পত্রিকায় রূপার যে ছবিটি ছাপা হয়েছে সেটি ভুদ্র ছবি। তবে প্রতিবেদন পড়বার পর ছবিটির দিকে তাকালেই পাঠকদের চোখে একটি নগ্ন মেয়ের ছবিই ভেসে উঠবে। আমি পত্রিকা হাতে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলাম। এ কি সমস্যা! বাবু এসে বলল, দাদা, ভাবী নাকি সিনেমা করছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ছবিটা দেখতে চাচ্ছি। পরীক্ষার পর রিলিজ হবে তো?
জানি না।
কাহিনীটা কি তুমি জান?
না।
রূপা এল সন্ধ্যার পর।
কুচকুচে কালো রঙের একটা টয়োটা গাড়ি রূপাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। রূপা দোতলায় উঠে এল লাবণ্যকে কোলে নিয়ে। বাইরে থেকে এলেই রূপা কিছুটা সময় লাবণ্যর সঙ্গে কাটাবে।
রূপ লাবণ্যকে নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। লাবণ্যর সঙ্গে কথাবার্তা এবং হুঁটোপুটি হতে থাকল। আমি যে পাশেই আছি, তার কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছি, এ নিয়ে রূপার কোনো মাথাব্যথা নেই …
ও লাবণ্য সোনা, ভুনভুনা, খুনখুনা, ঝুনঝুনা!
কি?
আপনি কি করছেন?
আমি কিছু করছি না।
কে আপনাকে আদর করছে?
তুমি।
তুমিটা কে?
তুমি হচ্ছ রূপা।
রূপাকে তুমি কি ডাক?
মামী ডাকি।
তোমার মামী কি সুন্দর?
হ্যাঁ।
অল্প সুন্দর না খুব বেশি সুন্দর?
খুব বেশি সুন্দর।
কিসের মতো সুন্দর?
চাঁদের মতো।
চাঁদের কবিতাটা বলেন তো লাবণ্য সোনা।
বলব না।
বলতে হবে।
না, বলব না।
বলতেই হবে, বলতেই হবে, বলতেই হবে।
বলব না, বলব না।
তাহলে একটু হাসেন।
হাসব না।
তাহলে একটু কাঁদেন প্লীজ, প্লীজ। প্লীজ লাবণ্য।
কাঁদব না।
তাহলে একটু নিচে গিয়ে বলুন তো আমাকে এক কাপ চা দিতে।
লাবণ্য নিচে চলে গেল। আমার মনে হল আদরের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খবর কি?
আমি বললাম, কোনো খবর নেই।
সারাদিন ঘরেই ছিলে, না কোথাও গিয়েছিলে?
ঘরেই ছিলাম। আচ্ছা রূপা শোন, তুমি আমাকে বললে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে, তারপর আমাকে না নিয়েই চলে গেলে!
শেষ মুহূর্তে তোমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না।
রূপা বাথরুমে ঢুকে গেল। বাথরুম থেকেই বলল, সারাদিন ঘরে বসে আছি এটা তো ভাল কথা না। বাইরে থেকে ঘুরে-টুরে এসো।
কোথায় যাব?
কোনো বন্ধুর বাড়ি যাও। তাস-টাস খেলে এসো। সারাক্ষণ ঘরে থাকলে কি হয় জান? সবার সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করে। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছ।
অনেকদিন কারোর বাসায় যাওয়া হয় না। যেতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুবান্ধব কারোর সঙ্গে দেখা হলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। রিকশায় হুঁড উঠিয়ে চলাফেরা করি। সেদিন মজিদ বাসায় এসেছিল। আমি বলে পাঠালাম, বাসায় নেই। অথচ মজিদের সঙ্গে কথা বলে আমি আরাম পাই। সে মজার কথা বলে খুব হাসাতে পারে। এরকম হচ্ছে কেন আমি জানি না। বিয়ের পর মানুষ খানিকটা বদলায়, এতটা কি বদলায়? মুনিয়ার ধারণা, কাফকার গল্পের নায়কের মতো আমার মেটামরফসিস হচ্ছে—আমি ধীরে ধীরে মানুষ থেকে ফার্নিচার হয়ে যাচ্ছি। আমি বললাম, কি ফার্নিচার হচ্ছি বলে তোর ধারণা? সে বলল, তুমি খুব ধীরে ধীরে একটা ইজিচেয়ার হয়ে যাচ্ছ।
সত্যি বোধহয় তাই হচ্ছি। ছিলাম মানুষ, হয়ে যাচ্ছি ইজিচেয়ার।
আমি রূপাকে ঘরে রেখে অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হলাম। কোথায় যাব ঠিক করা নেই। রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটব। মোড়ের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। দোকানদার আমার চেনা। সে হাসিমুখে বলল, ভাইজানরে তো আইজকাইল দেখি না।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। ব্যাটা কি কথার কথা বলছে না সত্যি সত্যিই লক্ষ করছে যে, আমি আজকাল ঘর থেকে কম বেরুচ্ছি।
ভাইজানের শইল ভালো তো? আপনেরে কেমুন জানি কাহিল লাগতাছে।
আমি এই কথারও জবাব দিলাম না। তার এই কথাটা সম্ভবত সত্যি, আমাকে কাহিল যে দেখাচ্ছে তা নিজেই বুঝতে পারছি। কারণ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। প্রায় জেগে জেগেই রাত পার করছি। আমার পাশে শুয়ে রূপা এক ঘুমে রাত পার করে দিচ্ছে। অনিদ্রার রুগীরা সাধারণত দিনে ঘুমিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। আমার সেই অবস্থাও নেই। দিনে আমি কখনো ঘুমতে পারি না।
সিগারেটের দোকানের সামনে থেকেই আমি রিকশা নিয়ে নিলাম। সেই রিকশা নিয়ে চলে গেলাম সফিকের বাসায়। জানি তাকে পাওয়া যাবে না। সে কখনো রাত দশটার আগে বাসায় ফেরে না। সফিককে না পাওয়াই ভালো, পাওয়া গেলে ঘণ্টা দুই সময় নষ্ট হবে। দুঘন্টার আগে সে ছাড়বে না। সফিক বাসায় না থাকলেও জানবে আমি এসেছিলাম। এক ধরনের সামাজিকতা রক্ষা হবে। আমি নিজেও খানিকটা স্বস্তি পাবো যে অকারণে রিকশায় করে ঘুরছি না। কাজে যাচ্ছি।
সফিক বাসায় ছিল না। সফিকের ছোট বোন সুমি দরজা খুলে বিস্মিত গলায় বলল, ও মা কি সর্বনাশ, আপনি!
সুমি এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। ডাক্তারিতে ভর্তি হবার জন্য দিনরাত পড়াশোনা করছে।
কেমন আছিস রে সুমি?
আমি তো ভালই আছি। আপনি এরকম কঙ্কাল হয়ে গেছেন কেন?
কঙ্কাল হয়ে গেছি?
হুঁ। আয়না নেই আপনার ঘরে?
তুই নিজেও তো কঙ্কাল হয়ে গেছিস। হেভি পড়াশোনা হচ্ছে?
তা হচ্ছে। তবে লাভ হবে না। গোল্লা খাব।
সফিককে ডেকে দে তো।
ভাইয়া বাসায় নেই। ঢাকাতেও নেই, টাঙ্গাইল গেছেন।
টাঙ্গাইল কেন?
সাহিত্য সভা, ভাইয়া হচ্ছে বিশেষ অতিথি।
বলিস কি!
আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে খুব ঝোলাকুলি করছিল, আমি যাইনি।