না।
আমি যখন ছোট ছিলাম অর্থাৎ কলেজে যখন পড়তাম, তখন এই গানটা বাজাতে বাজাতে সাঙ্খতাম। আমার তখন মনে হতো কি জানো? মনে হতো আমার জন্যেই যেন গানটা লেখা হয়েছে। অবশ্যি এই ব্যাপারটা এখনো আমার মধ্যে আছে, কোনো কোনো গান শুনলেই মনে হয় এই গান আমার জন্যে লেখা, অন্য কারো জন্যে নয়। তোমার কি এরকম মনে হয়?
না।
তুমি ক্যামেরাটা নিয়ে এসো তো, আমার সাজগোজ শেষ হলে একটা ছবি তুলবে।
ক্যামেরায় ফিল ছিল না বলে ছবি তোলা গেল না। রূপা করুণ গলায় বলল, দোকানপাট নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে, এত রাতে কি আর ফিল্ম পাওয়া যাবে?
পাওয়া না যাবারই কথা।
এসো তাহলে শুয়ে পড়ি, কি আর করা।
আমরা ঘুমুতে গেলাম বারোটার দিকে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করামাত্র রূপা বলল, মাছের ব্যাপারে কেন আপসেট হয়েছিলাম তোমাকে বলেই ফেলি।
তোমার বলতে ইচ্ছা না হলে বলার দরকার নেই।
ইচ্ছা হচ্ছে। আজ থেকে বাইশ বছর আগে বাবা বিশাল একটা পাংগাশ মাছ এনেছিলেন। মাছ নিয়ে ঘরে ঢোকামাত্র বাবা আমার জন্মসংবাদ পেলেন। মাছটা রূপার মতো চকচক করছিল। মাছের রূপালি রঙ থেকে রূপা নাম নিয়ে বাবা আমার নাম রাখলেন। সেই থেকে অলিখিত নিয়মের মতো হয়ে গেল, আমার জন্মদিনে বাজারের সবচে বড় মাছটা আসবে। গতবার এসেছিল চিতল মাছ। লম্বায় প্রায় আমার সমান।
আজ কি তোমার জন্মদিন?
ইয়েস স্যার। তুমি ইচ্ছে করলে শুভ জন্মদিন বলতে পার।
শুভ জন্মদিন রূপা।
থ্যাংক ইউ।
তোমার জন্ম কি দেশে হয়েছিল?
হ্যাঁ। মিটফোর্ড হাসপাতালে।
আমার ধারণা, তোমার জন্য বিদেশে।
যতই দিন যাবে, দেখবে, আমার সম্পর্কে তোমার বেশির ভাগ ধারণাই ভুল।
আজ যে তোমার জন্মদিন আগে বললে না কেন?
আগে বলব কি করে? আমার নিজেরই মনে ছিল নাকি? মাছ দেখে মনে পড়ল।
রূপা তরল গলায় হাসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার মন আসলেই খারাপ হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি আজ রাতে আর ঘুম হবে না। এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হবে। জন্মদিনের খবরটা কাল ভোরে দিলেও অনিদ্রার হাত থেকে বাঁচতাম।
রূপার বাবা ভদ্রলোককে যতটা খারাপ শুরুতে ভাবছিলাম এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলোক হয়তো ততটা খারাপ নন। জন্মদিন মনে রাখছেন, বিশাল মাছ পাঠাচ্ছেন। তবে আমার ধারণা, ভদ্রলোকের সীমা ঐ মাছ পর্যন্তই। কন্যার প্রতি ভালবাসার আর কোনো কোনো লক্ষণ এখনো তিনি দেখাননি। বেশির ভাগ সময়ই তার কাটে দেশের বাইরে। কিছু দিনের জন্যে দেশে আসেন। টেলিফোন করেন। মেয়ের সঙ্গে খুবই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা হয়। এই পর্যন্তই।
আমাদের বাড়িতে রূপাকে কেউ পছন্দ করে না। শুধু লাবণ্য পছন্দ করে। রূপার মতো লাবণ্যেরও ঘুম-রোগ আছে। ঘুম পেলেই সে রূপার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে।
আমাদের বাড়িতে রূপাকে সবচে বেশি অপছন্দ করে মতির মা। সে সবসময়ই গলা নিচু করে মাকে কিংবা মুনিয়াকে রূপ সম্পর্কে গুজগুজ করে কি সব যেন বলে। একদিন আমি খানিকটা শুনলাম আম্মা, গরীব মানুষ, আপনেরে একটা কথা কই কিছু মনে নিয়েন না। দোষ হইলে ক্ষ্যামা দিয়েন। কথাটা হইল নয়া বৌরে নিয়া।
মা গম্ভীর গলায় বললেন, কি কথা?
নয় বৌ-এর সাথে জ্বীন থাকে আম্মা। দুনিয়ায় যারা খুব সুন্দর মাইয়া তারার সাথে দুইটা তিনটা কইরা পুরুষ জ্বীন থাকে।
চুপ কর তো।
জানি আম্মা, আমার কথা শুনলে রাগ হইবেন। কিন্তু কথা সত্য। জ্বীনের সব লক্ষণ নয়া বৌ-এর আছে—এই যে রাইত দিন ঘুমায়, এর কারণ কি? কারণ একটাই। কইন্যা ঘুমের মইধ্যে থাকলে জ্বীন ভূতের জন্যে খুব সুবিধা।
এই জাতীয় কথা দাঁড়িয়ে শোনা অসম্ভব। আমি বাকিটা শুনিনি। তবে মা নিশ্চয়ই শুনেছেন। কিছুটা বিশ্বাসও করেছেন। মানুষ সত্যের চেয়ে অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। মুনিয়ার কথাই ধরা যাক, সে একটি চমৎকার মেয়ে। তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। লোকজনকে বলেছে স্ত্রীর চরিত্রহানি ঘটেছিল, সম্পর্ক ছিল অন্য একজনের সঙ্গে। লোকজন এই অসত্যটাই বিশ্বাস করেছে। শুধু লোকজন কেন, আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদেরও সে-রকম ধারণা। অসত্য বৃক্ষের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। অসত্য বৃক্ষকে সে কারণেই সহজে উপড়ে ফেলা যায় না।
সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে
রূপা বলল, তুমি কি আমাকে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে? কিছু জিজ্ঞেস করার সময় রূপা কখনো চোখের দিকে তাকায় না। প্রশ্নটা করছে আমাকে, অথচ সে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। শুরুতে খুব বিরক্তি লাগত। এখন লাগে না। বরং মনে হয় এটাই স্বাভাবিক।
আমি রূপার প্রশ্নের জবাব দিইনি। গভীর মনোযোগে খবরের কাগজ পড়ছি, এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করছি।
কথা বলছ না কেন, আমাকে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে?
পারব।
তাহলে চট করে প্যান্ট পরে নাও। লুঙ্গি পরে নিশ্চয়ই যাবে না। শেভ করো। দুদিন ধরে শেভ করছ না।
আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে আঁৎকে উঠলাম। দুদিন শেভ না করায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। থুতনির কাছে চার পাঁচটা দাড়ি আবার শাদা। শাদা দাড়িগুলোর কল্যাণে চেহারায় প্রবীণ ভাব চলে এসেছে। শেভ করা মানে প্রবীণ ভাব বিসর্জন দেয়া, এটা কি ঠিক হবে? চেহারায় বুড়োটে ভাব আমার ভালই লাগে। বুড়ো লোকগুলো যখন চুলে কলপ দিয়ে, রঙচঙা শার্ট পরে তরুণ সাজতে চায় তখন অসহ্য লাগে। ইচ্ছা করে হাসতে হাসতে বলি, পঞ্চাশ ক্রশ করেছেন না? মৃত্যুর কিন্তু দেরি নেই, খুব বেশি হলে আর মাত্র দশ বছর। রঙচঙা জামা পরছেন, ভালো করছেন। শখ মিটিয়ে নেয়াই ভাল।