বাতি জ্বালানো থাকবে?
আমি বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম, তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?
না। আলো-অন্ধকার কোনোটাতেই আমার অসুবিধা হয় না। তুমি কি বই শেষ করে তারপর শোবে?
বুঝতে পারছি না। ঘুম পেলেই শোব।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ কেন জানি আমার ঘুম আসছে না। এরকম আমার কখনো হয় না।
আমি বললাম, এমন কিছু কি ঘটেছে যার জন্যে তুমি ডিসটার্বড হয়েছ?
রূপা বলল, আমি কখনো ডিসটার্বড হই না।
কখনো না?
মাঝে মাঝে হয়তো হই। তাতে ঘুমের অসুবিধা হয় না। রূপবতী মেয়েদের ডিসটার্বেনসের প্রধান কারণ হল তার শরীর। সেই শরীরটাকে আমি তুচ্ছ করে দেখতে শিখেছি। এখন আমার অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া …
তা ছাড়া কি?
থাক, অন্য একদিন বলব।
রূপা পাশ ফিরল। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ল। লাবণ্য দুহাতে রূপার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে রেখেছে। আমি একই সঙ্গে সফিকের বই পড়ছি এবং রূপাকে দেখার চেষ্টা করছি। বই পড়ার এই হচ্ছে সমস্যা। বই এর দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়। এমন কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে যে-কোন দিকে তাকিয়ে বই পড়া যেত, তাহলে ভাল হত। গান শুনতে হলে গানের দিকে কান পেতে রাখতে। হয় না। অথচ বই পড়তে হলে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
এ্যাই, শোন।
রূপা উঠে বসেছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার?
খুব ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবে। ফ্রীজ থেকে।
ঘুম আসছে না?
আসছে। ঘুমুচ্ছিলাম, তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেল।
আমি পানি আনতে গেলাম। সিঁড়ির গোড়ায় বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবার অনিদ্রা রোগ আছে। বাবার অনিদ্রা রোগটার একটা উপকারী দিকও আছে। গভীর রাতে তিনি যখন দেখেন তাঁর মতো অন্য একজনও জেগে আছে, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করেন। এবং খুশি মনে খানিকক্ষণ গল্প করেন।
আমার উপর বাবা অসম্ভব বিরক্ত। কারণ আমি দুবছর আগে পাশ করেছি, চাকরি-বাকরির কোনো চেষ্টা করছি না। বিয়ে করে ফেলেছি কাউকে কিছু না জানিয়ে। অত্যন্ত রূপবতী একজন তরুণী আমার স্ত্রী, যার হাবভাব কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। যার উপর প্রচণ্ড রকম রাগ করার কিছু পাচ্ছে না, আবার যাকে ভালবাসবার মতোও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।
সিঁড়ির গোড়ায় আমাকে দেখে বাবার মুখের কঠিন ভাব একটু নরম হল। তিনি বললেন, এখনো ঘুমুতে যাসনি?
আমি বললাম, ঘুম আসছে না।
বাবার মুখের কঠিন ভাব আরো নরম হয়ে গেল। তিনি আন্তরিক গলায় বললেন, ঘুম না এলে অস্থির হবার কিছু নেই। প্রতিরাতে ছঘণ্টা ঘুমুতেই হবে, এমন। কোনো কথা নেই। নেপোলিয়ান মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুতেন। লা মিজারেবল-এর লেখক। ভিক্টর হিউগো যখন লেখালেখি করতেন, তখন দৈনিক গড়ে দুঘণ্টা ঘুমুতেন।
আমি বললাম, ও, তাই নাকি?
সবাইকে যখন দেখি ঘুমের জন্যে মহাব্যস্ত, তখন আমি মনে মনে হাসি—বৌমা কি ঘুমুচ্ছে নাকি?
হুঁ
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বৌমার কিছু ব্যাপার নিয়ে আমি তোর সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই। যদিও খুব ভাল করেই জানি ছেলের সঙ্গে এইসব ব্যাপার ডিককাস করা উচিত না। তবে ছেলের বয়স যখন একুশ ছাড়িয়ে যায় তখন খানিকটা হলেও বন্ধুর পর্যায়ে আসে। আমি তোর সঙ্গে ডিসকাস করতে চাচ্ছি নট এজ ফাদার বাট এজ এ ফ্রেণ্ড।
ডিসকাস করুন।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তো ডিসকাস করা যায় না। আয়, আমার ঘরে আয়।
রূপার জন্যে পানি নিয়ে যাওয়া হল না। আমি বাবার ঘরে ঢুকলাম। বাবার ঘরটা এই বাড়ির সবচে বড় ঘর। আগে এ ঘরে বাবা এবং মা ঘুমুতেন। এখন বাবা একাই ঘুমান। মা থাকেন একতলায় মুনিয়ার সঙ্গে। কারণ স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মুনিয়া দুবার ঘুমের অষুধ খাবার চেষ্টা করেছে। রাতে তাকে চোখে-চোখে রাখতে হয়।
বোস রঞ্জু।
আমি বসলাম। আমার একটু গা ছমছম করতে লাগল। বাবার এই ঘরে শৈশবে অনেকবার আসতে হয়েছে। প্রতিবারই শাস্তি ভোগ করার জন্যে। সেই শাস্তিও বিচিত্র—খাটের নিচে মাথা দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
রঞ্জু।
জী।
তুই তোর শ্বশুরবাড়ির হিস্ট্রি কিছু জানিস?
না।
খোঁজ নেয়ার ইচ্ছা হয়নি?
না।
তোর শ্বশুর যে এক বিদেশী মহিলা বিয়ে করেছিলেন, সেটা জানিস?
জানি।
ঐ বিদেশী মহিলার হিস্ট্রী জানিস?
না।
সে ছিল নর্তকী। নাইট ক্লাবে নচিত। খুব অথেনটিক সোর্স থেকে খবর পেয়েছি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু রহমান ঐদিন কথায় কথায় বললো। বলতে চায়নি—আমিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করেছি। রহমান এবং তোর শ্বশুর একসঙ্গে বাইরে ছিল। সে রূপার মা সম্পর্কে যা বলল … ভয়াবহ! সে সব বলতে চাচ্ছি না। নাইট ক্লাবের নর্তকী–এই একটা বাক্যই যথেষ্ট।
তাতে কিছু যায় আসে না বাবা।
কিছু যায় আসে না?
না।
বাইশ তেইশ বছর আগের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে?
ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু না থাকলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ানো হয় কেন? বর্তমানের ভিত থাকে অতীতে। এই যে তোর স্ত্রীর কথাই ধর–তার স্বভাব, তার মানসিকতা সে নিয়ে আসবে তার মা-বাবার কাছ থেকে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এটাও ঠিক না বাবা। আমাকে দিয়ে দেখ–আমি কি তোমার মানসিকতা পেয়েছি? তুমি যে রকম আমি মোটেও সে রকম না। কাজ ছাড়া তুমি এক সেকেণ্ড থাকতে পার না, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে থাকতে পারি। তুমি মুহূর্তের মধ্যে রেগে আগুন হও। আমি কখনো রাগি না।
তুই হচ্ছিস একটা মেষ। মেরি হেড এ লিটল ল্যাম্বের এক ল্যাম্ব।