না! কন কি আপনে? হে-হে-হে-।
রাজা :তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি। আমাকে চিনতে পেরেও কুর্নিশ করনি! আবার দাঁত বের করে হাসছ। রাজার সামনে হাসতে হলে তার অনুমতি লাগে তাও জান না?
প্রজা : আপনেরে চিনতে পারি নাই। আল্লাহর কসম হুজুর এট্টুও চিনি নাই।
বড় আন্ধাইর।
রাজা : চিনতে পারনি।
প্রজা : জ্বে না। আন্ধাইরে রাজার চেহারা যেমুন, চোরের চেহারাও তেমুন।
রাজা : তুমি কি কর?
প্রজা : রাজা সাব, আমি একজন চোর।
রাজা : [স্তম্ভিত] চোর?
প্রজা : জে হুজুর। আমার বাপও চোর ছিল আর হুজুর আমার দাদা…
রাজা : যাও যাও। আমার সামনে থেকে চলে যাও। একজন চোর কথা বলছে আমার সঙ্গে! [চোর পায়ে পায়ে সরে যাচ্ছে। রাজা হঠাৎ মত বদলাবেন] এই চোর।
চোর : রাজা সাব ডাকলেন?
রাজা : আমি ভেবে দেখলাম চোর হলেও তুমি আমার প্রজা। এবং প্রজা হচ্ছে সন্তানতুল্য। কাজেই তুমি আমার সন্তান। ঠিক বলেছি কিনা বল?
চোর : এক্কবারে খাঁটি কথা কইছেন। হুজুর আপনে আমার পিতা।
রাজা : তুমি আমাকে মহিম গড়ের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে পারবে?
চোর : তা পারুম কিন্তু হুজুর আপনি এই মাঠের মইধ্যে ক্যামনে আইলেন?
আপনের সৈন্য সামন্ত কই? মুকুট কই? হাতী ঘোড়া কই? মন্ত্রী সাবরা কই?
রাজা : তোমার সঙ্গে খোশ-গল্প করার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
চোর : হুজুরের কাছে অস্ত্রপাতি কিছু আছে? তলোয়ার, ছুরি, চাকু?
রাজা : প্রজারা আমার সন্তানের মত। ওদের কাছে আমি নিরস্ত্র অবস্থায় যেতে পছন্দ করি। [চোর তার ঝুলি হাতড়ে ভয়াল-দর্শন একটা ছোরা বের করবে।] আমাকে ঠিকমত রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দিলে প্রচুর ইনাম পাবে। তোমার হাতে ওটা কি? [চোর ছোরার ধার পরীক্ষা করবে] হাতের এই জিনিসটা ফেলে দাও।
চোর : [হেসে উঠবে]
রাজা : হাসছ কেন?
চোর : জিনিসটার মইধ্যে জবর ধার। আর এইটা বার করছি হুজুর আপনার জইন্যে। সেরেফ আপনার জইন্যে।
রাজা : [রাজা স্তম্ভিত ও ভীত।] আমার জন্যে?
চোর : জ্বে হুজুর। যদি কেউ আপনেরে আক্রমণ করে। দুষ্টু লোকের তো হুজুর দেশে অভাব নাই। দেশ ভর্তি দুষ্টু লোক- এই জইন্যে এই জিনিস।
রাজা : ও তাই বল। ওটা তাহলে সঙ্গেই রাখ–ফেলার প্রয়োজন দেখি না। তোমার নাম কি যেন বলছিলে?
চোর : মজনু। মাইনসে ডাকে মজনু চোরা।
রাজা : তোমাকে কিন্তু ভদ্রলোকের মতই দেখাচ্ছে, চোর বলে মনে হচ্ছে না।
চোর : [হেসে উঠবে]
রাজা : হাসছ কেন?
চোর : বেয়াদবী মাপ করেন হুজুর। এই কান ধরলাম আর যদি হাসি।
রাজা : না না ঠিক আছে। হাসতে ইচ্ছে হলে হাসবে। আমার অনুমতি লাগবে না।
চোর : হুজুরের দয়ার শরীর।
রাজা : রাজপ্রাসাদে পৌঁছেই তোমার জন্যে জায়গীরের ব্যবস্থা করব। পঞ্চাশ একর লাখেরাজ জমি। এতে চলবে?
চোর : হুজুরের অসীম দয়া।
রাজা : ঠিক আছে, ওটাকে একশ একর করে দিচ্ছি। একশ বিঘা লাখেরাজ জমি।
চোর : গোস্তাকী মাপ হয়। হুজুর কিন্তু বিঘার কথা বলেন নাই। হুজুর বলেছিলেন একশ একর।
রাজা : ও আচ্ছা। আমার কাছে বিঘাও যা একরও তা। তোমার যা পছন্দ তাই হবে। একশ একর।
চোর : হুজুর তাহলে চলেন, রওনা দেই। মেলা দূরের পথ।
রাজা : আমার পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। জুতো হারিয়ে গেছে। কি করা যায় বল তো? এ তো একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।
চোর : হুজুর কি আমার পিঠে উঠতে চান?
রাজা : তোমার যদি কষ্ট না হয়। কষ্ট হবে? তোমার শরীরও তো খুব মজবুত মনে হচ্ছে না। অকারণে কষ্ট দিতে চাই না।
চোর :জ্বে না। কোন কষ্ট নাই। উঠেন হুজুর। [রাজা পিঠে চড়বেন] মাবুদে এলাহী, ওজন তো কম না।
রাজা : কষ্ট হচ্ছে?
চোর : না হুজুর। আরাম লাগতাছে। হুজুরের শইলডা মাখনের মত নরম। বড় আরাম হুজুর।
রাজা : আস্তে আস্তে যাবে। কোন তাড়া নেই। ঝাঁকনি দেবে না। আমার ঝাঁকনি সহ্য হয় না।
চোর :জ্বে আইচ্ছা। খুব আস্তে যামু।
রাজা : তোমার যেন কি নাম বললে?
চোর : মজনু।
রাজা : মজনু, বেশ সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। এটা কি বসন্তকাল?
চোর : এইডা হুজুর শীতকাল।
রাজা : না, না, না। শীতকাল হতেই পারে না। আমি ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না?
চোর : জ্বে না হুজুর, আমার সর্দি। [নাক ঝাড়বে]
রাজা : তোমার নামটা যেন কি?
চোর : মজনু।
রাজা : মজনু, তুমি গান জান?
চোর : হাঁপাতে হাঁপাতে জ্বি না হুজুর।
রাজা : আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে মজনু।
মজনু : হুজুর, এট্টু নামেন পিঠ থাইক্যা।
রাজা : কষ্ট হচ্ছে?
মজনু : কোন কষ্ট না, তয় হুজুর দমটা বন্ধ হইয়া আসতাছে। এট্টু নামেন। [রাজা নামবেন। মজনু বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকবে। জামা খুলে সে নিজেকে প্রবল বেগে বাতাস করতে থাকবে। মঞ্চে একজনের পেছনে একজন দল বেঁধে প্রবেশ করবে। তাদের দলপতি এক বৃদ্ধ]
রাজা: ওরা কারা? মজনু, জিজ্ঞেস কর ওরা কারা?
মজনু : [উচ্চস্বরে] তোমরা কে?
বৃদ্ধ : আমরা হেতমপুরের প্রজা।
রাজা : তোমার কোথায় যাও?
মজনু: [উচ্চস্বরে] তোমার কোথায় যাও?
বৃদ্ধ : আমরার পেটে ভাত নাই,
এই কথাটাই– রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
তরুণী : রাজা সাবরে বলতে চাই। আমরার পেটে ভাত নাই শীত পড়ছে আকাশ-পাতাল শীতে কষ্ট পাই।
রাজা : হেতমপুর কতদূর?
সকলে : হেতমপুর-অনেকদূর!
রাজা : এই সামান্য কথা বলবার জন্যে এতদূর থেকে এসেছ?
সকলে : ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট এর উপরে কষ্ট নাই।
বৃদ্ধ : এই কথাটাই রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
মজনু : অত কথা শুনবার সময় রাজা সাবের নাই।
সকলে : কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই।
তরুণী : রাজা সাবরে বলতে চাই। আমরার পেটে ভাত নাই ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট এর উপরে কষ্ট নাই। এই কথাটা রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
সকলে : কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই।
[এই সুরে গান গাইতে গাইতে তারা এগিয়ে যাবে। মজনু পিঠ বাঁকা করে দাঁড়াবে। রাজা চিন্তিত মুখে তার পিঠে চড়বেন। তাঁরা রওনা হবেন।]
[মঞ্চের আলো কমে আসবে। রাজার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। দূর থেকে গম্ভীর গলায় একক কণ্ঠে শোনা যাবে–]
“এক দেশে এক রাজা ছিল
রাজার অনেক সৈন্য ছিল।
ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। …………….।”
নৃপতি – দ্বিতীয় দৃশ্য
দ্বিতীয় দৃশ্য
[অপরূপ বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে রাণী ঢুকছেন। রাণীর পেছনে ফুলের সাজী হাতে দুইজন সহচরী। রাণী ঘুরছেন অস্থির হয়ে। রাণীর পিছনে পিছনে সহচরীরা ঘুরছে।]
রাণী : মহারাজা প্রাসাদে এখানে এসে পৌঁছেন নি?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : এত সময় তো লাগার কথা নয়? আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : সুরশিল্পী আসমত আলী খাঁন সাহেবকে আসতে বলব? গান শুনিয়ে তিনি আপনাকে তুষ্ট করবেন।
রাণী : প্রথম প্রহর পার হয়েছে, আমার খুব অস্থির লাগছে। কিছুতেই মন বসছে না। প্রজাদের দেখতে বেরিয়েছেন। ওদের দেখার কি আছে?
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে আসতে বলি?
রাণী : প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন দেশের অবস্থা ভাল নয়। প্রজারা অসন্তুষ্ট। চারিদিকে অভাব। এই সব বলে বলে তারা মহারাজাকে বিরক্ত করেছে। নয়ত তিনি বের হতেন না। আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে বলি আপনার প্রিয় গান গেয়ে শুনাবার জন্যে। এতে মহারাণীর মন প্রফুল্ল হবে। বলব?
রাণী : না, না। আমার কিছুতেই মন বসছে না। তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না।
২য় সহচরী : চলে যাব?
রাণী : যাও, চলে যাও।
১ম সহচরী : আপনি একা থাকবেন?
রাণী : চলে যেতে বলছি, চলে যাও, কেন কথা বাড়াচ্ছ? আমি একা একা খানিকক্ষণ বাগানে হাঁটব। মহারাজা এসে পৌঁছান মাত্র আমাকে খবর দেবে।
[সহচরী দু’জন চলে যাওয়ার পর ওস্তাদজী ঢুকবেন।]
ওস্তাদজী : মহারাণী, আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাণী : আমি কাউকে স্মরণ করিনি।
ওস্তাদ : ওরা বলছিল আপনার মন বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করবার জন্যে সঙ্গীতের মত আর কিছুই নেই। আপনি চাইলে মালকোষ রাগে…।
রাণী : আমি কিছুই চাই না। আচ্ছা, আপনি বলুন তো প্রজাদের দেখতে যাবার এই খেয়াল মহারাজার কেন হল? কি মানে থাকতে পারে এর?
ওস্তাদ : রাজাদের কিছু অদ্ভুত খেয়াল থাকতে হয়। তা না থাকলে সবাই ওদের সাধারণ মনে করবে। নৃপতিরা অসাধারণ থাকতে পছন্দ করেন।
রাণী : তারে মানে?
ওস্তাদ : দেশ জুড়ে অভাব! ঘরে ঘরে হাহাকার। এর মধ্যে দেখার কিছুই নেই। মন প্রফুল্ল করার মত কোন দৃশ্য নয়। তবে, রাজারা মাঝে মাঝে মানুষের কষ্ট দেখতে ভালবাসেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।
রাণী : এসব আপনি কি বলছেন?
ওস্তাদ : প্রজারা যখন রাজপ্রাসাদের চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াবে, তখন আপনি ছাদে দাঁড়িয়ে তাকাবেন ওদের দিকে। আপনার ভালই লাগবে। দুঃখী মানুষদের দেখতে বড় ভাল লাগে। অন্যের দুঃখকে খুব কাছ থেকে না দেখতে পেলে নিজের সুখ ঠিক বোঝা যায় না মহারাণী।
রাণী : প্রজারা রাজপ্রাসাদ ঘিরে দাঁড়াবে? [ওস্তাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন] কবে?
ওস্তাদ : তা তো বলতে পারব না। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওদের পায়ের শব্দ শুনি। ওরা আসতে শুরু করেছে মহারাণী।
রাণী : আপনি চলে যান আমার সামনে থেকে। [ওস্তাদ কুর্নিশ করে চলে যেতেই রাণী হাততালি দেবেন। সহচরী দু’জন এসে ঢুকবে।] মহারাজার কোন খবর পাওয়া গেছে?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে তোমরা কি কোন পায়ের আওয়াজ পাও?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
[ঠিক তখন নকিবের গলার আওয়াজ।]
নকিব : মহিম গড়ের মহামান্য রাজা, অজাতশত্রু, ভীমবাহু, মহাবল বীরশ্রেষ্ঠ মহারাজা রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছেন।
[সহচরী দু’জন বের হয়ে যাবে, মহারাজার প্রবেশ]।
রাণী : আপনার ফিরতে দেরি দেখে বড় ভয় পেয়েছিলাম।
রাজা : পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক বিশাল মাঠের মাঝখানে বসে বসে আকাশের তারা দেখছিলাম।
রাণী : প্রজাদের অবস্থা কেমন দেখলেন?
রাজা : মাঠের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। ক্রমে ক্রমে চারদিকে অন্ধকার হচ্ছে। চারদিকে পাখি ডাকছে। কি চমৎকার দৃশ্য! মনে বড় আনন্দ হলো রাণী।
রাণী : প্রজাদের তাহলে দেখতে যাননি?
রাজা। : এত চমৎকার বাতাস বইছিল–এত আনন্দ চারদিকে তোমাকে একদিন নিয়ে যাবে সেখানে। দু’জনে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যা হওয়া দেখব। সেই মাঠে আমরা ছোট-খাটো উৎসবের মত করতে পারি।
রাণী : কবে? কবে নিয়ে যাবেন? আমার এক্ষুণি যেতে ইচ্ছা করছে। আমরা কি কাল যেতে পারি?
রাজা : নিশ্চয়ই পারি।
রাণী : প্রজাদের কথা যেসব শুনছি সেসব তাহলে ঠিক নয়। ওরা সুখেই আছে, তাই না মহারাজা?
রাজা : দুঃখ নিয়ে মাতামাতি করা আমার পছন্দ নয়। দুঃখ থাকবেই। সেই দুঃখ থেকে ওদের মন ফিরিয়ে নেব। ওদের জন্যে একটা উৎসব করব।
রাণী : উৎসব?
রাজা : চমৎকার একটি উৎসব। আনন্দ-উল্লাস-গান। আকাশ ভরা থাকবে জোৎস্না। পুরনারীরা হাত ধরাধরি করে নাচবে।
রাণী : চমৎকার। কিন্তু …। শুনছি হাজার হাজার মানুষ রাজপ্রাসাদের দিকে আসছে।
রাজা : কোথায় শুনেছ?
রাণী : সত্যি নয় তাহলে?
রাজা : না, সত্যি নয়। তাছাড়া সত্যি হলে কিছু যায় আসে না। ওদের আসতে দাও। ওরা আসুক, যোগ দিক আমাদের উৎসবে। এ উৎসব শুধু তোমার আমার উৎসব নয়। এ উৎসব আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে নাচবো, সবাই মিলে গাইবো। ফুলে ফুলে রাজ্য ঢেকে দেব। রাণী… ।
রাণী : বলুন!
রাজা : যাও, ফুল-সাজে সেজে আস। আজ আমার মনে বড় আনন্দ। বড় সুখের সময় আজ। তুমি অপরূপ সাজে সেজে দাঁড়াও আমার সামনে। সভাসদদেরও আসতে বল। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করবো।
রাণী : আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি। [প্রস্থান]
[মন্ত্রী প্রবেশ করবেন]
মন্ত্রী : মহারাজা আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাজা : আমি আজ সবাইকে স্মরণ করেছি। আজ আমার মনে গভীর আনন্দ। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু তোমাকে আজ এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?
মন্ত্রী : আমার গায়ের রঙটাই ময়লা মহারাজা।
রাজা : তোমার ঘোর কৃষ্ণবর্ণেও আনন্দের জ্যোতি ছিল। আজ তা দেখছি না।
মন্ত্রী। : হেতমপুর থেকে হাজার হাজার প্রজা এসেছে, তারা আপনার দর্শনপ্রার্থী। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
রাজা : এখন তো আমার কথা বলার সময় নেই মন্ত্রী।
মন্ত্রী : অপেক্ষা করতে বলব?
রাজা : হ্যাঁ, অপেক্ষা করুক। ভূষণ্ডির মাঠে বসে অপেক্ষা করুক। সময় হলেই আমি ওদের দর্শন দেব। কিংবা আমার বার্তা নিয়ে লোক যাবে। সে বার্তা হবে আনন্দের বার্তা। সুখের বার্তা।
মন্ত্রী : এই শীতের রাতে মাঠে বসে থাকবে?
রাজা : (চমকে) এই কি শীতকাল?
মন্ত্রী : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন।]
রাজা : শীত হলেও ভূষণ্ডির মাঠের দৃশ্য বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ আছে। ফুলে সৌরভ আছে। পাখির গান আছে। চারদিকে আনন্দ চিকমিক করছে। ওদের সময় ভালই কাটবে। [নেপথ্য থেকে শোনা যাবে কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই। মহারাজা কান পেতে শুনবেন ও বিরক্ত হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করবেন। মন্ত্রীও যাবেন। গ্রামবাসীর দল কথা বলতে চাই, আমরা কথা বলতে চাই–বলতে বলতে মঞ্চে প্রবেশ করবে। রাজার নকিব এসে দাঁড়াবে। গর্বিত ভঙ্গিতে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই– রাজা সাবের সাথে আমরা কথা বলতে চাই।
নকিব : রাজা সাব ব্যস্ত মানুষ এত সময় নাই।
বৃদ্ধ ঃ টুপিওয়ালা ভাই রাজা সাবের সাথে দুইটা কথা বলতে চাই। সময় আমরার অনেক আছে সময়ের অভাব নাই। [দলের সবার দিকে তাকিয়ে] ওরে তোরা বস। [সবাই বসে পড়বে] [নকিব রেগে গিয়ে একজনকে টেনে তুলে এক চড় বসিয়ে দেবে।]
নকিব : মনে নাই ডর ভয় পা ছড়াইয়া ক্যামনে বয় [সবাই উঠে দাঁড়াবে।]
এই কথাটা মনে রাখন চাই। রাজবাড়ির সামনে কারুর বসার হুকুম নাই। হেতমপুরের বোকার দল, আইন জানা নাই?
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই, কোন জায়গাতে বইসা থাকম্ এইটা জানতে চাই।
নকিব : ভূষণ্ডির মাঠে যাও। জায়গাটা ভাল। ফুলের গন্ধ আছে। পাখির গান আছে। চান্দের আলো ভি আছে। যখন সময় হবে, খবর নিয়ে সেইখানেতে মোদের লোক যাবে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই।
খবরটা একটু যেন তাড়াতাড়ি পাই।
নকিব : রাজা সাবের অত তাড়া নাই।
সকলেঃ কথা বলতে চাই।
[বলতে বলতে ভূষণ্ডির মাঠের দিকে রওনা হবে।]
নৃপতি – তৃতীয় দৃশ্য
তৃতীয় দৃশ্য
[রাজা সিংহাসেন বসে আছেন। চোখ আধ-বোজা। সিংহাসনের পাশে একজন ওস্তাদ দরবারী কানাড়া গাইছেন। দরবারে রাজার মেজাজ আনার জন্যে। ওস্তাদের গলা অদ্ভুত সুন্দর, তিনি গাইছেনও চমৎকার। সরগমের মাঝখানে রাজা হাততালি দিয়ে গান থামিয়ে দেবেন।]
[ওস্তাদ তাকাবেন রাজার দিকে]
রাজা :এটা কি বসন্তকাল?
ওস্তাদ : জ্বিনা।
রাজা : এটা কোন্ কাল?
ওস্তাদ : শীত শুরু হচ্ছে হুজুর।
রাজা : তাই নাকি? কাল রাতে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা বসন্তকাল।
ওস্তাদ : কারো কারো এ রকম ভুল হয় জনাব। শীতকালকে বসন্তকাল ভাবে। এই ভুল অবশ্যি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
রাজা : আমার স্পষ্ট মনে হলো এটা বসন্তকাল। ফুলের গন্ধ পেলাম। মিষ্টি বাতাস বইছিলো। আমি তখন কি ঠিক করলাম জান? ঠিক করলাম একটা বসন্ত উৎসব করব। একটা বসন্ত উৎসব করলে কেমন হয়? আনন্দ-গান উল্লাস।
ওস্তাদ : ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করাই ভাল। এটাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। বসন্ত উৎসব হয়ে বসন্তকালে।
রাজা : ইদানিং তুমি বেশি-বেশি কথা বলছ।
ওস্তাদ : [ চুপ করে থাকবেন]
রাজা : এবং তোমার গলাও খারাপ হয়ে গেছে।
ওস্তাদ : বয়েস হয়ে গেছে।
রাজাঃ দেখি একটা বসন্তের গান শুনি।
ওস্তাদ : শীতের সময় আমি বসন্তের গান গাইতে পারি না।
রাজা : কেন?
ওস্তাদ : নিয়ম নেই।
রাজা : নিয়ম! কার নিয়মঃ
ওস্তাদ : শীতের সময় বসন্তের গান কেউ গাইবে না।
[রাজা হাততালি দিতেই মন্ত্রীর প্রবেশ]
রাজা : আমি একটি বসন্ত উৎসব করতে চাই। [মন্ত্রী তাকিয়ে থাকবে।] বসন্ত উৎসব!
ওস্তাদ : হুজুরের অনুমতি পেলে আমি উঠি।
রাজা : নাচ হবে। গান হবে, আনন্দ-উল্লাস হবে।
ওস্তাদ : প্রজারা কেউ রাজি হবে না। এখন ওদের দুঃসময়। শীত হচ্ছে দুঃখ ও কষ্টের সময়।
মন্ত্রীঃ দুঃখ-কষ্ট থেকে ওদের মন ফেরাবার জন্যেই উৎসব দরকার। উৎসব হবে।
রাজা : বসন্ত উৎসব!
মন্ত্রী : বসন্ত উৎসবই হবে।
রাজাঃ নাচ হবে। গান হবে। আনন্দ-উল্লাস হবে। ফুল দিয়ে আমি রাজ্য ঢেকে দেব।
ওস্তাদ : শীতের সময় ফুল পাওয়া যাবে না।
মন্ত্রী : রাজবাড়ির কারিগর কাগজের ফুল তৈরি করবে। তার সৌরভ হবে আসল ফুলের চেয়ে বেশি, তার বর্ণ হবে…
[ পিঠ বাঁকা করে মজনু চোরা লাঠিতে ভর দিয়ে ঢুকবে।]
রাজা : [চম্কে উঠে] এ কে?
মজনু : হুজুর, আমারে চিনলেন না? কাইল রাইতে আপনেরে পিঠে কইরা আনলাম। আমার নাম মজনু।
রাজা : মজনু, তুমি ভাল আছো?
মজনু : হুজুরের দয়া। পিঠের মইধ্যে এট্টুখানি দরদ। সোজা হইতে পারি না। কিন্তু আছি ভাল।
রাজা : রাতটা খুব আনন্দের ছিল মজনু। বাতাস ছিল মধুর। পাখি ডাকছিলো। মজনু, পাখি ডাকছিলো না?
মজনু : কাউয়া ডাকতেছিল। আর কোন পাখির ডাক শুনি নাই।
রাজা :কিন্তু সেই কাকের ডাকও মধুর ছিল। ছিল না?
মজনু : জ্বে ছিল। কি সুন্দর কা-কা কইরা ডাকলো। বড় মধুর।
রাজা : আমি তোমার উপর খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। মন্ত্রী একে একশ’ বিঘা নিষ্কর জমির ব্যবস্থা করে দিন।
মজনু : হুজুর একরের কথা বলেছিলেন। হুজুরের বোধহয় স্মরণ নাই।
রাজা : একশ’ একর নিষ্কর জমি। শোন মজনু, তোমার উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট।
মজুন : হুজুরের দয়া। হুজুর দয়ার সাগর।
রাজা : এখন তুমি আমার পদচুম্বনেরও সুযোগ পাবে।
মজনু : হুজুর দয়ার মহাসাগর।
রাজা : বৎসরে দু’বার তোমাকে এই সম্মান দেয়া হবে।
মজনু : হুজুর হচ্ছেন দয়ার মহা-মহা-সাগর।
[ রাজা তার পা বাড়িয়ে দেবেন। মজনু পায়ে চুমু খাবে। তার চোখে-মুখে স্বৰ্গীয় ভাব।]
মন্ত্রী : জাহাপনা, বাইরে অনেকেই আপনার পদচুম্বনের জন্যে অপেক্ষা করছে।
রাজাঃ আজ আমার মন উৎফুল্ল। আজ আমি সবাইকে সুখী করতে চাই। ওদের নিয়ে এসো। [মন্ত্রী হাততালি দিতেই ২য় প্রজা এসে ঢুকবে। তারও হাতে লাঠি এবং পিঠ বাঁকা।] এ
মন্ত্রী : একবার মৃগয়াতে আপনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন সে আপনাকে পিঠে করে নিয়ে এসেছিল। এর নাম বশির।
রাজা : বশির, ভাল আছ?
[বশিরের মুখভর্তি হাসি। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। বশির মহানন্দে তাঁর পায়ে চুমু খাবে এবং মজনুর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। মন্ত্রী দ্বিতীয়বার হাততালি দিবেন। ৩য় প্রজা এসে ঢুকবে। তারও পিঠ বাঁকা।]
মন্ত্রী : এ হচ্ছে নিয়ামত। সেও একবার আপনাকে পিঠে করে এনেছিল।
রাজা : ভাল আছ নিয়ামত?
নিয়ামতের মুখে হাসি। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। নিয়ামত পায়ে চুমু খাবে এবং বাকী দু’জনের পাশে দাঁড়াবে।
মন্ত্রীঃ জাহাপনা, অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে।
রাজা : থাকুক। মুখের লালায় আমার পা ভিজে গেছে। আমার গা ঘিন ঘিন করছে। [রাজা হাততালি দিতেই একটা বড় গামলা এনে একজন পানি দিয়ে রাজার পা ধুইয়ে দেবে।]
রাজা : তোমরা কেউ বসন্তের গান জানো? গাও, বসন্তের গান গাও।
[পিঠ-বাকারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]
তিনজনেঃ হুজুর! আমরা গান জানি না।
রাজা : গাইতে বলছি গাও [রাগতস্বরে]
তিনজনেঃ গান কি করে গাইতে হয় জানি না, হুজুর।
[রাজা কড়া চোখে তাকাবেন]
মন্ত্রী : রাজা সাহেব রেগে যাচ্ছেন। তাকে রাগিও না।
[তিনজনে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাছাকাছি চলে আসবে।]
ওস্তাদ : ঠিক আছে, তোমরা আমার সঙ্গে গাও।
[ওস্তাদ গাইবেন। ওরা তাঁর সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে চেষ্টা করবে। আজি এ বসন্তে এই গানটি দেয়া যেতে পারে।]
রাজা : মধু, মধু। মধুময় সংগীত। আমার মন প্রফুল্ল হয়েছে। মন্ত্রী, কেমন লাগল আপনার?
মন্ত্রী : [কাশতে থাকবেন।]
রাজাঃ ওস্তাদ, আপনার কেমন লাগল?
ওস্তাদঃ রাজা-মহারাজাদের কখন কি ভাল লাগে বোঝা মুশকিল।
রাজা : আপনি বলতে চাচ্ছেন ওদের কণ্ঠ মধুময় নয়?
ওস্তাদঃ আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। ওদের গান আপনার ভাল লাগলেই হল।
রাজাঃ আমার ভাল লেগেছে।
বৃদ্ধ : আমরা রাজা সাবের জইন্যে সকাল-বিকাল সইন্ধ্যা তিন বেলা গান গাইতে চাই।
বাকি সবাই : গাইতে চাই। তিন বেলা গান গাইতে চাই।
রাজা : গাইবে, দিনরাত তোমরা মন খুলে গাইবে। তোমাদের জন্যে আমি গান রচনা করব। সেই গান তোমরা ছড়িয়ে দেবে দেশে দেশান্তরে।
তিনজনেঃ দেশে দেশান্তর।
রাজা : পৃথিবীর মানুষেরা জানবে এই মহান নৃপতি শুধু প্রজাবৎসল নৃপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কবি এবং একজন মহান সুরকার।
তিনজনেঃ একজন মহান সুরকার।
রাজাঃ [বিরক্ত হয়ে] এরা বারবার আমার কথার পিঠে কথা বলছে কেন? ওদের ঘাড় ধরে বের করে দিন। [তিনজনেই তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে একজন চিৎ হয়ে পড়ে যাবে।]
নৃপতি – চতুর্থ দৃশ্য
চতুর্থ দৃশ্য
[খোলা মাঠ। শো শো করে শীতের হাওয়া বইছে। তিনটি শিশু গায়ে চট জড়িয়ে বসে বসে শীতে কাঁপছে। বাচ্চাগুলির সঙ্গে বেশ কিছু গ্রামবাসী আছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছ। এদের মধ্যে আছে ওসমান নামের অতি বৃদ্ধ এক ব্যক্তি। কাঁদের নামের এক তরুণ। লতিফা নাম্নী এক তরুণী। মঞ্চের এক কোণায় মাটির মালসায় আগুন। অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আগুন তাপাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ দূরাগত ধ্বনি শোনা যাবে। আনন্দের বাজনা বাজছে ও তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গ্রামবাসীরা উৎকীর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করবে। দেখা যাবে লাঠিতে ভর দিয়ে মজনু আসছে। সে একবারও না থেমে একই গতিতে মঞ্চ অতিক্রম করবে। কথাবার্তা যা হবে চলার মধ্যেই হবে।]
বৃদ্ধ : বড় কষ্ট! বড় কষ্ট! শীত জবর পড়ছে। বুড়া-মরণের শীত পড়ছে।
এই শীতে সব বুড়া শেষ হবে রে। বুড়ার দল সব শেষ।
তরুণ : শেষ হইলেই ভাল। বুড়া দিয়া কি হয়? কিছু না।
তরুণী : এইটা কেমন কথা? ও বুড়ো চাচা, আপনে আগুনের কাছে গিয়া বসেন। হাত দুইটা মেলেন আগুনের উপরে।
বৃদ্ধ : দুই দিকে আগুন জ্বলে রে বেটি। পেটের মইধ্যেও আগুন। খিদার আগুন। সেই আগুনের কষ্ট আরো বেশি।
তরুণ : এক কাজ করেন চাচা মিয়া, হা কইরা এট্টু আগুন খাইয়া ফেলেন। আগুনে আগুনে শান্তি। পেট ঠাণ্ডা হইব। হা হা-হা।
তরুণী : চুপ কর। লজ্জা নাই? কেমন কথা কও?
তরুণ : মজাক করি রে মজাক করি। রাইতটা তো কাটান দেওন লাগব। হাসি-মজাক কইরা রাইত পার করি। ও চাচা মিয়া, গোসা হইছেন?
বৃদ্ধ : [কথা বলবে না]
তরুণ : গোসা কইরেন না চাচা মিয়া। শীতের মইধ্যে মাথার ঠিক থাকে না। একটা কিচ্ছা কন দেখি।
বৃদ্ধ: [চুপ করে থাকে]
অন্য একজন : কন গো, একটা কিচ্ছা কন। কিচ্ছা হুনতে হুনতে রাইতটা পার করি।
বৃদ্ধ : [চুপ]।
সবাই : কনগো কন, একটা কিচ্ছা কন।
বৃদ্ধ : এক দেশে আছিল এক রাজা।
তরুণ : রাজার গল্প বাদ দেন। একটা গরীব মাইনষের গল্প কন দেহি।
বৃদ্ধ : গরীব মাইনষের কোন গস্প হয় না। খামাখা কথা কইও না। গল্পটা হুন মন দিয়া। শুনতে মনে না চায় দূরে গিয়ে বইসা থাক। এক দেশে আছিল এক রাজা। তরুণ উঠে দূরে চলে যায়। সেই রাজার বড় শান শওকত। বেশুমার খানা-খাদ্য।
অন্য একজন : কি খানা-খাদ্য এট্টু কন শুনি।
বৃদ্ধ : কি কমু কও? রাজবাড়ির খানা-খাইদ্যের হিসাব-নিকাশ নাই। সেই রাজার হাতিশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া। লোক-লস্কর, পাইক বরকন্দাজ। কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই।
তরুণী : তবু সুখ নাই? কন কি? ক্যান? সুখ নাই ক্যান?
বৃদ্ধ : রাজা হইল আটকুড়া, তার পুত্রসন্তান নাই।
তরুণী : আহা রে!
বৃদ্ধ : পুত্রসন্তানের কারণে রাজা শুধু বিয়া করে। যেখানে যত সুন্দর কন্যা পায় বিয়া করে। কিন্তু পুত্রসন্তান হয় না। [তরুণ শব্দ করে হেসে উঠবে।]
হাস ক্যান?
তরুণ : আটকুড়া রাজা হইতে মনে চায়।
[সবাই হেসে উঠবে। এবং হাসি থেমে যাবে।]
তরুণী : এর পরে কি হইল কন? পুত্রসন্তান হইল?
বৃদ্ধ : কিচ্ছা আইজ থাউক। মন ভাল লাগছে না। বড় কষ্ট রে, বড় কষ্ট! শীতের কষ্ট। ক্ষিদার কষ্ট।
তরুণী : একটা ক্ষিদার কিচ্ছা কন্ তো চাচা মিয়া? জানা আছে?
অন্য একজন : চুপ, চুপ, চুপ। পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। রাজার লোক আসতাছে। [সবাই চুপ]
তরুণ। : পায়ের শব্দ না গো, বাতাসের শব্দ। ঠাণ্ডা বাতাস। বড় ঠাণ্ডা বাতাস।
বৃদ্ধ : সমস্ত দিন গেল। সইন্ধ্যা গেল। চাইরদিক অন্ধকার। ঠাণ্ডা শীতের বাতাস। রাজার খবর নিয়া তো এখনো কেউ আইল না।
সকলেঃ আসে না। কেউ আসে না।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায়। ভাল কইরা চাইয়া দেখেন। কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না। কেউ না।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়, শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায় চারদিকে চউখ ফেলেন
রাজা সাবের লোকজন কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না, কেউ নাই।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়
শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
অন্য একজন : চুপ করেন, চুপ করেন,
কোন কথা নাই।
কে যেন আসতে ধরছে লাঠির শব্দ নাই।
ওসমান : তুমি কেডা?
মজনু : আমি মজনু।
ওসমান : বাদ্য-বাজনা শোনা যায়। আসে কেডা?
মজনু : রাজার পয়গাম আসতেছে। বড় সুসংবাদ।
[ দ্বিতীয় প্রজা নিয়ামত পিঠ বাঁকা করে ঢুকবে। সেও প্রথমজনের মত মঞ্চ অতিক্রম করবে।]
তরুণ : আপনে কেডা?
বশির : আমার নাম বশির।
তরুণ : বেঁকা হইয়া হাঁটেন ক্যান?
বশির : রাজার পয়গাম আসতাছে। বড় সুসংবাদ।
[তৃতীয় জনের প্রবেশ। প্রথম দু’জনের মতো মঞ্চ অতিক্রম করবে।]
তরুণী : আপনি কেডা গো?
নিয়ামত : আমি নিয়ামত।
তরুণী : জোয়ান বয়সে অমুন বেঁকা হইয়া হাঁটেন ক্যান?
[নিয়ামত দাঁড়াবে] কমরটা ভাঙলেন ক্যামনে? ঘটনাটা কন।
বৃদ্ধ : নিয়ামত, শীত লাগলে আগুনের কাছে আইসা এট্টু খাড়াও।
নিয়ামত : [হাঁটতে শুরু করবে] বাদ্য-বাজনা শুনা যায় রাজার পয়গাম আয়।
বড় সুসংবাদ।
[দেখতে দেখতে রাজার সংবাদ বহনকারী দল এসে পড়বে। ঢোল আছে, রামসিংগা আছে। একজন ঘোষক আছে।]
ঘোষক : গ্রামবাসী, মন দিয়া শুনেন। রাজা সাবের হুকুমে এই বৎসর বসন্তের উৎসব আগে আগে হইবার কথা। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত বলেন।
গ্রামবাসী : [মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবেন। গুন গুন কথা হবে।]
ঘোষক : হ্যাঁ, কিংবা না। স্পষ্ট করে বলেন।
ওসমান : পেটে ভাত নাই। রাজা সাবরে ভাত দিতে কন। শীতের মইধ্যে আবার বসন্ত উৎসব কি?
ঘোষক : এত কথা না রে ভাই, হ্যাঁ কিংবা না স্পষ্ট করে বলেন।
ওসমান : না।
ঘোষক : একজন শুধু না বললেন আর সব হ্যাঁ।
[বলতে বলতে বাজনা শুরু হবে।]
গ্রামবাসী : [মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]
ঘোষক : ভাই আপনের নাম?
ওসমান : ওসমান।
ঘোষক : আসেন আমাদের সাথে।
ওসমান : কই?
ঘোষক : এত কথা বলবার সময় নাই। আসতে বলছি আসেন।
চলেন এইবার যাই। [ওসমান উঠে দাঁড়াবে।]
গ্রামবাসী : কই যান?
[ঘোষক তার দলবল নিয়ে চলে যায় শো শো করে বইবে শীতের বাতাস। শুকনো পাতা পড়ছে। তিন পিঠ-বাঁকাকে আবার মঞ্চ অতিক্রম করতে দেখা যাবে। এবার একজনের পিছনে একজন। গ্রামবাসী তাকিয়ে দেখবে, কিছু বলবে না। দূরাগত ধ্বনি। গ্রামবাসী সচকিত। ঘোষকের প্রবেশ।[
ঘোষক : সুসংবাদ ভাই, সুসংবাদ! রাজ্যের সব লোক বসন্তের উৎসব চায় তাই উৎসবের সময়টা আপনাদের জানাই মাঘ মাসের নয় তারিখে খুব শুভক্ষণ-এই দিনে উৎসব হবে শুনেন দিয়া মন।
[এ পর্যন্ত বলতেই তরুণটি থু করে থুথু ফেলবে।]
গ্রামবাসী : [থু করে থুথু ফেলবে]
ঘোষক : মাঘ মাসের নয় তারিখে শুভ দিনক্ষণ।
তরুণ : ভাই আপনে রাজা সাবরে ভাত দিতে কন।
ঘোষক : গ্রামাবসী বৃদ্ধ-যুবা শুনেন দিয়া মন।
তরুণ : ভাই আপনে রাজা সাবরে কাপড় দিতে কন।
গ্রামবাসী : ভাত দিতে কন। কাপড় দিতে কন। ভাত দিতে কন। কাপড় দিতে কন। [ঘোষকের লোকজন তরুণটিকে ধরবে এবং নিয়ে যেতে শুরু করবে।]
তরুণী : একটা কথা শুনেন— আপনে কথার জবাব দেন।
আপনে আমার ঘরের মানুষ কোন্ জাগাতে নেন?
ঘোষক : চুপ।
তরুণ : তুই চুপ।
ঘোষক: মনে নাই ডর ভয় বড় বেশি কথা কয়।
তরুণী : [ গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে] ঘরের মানুষ লইয়া যায়,
চাইয়া থাকেন ক্যান। আমার মানুষ আমার কাছে কাইড়া আইন্যা দেন। [ গ্রামবাসী সব একত্রে দাঁড়িয়ে যাবে।]
ঘোষক : খবরদার, চুপ।
[সবাই যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় ফ্রীজ হয়ে যাবে।]
নৃপতি – পঞ্চম দৃশ্য
পঞ্চম দৃশ্য
[রাজা বসে আছেন সিংহাসনে। মন্ত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে]
রাজা : বসন্ত উৎসবের আয়োজন কি সুসম্পন্ন?
মন্ত্রী : প্রায়!
রাজা : প্রায় কেন? মনে হচ্ছে কাজ এগুচ্ছে না?
মন্ত্রী : যে রকম ভাবা গিয়েছিল তেমন উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না। শীতকালটা উৎসবের জন্যে ভাল নয়।
রাজা : এই মতামত কি তোমার?
মন্ত্রী : আমার নয় মহারাজ। মন্ত্রীর নিজস্ব কোন মতামত থাকে না। যারা উৎসবের ব্যাপারে আপত্তি করছে তাদের মতামত।
রাজা : তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয় আশা করি।
মন্ত্রী : খুব কমও নয়। আমি ওদের আপনার সামনে উপস্থিত করছি।
রাজা : কেন?
মন্ত্রী : ওদের কথা আপনার শোনা দরকার।
রাজা : আমাকেই যদি ওদের কথা শুনতে হয়, তাহলে আপনারা কি জন্যে আছেন?
মন্ত্রী : বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন আর ওদের সব কথা পরিষ্কার বুঝতে পারি না।
রাজা : কেন? ওরা কি নতুন কোন ভাষায় কথা বলছে?
মন্ত্রী : হুঁ।
রাজা : বেশ তো, ওদের নিয়ে আসুন।
[বৃদ্ধ ওসমান ও তরুণটি প্রবেশ করবে। এদের দুজনের কোমড়ে দড়ি বাঁধা। খালি গা।]
রাজা : তোমরা ভাল আছ? [বন্দী দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]
ওদের বেঁধে রেখেছেন কেন? বাঁধন খুলে দিন। [বাঁধন খুলে দিতেই বৃদ্ধটি নত হয়ে কুর্নিশ করবে।]
শুনলাম তুমি চাও না বসন্ত উৎসব হোক? বৃ
দ্ধ : [ ইতস্ততঃ করে[ বড় অভাব হুজুর! কষ্ট।
রাজা : অভাব থাকবে, কষ্ট থাকবে। আবার সুখও থাকবে। আনন্দ-উল্লাসও থাকবে। বসন্ত উৎসবও হবে।
বৃদ্ধ : হুজুর এটা শীতকাল।
রাজা : শীত ভাবলেই শীত, বসন্ত ভাবলেই বসন্ত। তুমি যদি ভাব এটা বসন্তকাল তাহলে এটা বসন্তকাল। ঠিক না?
বৃদ্ধ : তা তো ঠিকই।
রাজা : তুমি জ্ঞানীর মত কথা বলছ। তুমি বৃদ্ধ, কাজেই তুমি জ্ঞানী। বৃদ্ধরা জ্ঞানী হয়।
বৃদ্ধ : তা তো ঠিকই।
রাজা : মন্ত্রী, আপনি একে একটি উপাধি দেবার ব্যবস্থা করুন।
বৃদ্ধ :হুজুরের দয়া।
রাজা : তোমার উপাধি হবে জ্ঞানবৃদ্ধ।
বৃদ্ধ : হুজুরের অসীম দয়া।
রাজা : আমার পদচুম্বনের দুর্লভ সম্মানও তুমি পাবে।
তরুণ : থু করে থুথু ফেলবে।]
[সবাই তাকাবে। রাজা হাসিমুখে তার পা বাড়িয়ে দেবেন। বৃদ্ধ ইতস্ততঃ করবে। তরুণটির দিকে কয়েকবার তাকাবে। তারপর এগুবে রাজার দিকে।]
মন্ত্রী : তোমার মুখ পরিষ্কার আছে তো?
বৃদ্ধ : [থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যাবে।]
মন্ত্রী : মুখ ধুয়ে নাও।
[একজন প্রতিহারী পানি এগিয়ে দেবে। বৃদ্ধ বার বার তাকাবে তরুণটির দিকে। তারপর মুখ ধুয়ে এগিয়ে গিয়ে পদচুম্বন করবে।]
রাজা : খুশি হয়েছ?
বৃদ্ধ : জে। বড় মোলায়েম পা হুজুরের।
[মন্ত্রী হাততালি দিতেই একজন একটি প্রকাণ্ড কাঠের টুকরো এনে বৃদ্ধের গলায় ঝুলিয়ে দেবে। বৃদ্ধ বাঁকা হয়ে যাবে। তার হাতে একটি লাঠি ধরিয়ে দেয়া হবে। কাঠের টুকরোটিতে লেখা ‘জ্ঞানবৃদ্ধ’।]
তরুণ : [থু থু করে থুথু ফেলবে]
[ঐ তিন-বাঁকা লোক লাঠি হাতে একে একে ঢুকবে। মুখ ধুয়ে যাবে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে এনায়েত।]
রাজা : তোমাকে জ্ঞানবৃদ্ধ উপাধি দেয়া হয়েছে, তুমি এখন একজন জ্ঞানী। কাজেই জ্ঞানীর মত কিছু কথা বল।
বৃদ্ধ : [কাশতে থাকবে এবং এদিক-ওদিক তাকাবে।]
রাজা : তুমি জ্ঞানীর মত কথা বলতে জান না?
বৃদ্ধ : জে না হুজুর।
রাজা : জ্ঞানের কথা হবে দুর্বোধ্য। কোন অর্থ থাকবে না। অথচ মনে হবে অর্থ আছে। এরকম কিছু তুমি কি জান না?
বৃদ্ধ : জে না হুজুর।
রাজা : কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে কখনো দেখনি?
বৃদ্ধ : এই জীবনে কুল্লে একজনের দেখছি। আপনেরে দেখছি।
আর কেউরে দেখি নাই হুজুর।
রাজা : সাধু সাধু! তুমি শুধু জ্ঞানীই নও, তুমি মহাজ্ঞানী।
[রাজার কথা শেষ হতেই একজন প্রতিহারী এসে বৃদ্ধের গলায় ‘মহাজ্ঞানী’ পদক পরিয়ে দেবে। বৃদ্ধের মাথা অনেকখানি নেমে যাবে। বৃদ্ধ হাঁপাতে থাকবে।]
বৃদ্ধ : ওজন বড় বেশি জনাব।
রাজা : পদকের ওজন তো বেশি হবেই। কষ্ট হচ্ছে? খুলে ফেলতে চাও?
বৃদ্ধ : জে না। দুই-একদিন গলায় জুললে সহ্য হইব। আর ওজনও তেমন বেশি না। রাজা সাব সেলাম, মন্ত্রী সাব সেলাম। [এগিয়ে আসবে চান্দ মিয়ার দিকে।] ও চাঁদ মিঞা, আমার কথা শোন্ চুমা দে একটা রাজা সাবের পাওডাত। পাও থোয়া আছে। আমার কথা শোন।
তরুণ : আপনে আপনের কামে যান। আমার কথা চিন্তা করনের দরকার নাই।
বৃদ্ধ : বেকুবি করিস না চান। জোয়ান বয়স হইল বেকুবির বয়স। জোয়ান বয়সে খালি বেকুবি করতে মন চায়।
রাজা : ও সত্যি সত্যি জ্ঞানীর মত কথা বলছে। ও সত্যি জ্ঞানী হয়ে গেছে। বুঝলে মন্ত্রী, জ্ঞান মানুষকে জ্ঞানী করে না।
মন্ত্রী : পদক জ্ঞানী করে।
রাজা : শোন জ্ঞানবৃদ্ধ তুমি এখন যাও, একে একা থাকতে দাও। [বৃদ্ধ চলে যাবে। তিন-বাঁকা ঢুকবে এবং কুলি করে চলে যাবে।]
রাজা : তুমি আমার কথা শোন। তাকাও আমার দিকে।
তরুণ : [মাথা ঝাঁকাবে।]
রাজা : দুর্বল শরীরে এত জোরে মাথা ঝাঁকি দেয়া ঠিক না।
এতে মাথা খুলে পড়ে যেতে পারে।
মন্ত্রী : রাজার পদচুম্বন করতে কি তোমার অহংকার লাগছে?
অহংকার ভাল নয়। দুর্বলের অহংকার থাকতে নেই। [তরুণটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে পদচুম্বন করবে।]
রাজা : তোমার শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে দেখে খুশি হচ্ছি। এসো, এসো। [তরুণটি এগিয়ে এসে গোঁ গোঁ করতে করতে রাজার পা কামড়ে ধরবে। তীব্র বাজনা বেজে উঠবে। রাজার মুখ হাসি-হাসি থাকবে।]
তোমার সাহস দেখে চমৎকৃত হয়েছি। কি নাম তোমার?
তরুণ : [তাকিয়ে থাকবে।]
রাজা : সাহসী মানুষদের আমি সব সময়ই পছন্দ করি। শুধু পছন্দ নয়, পুরস্কৃতও করি। মন্ত্রী, ওকে কি পুরস্কার দেয়া যায়?
মন্ত্রী : মহারাজ, ওকে সাহসী তরুণ উপাধি দিয়ে দিন।
তরুণ: [থু করে থুথু ফেলবে।]
রাজা : একে আমি মূল্যহীন উপাধি কি করে দেই? অন্য কিছু দিতে হবে।
মন্ত্রী : পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা দিন।
তরুণ : [থু করে থুথু ফেলবে]
[রাজা তরুণকে লক্ষ্য করছেন।]
মন্ত্রী : পঞ্চাশটি দিন।
তরুণ : [থুথু ফেলবে।]
মন্ত্রী : পাঁচশ’ দিন।
তরুণ : [এইবার আর থুথু ফেলবে না।]
রাজা : পাঁচশ’ নয়, এই সাহসী তরুণকে পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিন।
[সভাসদের হাততালি–একটি স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি থলে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সে অন্যদের মত বাঁকা হয়ে যাবে।]
হ্যাঁ, তুমি এখন যেতে পার।
[তরুণটি ইতস্ততঃ করে দরজা পর্যন্ত যাবে। আবার ফিরে আসবে। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। তরুণটি চুম্বনের জন্য মাথা নিচু করতেই]।
মন্ত্রী : মুখ ধুয়ে নাও। ভাল করে মুখ ধুয়ে নাও।
[মুখ ধুয়ে চুম্বন করামাত্রাই অসংখ্য কাক- কা-কা করে ডাকতে থাকবে।]
রাজা : একদিনে অনেক কাজ হল মন্ত্রী। আজ তাহলে সভা ভঙ্গ হোক।
মন্ত্রী : আর অল্প কিছু সময় কি দিতে পারবেন না মহারাজা?
রাজা : নিশ্চয় পারব। একশ’বার পারব। হাজার বার পারব।
আজ আমার বড় আনন্দ মন্ত্রী। বড় আনন্দ!
মন্ত্রী : আপনার আনন্দে আমাদেরও আনন্দ। আপনার সুখেই আমাদের সুখ।
রাজা : আহ্ এসব কথা অনেকবার শুনেছি। আর কি বলবে বল। নতুন কিছু বল।
মন্ত্রী : নগরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি আপনাকে ফুলের মালা দিতে চান।
রাজা : ফুলের মালা?
মন্ত্রী : জি, ফুলের মালা। এরা সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন।
রাজাঃ আহা, সকাল থেকে অপেক্ষা করছে! ওদের তো বড় কষ্ট হয়েছে মন্ত্রী। আমি কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না। যাও যাও, এক এক করে নিয়ে এসো। [ফুলের মালা হাতে একজন প্রবেশ করবে। মালা পরাবে]
ভাল আছ তুমি?
১ম লোক : ভাল আছি। খুব ভাল আছি।
রাজা : সুখে আছে?
১ম লোক : মহাসুখে আছি, মহানন্দে আছি।
[১ম লোক চলে যাবে। ২য় লোক ঢুকবে, মালা দেবে।]
রাজা : তুমি ভাল তো?
২য় লোক : জ্বি জনাব, ভাল। আমি সুখী-মহা-সুখী।
রাজা :কেন তুমি মহাসুখী?
২য় লোক : আপনাকে দেখতে পেয়েছি, তাই। রাজদর্শনে পুণ্য আছে। শাস্ত্রের কথা। পুণ্যতেই সুখ-মহাসুখ। প্রস্থান।
[৩য় ব্যক্তির প্রবেশ]।
৩য় লোক : হুজুর, এই মালাটি আমার কন্যা রাত জেগে নিজ হাতে গেঁথেছে আপনার জন্যে।
রাজা : রাত জেগে গেঁথেছে? আহা, আহা বড় কষ্ট হয়েছে তো।
৩য় লোক : আপনার জন্যে মালা গাঁথায় কোন কষ্ট নেই।
রাজা : মালা কে এত কষ্টের মালা কিন্তু কোন গন্ধ পাচ্ছি না কেন?
৩য় লোক : ফুলগুলি কাগজের, তাই গন্ধ নেই। রাজ্যে ফুলের বড় অভাব জনাব।
রাজা : হা হা। ঠিক ঠিক। আমার মনে ছিল না। গন্ধের কোন প্রয়োজন নেই। এর সৌন্দর্য তার গন্ধকে ছাপিয়ে উঠেছে। আমি তোমার কন্যার প্রতি প্রীতি হয়েছি। ওকে আমি পুরস্কৃত করতে চাই।
৩য় লোক: হুজরের অসীম দয়া। প্রজাদের প্রতি আপনার মমতার কোন সীমা নেই।
রাজা : চুপ, সব চুপ। আমি এর কন্যার জন্যে একটি কবিতা লিখে দেব। আমার ভাব এসে গেছে। কাগজ, কলম। আলো, আলো কমিয়ে দাও। গোধূলির পরিবেশ তৈরি কর। কলম, কলম।
নৃপতি – ষষ্ঠ দৃশ্য
ষষ্ঠ দৃশ্য
[রাণী একাকী হাঁটছেন। ওস্তাদের প্রবেশ]
রাণী : আপনি এসেছেন কেন? আপনাকে তো ডাকিনি! তাছাড়া আপনি এমন নিঃশব্দে কেন হাঁটেন? আমি চমকে উঠেছিলাম। এখানে আমার বুক কাঁপছে।
ওস্তাদ : মাঝে মাঝে চমকে ওঠা ভাল। এতে শরীর সুস্থ থাকে।
রাণী : আপনি কি চান আমার কাছে?
ওস্তাদ : শুনলাম কয়েক রাত ধরে আপনার ঘুম হচ্ছে না। আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
রাণী : কোত্থেকে শুনলেন আমার ঘুম হচ্ছে না?
ওস্তাদ : রাজপ্রাসাদের সবাই আপনার দুঃস্বপ্নের কথা বলাবলি করছিল। অনেকেই মনে করছে যেহেতু মহারাণী দুস্বপ্ন দেখছেন কাজেই তাদেরও দেখা উচিত। কাজেই তারাও দেখছে। কয়েক রাত ধরে অনেকেই ঘুমুতে পারছে না, মহারাণী।
রাণী : আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন?
ওস্তাদ : হ্যাঁ।
রাণী : কি দেখছেন?
ওস্তাদ : দেখলাম, মহানন্দে রাজ্যে বসন্ত উৎসব হচ্ছে, গান-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস। রূপসী নর্তকীরা মহারাজাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে মহারাণী স্বয়ং প্রজাদের মধ্যে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একটি-দুটি ফুল নয়, লক্ষ লক্ষ ফুলের অযুত নিযুত পাপড়ি। কি অপূর্ব তার সৌরভ।
রাণী : এ-তো চমৎকার একটি স্বপ্ন। একে দুঃস্বপ্ন বলছেন কেন?
ওস্তাদ : দুঃস্বপ্ন বলছি কারণ ফুলের পাপড়ি আপনি যাদের দিচ্ছেন তারা ফুল চায় না।
রাণী : তারা কি চায়?
ওস্তাদ : ভাত চায়।
[রাণী তাকিয়ে থাকবেন। এবং দ্রুত চলে যাবেন। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকবে।] একজনের পেছনে একজন করে পিঠ-বাঁকার দল মঞ্চ অতিক্রম করবে। তারা পা ফেলছে তালে তালে।]
মজনু : জয়! মহারাজার জয়! [চলতে চলতে বলবে।]
বাকী সবাই : জয়! মহারাজায় জয়!
ওস্তাদ : তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
মজুন : বসন্ত উৎসবের কথা দশজনেরে বলতে যাই, জনাব। মহারাজার দয়ার কথা সবারে বলতে যাই। মহারাজা দয়ার সাগর।
সবাই : দয়ার সাগর!
মজনু : আনন্দের সমুদ্র!
সবাই : আনন্দের সমুদ্র!
ওস্তাদ : বাঁকা হয়ে কি উৎসবের সংবাদ দিতে আছে? উৎসবের সংবাদ দিতে হয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। বুক টান করে দাঁড়ান না সবাই।
মজনু : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
বশির : আমাদের অত সময় নাই। [প্রস্থান।]
নেয়ামত : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
সবাই : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
[মঞ্চে শুধু বৃদ্ধ ও তরুণটি থাকবে। দু’জনেরই পিঠ বাঁকা।]
ওস্তাদ : বুক টান করে দাঁড়ান। মানুষের মত দাঁড়ান।
[দু’জনেই চেষ্টা করবে, পারবে না।]
বৃদ্ধ : এর ওজন বড় বেশি জনাব। সোজা হওন যায় না। অল্প কয়টা দিন বাঁচুম, বেঁকা হইয়া থাকলে অসুবিধা নাই। আচ্ছা ভাই, যাই। সেলাম।
[চলে যেতে ধরবে।]
[তরুণটি দাঁড়িয়ে আছে একা।]
ওস্তাদ : অল্প ক’টা দিন বাঁচবে, এই কটা দিন না হয় সোজা হয়েই বাঁচো।
বৃদ্ধ : লাভ তো কিছু নাই ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : লাভ থাকবে না কেন? এই বয়সে এতো বড় একটা বোঝা!
তোমার কোমর তো ভেঙে যাচ্ছে।
বৃদ্ধ : কিন্তু জনাব, এই বোঝাটার একটা ইজ্জত আছে। এর কারণে পাঁচজনে আমারে সালাম দেয়। দুই-একটা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। রাজাসাবও আমারে পেয়ার করেন।
ওস্তাদ : তোমার লোকজন তো এক সময় তোমাকে ভালবাসতো তারা কি এখনো বাসে?
বৃদ্ধ : ছোড লোকের ভালবাসার কি কোন দাম আছে জনাব?
কোন দাম নেই। একটা ময়ূরপক্ষী এক হাজার কাকের সমান।
ওস্তাদ : বাহ, তুমি তো সত্যি সত্যি জ্ঞানের কথা বলতে শুরু করেছ!
বৃদ্ধ : আরো একটা কথা আছে, জনাব।
ওস্তাদ : বল, সেই কথাটাও শুনি।
বৃদ্ধ : আমি হইলাম মরণকালের বুড়া। আমার পিঠ বেঁকা থাকলেই কি, সোজা হইলেই কি? [তরুণকে ইঙ্গিত করে।]
যারার পিঠ সোজা থাকনের কথা তারাই বেঁকা ইয়া ঘুরতাছে। আচ্ছা ওস্তাদজী, যাই। সেলাম। [বৃদ্ধ চলে যাবে।]
ওস্তাদ : তোমার জোয়ান বয়স। তোমার বাঁকা হয়ে থাকা তো ঠিক না। নাম কি তোমার?
তরুণ : চান মিয়া।
ওস্তাদ : বাহ্, কি চমৎকার একটা নাম! এত সুন্দর নামের একটি ছেলে সারাজীবন বাঁকা হয়ে থাকবে? দেশের বাড়িতে কে আছে তোমার?
তরুণ : আমার বউ আছে।
ওস্তাদ : তার কি নাম?
তরুণ : ফুলি।
ওস্তাদ : বাহ্ বাহ্ বাহ্, কি সুন্দর নাম! ফুল থেকে ফুলি। শোন চান মিয়া–ফুলি না ডেকে এখন থেকে তুমি তাকে ডাকবে ফুলকুমারী।
তরুণ : জ্বি আচ্ছা।
ওস্তাদ : এখন তুমি এক কাজ কর, বস্তাটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর ফিরে যাও ফুলকুমারীর কাছে। [তরুণ গলা থেকে বস্তা নামিয়ে রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়াবে] যাও, এখন ফুলকুমারীর কাছে যাও। সে অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। অনেক দিন তো তার সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে না, ঠিক না?
তরুণ : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বে।]
[তরুণ সোজা হয়ে উল্টো দিকে চলে যাবে। আনন্দ ও উল্লাস-এর সংগীত বেজে উঠবে। হঠাৎ সমস্ত সংগীত থেমে যাবে। দেখা যাবে তরুণটি চোরের মত আবার ঢুকছে। স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে পিঠ বাঁকা করে সে অন্যরা যেদিকে গেছে সেদিকে রওনা হবে। একবারও তাকাবে না ওস্তাদজীর দিকে। ওস্তাদজী পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটি দেখবেন।]
[মঞ্চের অন্যপ্রান্ত থেকে ঢুকবেন রাজা। তাঁর মুখ হাসি হাসি]
রাজা : যদি দশটি স্বর্ণমুদ্রা থাকতো তাহলে সে হয়তো তোমার কথা শুনতো। বিশটি বা ত্রিশটি থাকলেও শুনতো। কিন্তু ওখানে আছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
ওস্তাদ : এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা তুচ্ছ করতে পারে এমন মানুষও তো এ রাজ্যে আছে মহারাজা। আছে না?
রাজা : হয়তো আছে। কিন্তু তাদের জন্যে আছে দু’হাজার স্বর্ণমুদ্রার থলে। যারা দু’হাজারকে তুচ্ছ করবে তাদের জন্যে তিন হাজারের ব্যবস্থা আছে। [রাজা হাসতে থাকবেন।]
রাজ্য চালনা কঠিন কাজ ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : হ্যাঁ খুবই কঠিন।
রাজা : আমি দূর থেকে সমস্ত ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। এত আগ্রহ নিয়ে এর আগে কোনকিছু লক্ষ্য করিনি।
ওস্তাদ : মহারাজার আগ্রহের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তার জন্যে বড় আনন্দবোধ করছি।
রাজা : আনন্দবোধ করাই উচিত। আমি তোমার উপর খুব খুশি হয়েছি।
ওস্তাদ : আপনার সুখের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তাতেই আমার আনন্দ।
রাজা : ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : বলুন জনাব।
রাজা : শুনলাম, তুমি না-কি আজকাল দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ? ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন!
ওস্তাদ : [চুপ করে আছে।]
রাজা : এবং তুমি তোমার দুঃস্বপ্নের কথা বলে বেড়াচ্ছ সবাইকে।
ওস্তাদ : স্বপ্ন খুব রহস্যময় বস্তু জনাব। এতে থাকে ভবিষ্যতের ইংগিত, কাজেই স্বপ্নের কথা বলতে হয়।
রাজা : ঠিক ঠিক। খুব ঠিক। বলাই উচিত। বলে তুমি ভালই করেছ। আমি তোমার উপর খুশি। খুব খুশি। নাও, তুমি এই মালাটা নাও। এটা তোমার জন্য।
ওস্তাদ : মহারাজার মালা গলায় পরার যোগ্যতা কি আমার আছে?
রাজা : ওস্তাদজী, মহারাজার মালা অযোগ্য লোকদের গলাতেই বেশি ঝুলে।
আমি কি ঠিক বলেছি?
ওস্তাদ : বলেছেন। ঠিক বলেছেন। আপনি মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
রাজা : [হাসি] বিভ্রান্ত হয়ে যাও। খুব ভাল বলেছ। একজন বুদ্ধিমান নৃপতির কাজই হচ্ছে আশেপাশের সবাইকে বিভ্রান্ত করে রাখা। দশটি মিথ্যা কথার সঙ্গে তিনটি সত্যি কথা মিশিয়ে দেয়া। দশটি ভুল সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।
ওস্তাদ : আপনি বুদ্ধিমান।
রাজা : ধন্যবাদ।
ওস্তাদ : আমি কি যেতে পারি, মহারাজা?
রাজা : নিশ্চয়ই যেতে পারো। তবে শোন, একটি কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন মনে করছি তোমার গান এখন আর আমাকে তৃপ্তি দিতে পারছে না। তোমার গলা নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটি সুন্দর কণ্ঠ তো নষ্ট হতে দেয়া ঠিক না। কি করে তোমার গলা ঠিক করা যায় বল তো?
[রাজা হাততালি দেবেন, মন্ত্রী এসে ঢুকবেন। রাজা আবার হাততালি দেবেন, দু’জন সভাসদ এসে ঢুকবে।] এর গলা নষ্ট হয়ে গেছে। কি করে এর গলা ঠিক করা যায় বল তো? আমি তার কণ্ঠের অপূর্ব সংগীত আবার শুনতে চাই।
[ সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।] [আপন মনে]
অন্ধ গায়ক গায়িকারা খুব সুকণ্ঠ হয়। কি, হয় না?[ সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করবে।] ওকে নিয়ে যাও। নষ্ট করে দাও ওর চোখ। আমি আবার তার কণ্ঠে অপূর্ব সুরধ্বনি শুনতে চাই। আমি আবার আবেগে উদ্বেলিত হতে চাই। যাও ওকে নিয়ে যাও।
মন্ত্রী : [অবাক] মহারাজা!
রাজা : আহা, কেন প্রশ্ন করছো? ও তো করছে না। সে তো তার কণ্ঠে যৌবন ফিরে পেতে চায়। তাই না?
ওস্তাদ : [তাকিয়ে আছেন।]
রাজা : যাও, ওকে নিয়ে যাও।
[ওস্তাদ চলে যাবেন। তার পেছনে মন্ত্রী ও সভাসদরাও যাবে। আলো কমে আসবে। রাজা নিজ মনে পায়চারি করবেন ও হাসতে শুরু করবেন। অট্টহাসি শুনে রাণী ঢুকবেন।]
রাণী : [আতঙ্কিত হয়ে] কি হয়েছে?
রাজা : কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে ঠিক থাকবে। এসো, তুমি আমার কাছে এসো!
[রাজা ও রাণীর প্রস্থান]
নৃপতি – সপ্তম দৃশ্য
সপ্তম দৃশ্য
[রাজার সিংহাসন। রাজা নেই। মন্ত্রী ও সভাসদরা আছেন।]
মন্ত্রী : মহিম গড়ের মহারাজা আজ প্রজাদের দর্শন দিতে পারছেন না। আসন্ন উৎসব নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ কাব্য রচনা করবেন বলে ঠিক করেছেন।
নকিব : মহারাজার জয় হোক।
সবাই : মহারাজার জয় হোক।
মন্ত্রী : বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আমাদের প্রিয় নৃপতি এই রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের জন্যে একটি বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সবাইকে সুখী দেখতে চান, আনন্দিত দেখতে চান।
মজনু : মহারাজার হয় হোক।
সবাই : মহারাজার হয় হোক।
মন্ত্রী : মহারাজার উপহার হচ্ছে রাজ্যের সমস্ত প্রজা উবসের দশদিন রাজার পদচুম্বনের সুযোগ পাবে। ধনী-নির্ধন, আমীর-ফকির সবার জন্যেই এই উপহার। মহারাজার চোখে সবাই সমান।
সবাই : জয়, মহারাজার জয়!
[ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজবে। রাজার প্রবেশ।]
রাজা : তুমি কি উপহারের ঘোষণাটি পড়ে ফেলেছ?
মন্ত্রী : এইমাত্র পড়লাম।
রাজা : কিন্তু ব্যাপারটা এখন আর আমার পছন্দ হচ্ছে না। সারাক্ষণ আমার পায়ে থুথু লেগে থাকবে ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছে। বমি-বমি ভাব হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা সবাই অল্পে তুষ্ট নয়। কেউ কেউ পা চাটতে শুরু করবে। অসহ্য, অসহ্য! ঘোষণা বাতিল করে দাও। উৎসবের দশদিন আমি ওদের দেখতে চাই না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
মন্ত্রী : তা হয় না মহারাজ। ঘোষণা বাতিল হলে প্রজাদের আশাভঙ্গের কারণ ঘটবে। ওদের সমস্ত আনন্দই মাটি হবে। সেটা ঠিক হবে না। তবে মহারাজা, আমি দু’দিক বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছি। প্রজারা আপনার পায়ে চুমু খাবে কিন্তু তা আপনাকে স্পর্শ করবে না।
রাজা : বল কি!
মন্ত্রী : [হাততালি।] রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে অবিকল আপনার পায়ের মত একটি কাঠের পা তৈরি করা হয়েছে। [প্রকাণ্ড একটি ট্রেতে প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি ধবধবে একটি পা এনে মঞ্চে রাখবে।] প্রজারা চুমু খাবে এই পায়ে।
রাজা : চমৎকার!
সবাই : চমৎকার! চমৎকার!
রাজা : আমি অত্যন্ত প্রফুল্ল বোধ করছি। সমস্যার একটি সুন্দর সমাধান তুমি বের করেছ। বল, তুমি আমার কাছে কি চাও?
মন্ত্রী : আপনার অনুগ্রহ চাই। আর কিছুই চাই না।
রাজা : না না, শুধু অনুগ্রহ নয়। আমি এর বাইরেও তোমাকে কিছু দিতে চাই। কি দেয়া যায়? আমার এই রাজকীয় পা বহন করার দুর্লভ সম্মান আমি তোমাকে দিতে চাই।
মন্ত্রী : এ আমার পরম সৌভাগ্য।
[রাজার ইঙ্গিতে ঐ পা মন্ত্রীর গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। পা গলায় ঝুলানোর পর মন্ত্রী খুব ধীরে ধীরে বাঁকা হতে থাকবেন।]
রাজা : [হাসতে থাকবেন।]
সবাই : [রাজার দেখাদেখি হাসতে থাকবে।]
[টুং টুং করে ঘণ্টা বাজবে। পাঁচ পিঠ-বাঁকাকে ঢুকতে দেখা যাবে এবং মন্ত্রীর গলায় ঝুলানো পায়ে চুমু দিয়ে একে একে চলে যাবে। ওরা চলে যেতেই রাজা গম্ভীর গলায় ডাকবেন।]
রাজা : ডাক, ওদের ডাক। [ওরা এসে ঢুকবে।] তোমরা এখানে কেন? তোমাদের তো বলেছিলাম–আনন্দের বার্তা নিয়ে দূর দূরান্তে যাবে। বসন্ত উৎসবের কথা বলবে। তোমরা কি যাওনি কোথাও? বল, বল, কথা বল। চুপ করে আছ কেন?
মজনু : রোজ একবার আপনেরে না দেখলে মনটা কান্দে।
সবাই : মনটা কান্দে।
মজনু : আমরা মহারাজের আশে-পাশেই থাকতে চাই। সবাই থাকতে চাই।
মজনু : বেকুবগুলির কাছে যাইতে চাই না হুজুর।
সবাই : চাই না হুজুর।
রাজা : আমার প্রতি তোমাদের প্রতি দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। বড় ভাল লাগছে।
সবাই : আমাদেরও বড় ভাল লাগতাছে। বড় আনন্দ। [সবাই হাসবে]
রাজা : হাসছ কেন? তোমাদের তো হাসতে বলিনি। তোমাদের বলেছিলাম বসন্ত উৎসবের খবর পৌঁছাবে। তাও পৌঁছাওনি। রাজার আদেশ মাননি। রাজার আদেশ অমান্য করেছ।
মজনু : ওদের কাছে যাইতে বড় ভয় লাগে হুজুর।
রাজা : ভয়! কিসের ভয়? আমাকে ভয় লাগে, না ওদের ভয় করে।
এসব কি কথাবার্তা শুনছি? ওদের পিঠে দশ ঘা করে চাবুক বসিয়ে দিন।
[বলার সঙ্গে সঙ্গে মজনু এক হাতে কাপড় ঘুচিয়ে শাস্তি গ্রহণ করবার জন্যে এগিয়ে আসবে। অন্যরাও পিঠের কাপড় তুলবে।]
রাজা : আহ্, এরা আমার বড় অনুগত। এদের সঙ্গ বড় ভাল লাগছে। চাবুক মারা শেষ হবার পর পরই এদের একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেবেন।
[ওরা পিঠের কাপড় আরো খোলার চেষ্টা করবে। সবার চোখে-মুখে স্বর্গীয় ভাব। চাবুক নিয়ে একজন ঢুকবে।]
না না, এখানে নয়। আমার সামনে নয়। আমি মানুষের দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারি না। ওদের এখান থেকে নিয়ে যাও। [ওরা চলে যাবে।]
তোমরা কেন দাঁড়িয়ে আছ? যাও, তোমরাও যাও। [সবাই চলে যাবে। মঞ্চ অন্ধকার হতেই দূরাগত ধ্বনি শোনা যাবে। ভাত দেন, কাপড় দেন, অনেকটা সংগীতের মত ধ্বনি। ধীর লয়ে সমুদ্রের গর্জন। রাণী ঢুকবেন।]
রাণী : কিসের শব্দ হচ্ছে?
রাজা : বাতাসের শব্দ। বাতাসে গাছের পাতা কাঁপছে। চমৎকার ধ্বনি। তোমার ভাল লাগছে না?
রাণী : না না, ওটা বাতাসের শব্দ নয়। আমি প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ প্রাসাদের দিকেই আসছে।
রাজা : ওরা আমার ভক্ত প্রজা, ওরা আসছে উৎসব দেখতে।
রাণী : ওদের সবার হাতে মশাল।
রাজা : অন্ধকার রাত। চারদিকে ভাল দেখা যাচ্ছে না, সে জন্যেই মশাল। মশালের আলোয় ওরা উৎসব ভালমত দেখতে পাবে। রাণী। তুমি বুঝতে পারছ না। ব্যাপারটা সে রকম নয়। দূর-দূর থেকে সবাই আসছে। আমার ভাল লাগছে না। আমার একটুও ভাল লাগছে না।
রাজা : হাসতে হাসতে বলবেন রাজপ্রাসাদের সদর দরজা বন্ধ করা আছে। ওরা কেউ এখানে আসবে না। তাছাড়া উৎসব যাতে সুশৃঙ্খলভাবে হতে পারে তার জন্যে হাজার হাজার সৈন্য আছে বাইরে। রাণী, তোমার মন বিক্ষিপ্ত। দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে এ রকম হয়েছে। রাজা-রাণীদের কখনো দুঃস্বপ্ন দেখতে নেই। ওস্তাদজীকে ডেকে এনে গান শোন, মন ভাল হবে।
[হাততালি দিতেই অন্ধ ওস্তাদ ঢুকবেন।]
রাজা : তুমি ভাল আছ?
ওস্তাদ : ভাল আছি। বেশ ভাল।
রাজা : বাহ্ বাহ্ বাহ্। তোমার গলা চমৎকার হয়েছে। কণ্ঠ খুলেছে।
মহারাণীকে চমৎকার একটি গান শুনাও তো। ওর মন বিক্ষিপ্ত, ওর মন ভাল করে দাও। [ওস্তাদ বসবেন। গানের আয়োজন করবেন। নেপথ্য থেকে শোনা যাবে–ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন ইত্যাদি স্লোগান।]
নৃপতি – শেষ দৃশ্য
শেষ দৃশ্য
[মঞ্চে নকিব দাঁড়িয়ে আছে একা। তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। হাতে একটি চোঙ। সে চোঙ মুখে নিয়ে কিছু বলতে যাবে- তখন দেখা যাবে জ্ঞানবৃদ্ধ এসে ঢুকছে। তার হাতে প্লাকার্ড লেখা বসন্ত উৎসব, আনন্দ করুন।]
বৃদ্ধ : নকিব সাব, সেলাম। ভাল আছেন?
[নকিব কোন কথা বলবে না]
আমারে চিনছেন তো? আমার নাম ওসমান। আমি খুব জ্ঞানী লোক। এই দেখেন, রাজা সাব আমারে উপাধি দিয়েছে। আমি খুব জ্ঞানের কথা জানি। হে-হে-হে।
নকিব : জানেন ভাল কথা, এখন যান কোথায়?
বৃদ্ধ : দেশ দেশান্তরে। জ্ঞানের কথা কইব। বসন্ত উৎসবের কথা কইব।
নকিব : ভাল কথা। ..
বৃদ্ধ : মহারাজার কথাও কইব। মহারাজার কথা বলতে বড় ভাল লাগে।
নকিব : সময়টা কিন্তু ভাল না বুড়া মিয়া। কারো ঘরে ভাত নাই। পুলাপান কান্দে। বুড়াবুড়ি কান্দে। আর জোয়ানগুলি কেমুন-কেমুন কইরা চায়। লক্ষণ কিন্তু ভাল না বুড়া মিয়া। সময়টা খারাপ। বড় খারাপ। কানে কিছু শুনেন না?
বৃদ্ধ : বয়স হইছে, কানে ভাল শুনি না।
নকিব : কিছু দেখেন না?
বৃদ্ধ : বয়স হইছে, চউক্ষে ভাল দেখি না।
[দেখা যাবে দুটি লোক খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে।]
নকিব : কে যায়?
লোক দুটি : খাটিয়াতে হেতমপুরের খবিরুদ্দি যায়।
নকিব : বিষয় কি?
লোক দুটি : টুপিওয়ালা ভাই, বিষয়ডা রাজা সাবের কাছে বলতে চাই।
নকিব : রাজা সাব রাজধানীতে নাই।
লোক দুটি : রাজা সাব রাজাধানীতে নাই। রাজা সাব রাজাধানীতে নাই।
[হাসতে হাসতে তারা এগুবে। বুড়া চোঙ নিয়ে হঠাৎ বলবে।]
বৃদ্ধ : ভাই, ও আমার বন্ধু। আমার কথা শুনেন আমি জ্ঞানীলোক, বসন্ত উৎসবের কাথাডা বলি– আইজ সন্ধ্যা…। [হঠাৎ বৃদ্ধকে নকিব অবাক করে দিয়ে লাথি বসিয়ে দেবে।]
লাথি দিলেন ক্যান?
নকিব : জানি না কেন।
বৃদ্ধ : আমি রাজা সাবের আপনার লোক, আমারে লাথি দিলেন ক্যান?
নকিব : পায়ের মইধ্যে চুলকায়।
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[বৃদ্ধ ভয়ে অনেকটা দূরে সরে যাবে এবং দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে যাবে। নকিব হেসে উঠবে। রাজা ঢুকবেন, সঙ্গে রাণী।]
রাজা : কে হাসছিল? অমন বিকট স্বরে কে হাসছিল?
নকিব : হুজুর আমি।
রাজা : কেন হাসছিলে?
নকিব : আনন্দ করছিলাম হুজুর। আপনি সবাইকে আনন্দ করতে বলেছেন।
রাণী : না, না, আনন্দ নয়। এটা আনন্দের সময় নয়।
রাজা : আহ! কি বলছ তুমি! নিশ্চয় এটা আনন্দের সময়। উৎসবে আনন্দ করবে না তো কখন করবে? তুমি হাসো। শব্দ করে হাসো। আমিও হাসব তোমার সঙ্গে। হাসো, হাসো।
[রাজা উচ্চস্বরে হাসতে গিয়েও থেমে যাবেন। দেখা যাবে বৃদ্ধ মঞ্চে ঢুকছে। তার গলায় কোন পদক নেই, ছেঁড়া জুতা ঝুলছে। খালি গা।]
রাজা : তোমার এই অবস্থা করল কে?
বৃদ্ধ : সময়টা খারাপ রাজা সাব।
রাজা : ওর স্পর্ধা তো কম নয়, বলে সময় খারাপ। লাথি দিয়ে ওকে বের করে দাও।
বৃদ্ধ : হুজুর বহুত লোকজন আসতাছে। বড় ভয় লাগতাছে হুজুর।
রাজা : [ক্ষিপ্ত] এই অপদার্থ ভীরুকে এক্ষুনি…।
[বৃদ্ধ পালাবে]
রাণী, তুমি এসো আমার সঙ্গে।
[রাজা রাণীর হাত ধরে চলে যাবেন। বৃদ্ধ আবার মঞ্চে ঢুকবে। ভাত দেন, কাপড় দেন, বলতে বলতে একটি দল এসে ঢুকবে। তাদের পুরোভাগে মজনু চোরা।]
নকিব : চুপ! [সবাই থেমে যাবে। মজনুকে উদ্দেশ্য করে] তুমি এদের সঙ্গে?
মজনু : বাতাস উলটা বইতাছে নকিব সাব। আমি আছি বাতাসের সাথে। বলেন ভাই-ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন।
সবাইঃ ভাত দেন, কাপড় দেন। ভাত কাপড় দেন।
মজনু : আরো জোরে বলেন। গলায় শক্তি নাই?
সবাই : ভাত দেন কাপড় দেন। ভাত কাপড় দেন।
নকিব : মজনু!
মজনু : বলেন।
নকিব : রাজা সাব তার সৈন্য সামন্তরে বলেছে রাজধানী ঘিরে রাখতে। শুনেছেন?
মজনু : [ভীতস্বরে] জ্বে না।
নকিব : উৎসবের সময় যারা চেঁচামেচি করবে তাদের শহর থেকে বের করে দেবার হুকুম হয়েছে। শুনেছেন?
মজনু : [খুবই ভীত।] জ্বে না, শুনি নাই। [দলের অন্য জনের দিকে তাকিয়ে] এই তোমরা ভাগ। চিৎকার কইরা মাথা ধরাইয়া দিছে। ভাগ, ভাগ। আরে আবার চউখ ঘুরাইয়া চায়।
[সবাই চলে যাবে]
মজনু : আমি হইলাম গিয়া রাজা সাবের আপনার লোক। কি কন নকিব ভাই?
নকিব : পায়ের মইধ্যে চুলকায়
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[লাথি বসাবে।]
মজনু : [অবাক! এগিয়ে যাবে বৃদ্ধের কাছে] বিষয়ডা কি কিছুই বুঝতেছি না। এই যে চাচা মিয়া।
বৃদ্ধ : পায়ের মইধ্যে চুলকায়
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[সেও লাথি বসাবে। মজনু উল্টে পড়তে গিয়ে সামলিয়ে নিবে। দু’জনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দৌড়ে পালাবে। নিকিব ও বৃদ্ধ হেসে উঠবে।]
লাথি দিয়া পাওডার মইধ্যে আরাম পাইলাম, টুপিওয়ালা ভাই।
নকিব : খবরদার! টুপিওয়ালা বলবেন না।
[নকিব টুপি খুলে ফেলে দেবে এবং দু’জনেই হেসে উঠবে। দেখা যাবে অন্য পিঠ-বাঁকারা একে একে যাচ্ছে। ওদের হাতে প্লাকার্ড। সেখানে লেখা- “বসন্ত উৎসব। আনন্দ করুন।” ওদের দেখে নকিব হাসতে থাকবে।]
নকিব : তোমরা কোথায় যাও?
বাঁকাদের একজন : আনন্দ করতে যাই, উৎসব করতে চাই।
নকিব : মুখখান তো বড় শুকনা শুকনা লাগে।
বাকাঁদের একজন : যাইতে ভয় লাগে। মন চায় না। তবু যাইতে হয়।
সবাই : তবু যাইতে হয়। তবু যাইতে হয়।
[ওরা এগিয়ে যাবে। রাজার প্রবেশ]
রাজা : চারদিকে এমন নীরব কেন? আনন্দ কর। গান কর। হাসো। প্রাণ খুলে হাসো। আজ থেকে উৎসবের শুরু। আনন্দের শুরু। হাসো, সবাই হাসো।
[পিঠ-বাঁকারা ফিরে আসবে।]
গাও, গান গাও, হাসো। হাসো- হা-হা-হা সবাই হাসো আমার সঙ্গে।
[শোনা যাবে দূরাগত ধ্বনি–ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন।]
হাসো, সবাই হাসো। হাসো।
[দর্শকদের মাঝখান থেকে স্লোগান শোনা যাবে। এবং নকিব নিজেও স্লোগান দেবে।]
[রাজা পাগলের মত চারদিকে তাকাবেন। মঞ্চে সবাই উঠে আসছে।]