মার মন গলল না। তাঁর এক কথা–বাড়িতে আমি চোর রাখব না। আমাদের পরম করুণাময়ী মাতা চোর বিদায় করে দিলেন।
চোর বিদায়ের কথা তুলব, না অন্য কোনো প্রসঙ্গ তুলব বুঝতে পারছি না। চোর বিদায়ের প্রসঙ্গ তোলা ঠিক হবে না, কারণ এতদিন আগের কথা মার মনে নেই। তাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ। নামতা পৰ্য্যন্ত মনে থাকে না। ঐ দিন কি একটা জিনিসের দাম ঠিক করতে গিয়ে নামতা গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমাকে বললেন, সাত আট কত রে রঞ্জু? আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম বাহান্ন। মা বাহান্ন স্বীকার করেই চলে গেলেন। কাজেই চুরির প্রসঙ্গ থাক। অন্য কোনো প্রসঙ্গে আক্রমণ শুরু করা যাক।
মা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঐ মোড়টায় বোস না।
আমি বসলাম। মা বললেন, তোর বাবা ঐ দিন বলছিলেন, রঞ্জুর যা স্বভাব, ও কোনো চাকরি-বাকরি করবে বলে তো মনে হয় না। ওকে একটা ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়। কি রে, করবি ব্যবসা? বিয়েটয়ে করেছিল, এখন রোজগারের কথা চিন্তা করবি না? তোর শ্বশুর তো বিরাট পয়সাওয়ালা লোক, ওঁকে বল তোকে কোন একটা ব্যবসা শুরু করিয়ে দিতে।
আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম, শিগগিরই বলব।
কোনো একটা ব্যবসা-টবসা শুরু করলে মন ভাল থাকবে। দিন-রাত ইজিচেয়ার শুয়ে থাকা তো কাজের কথা না।
তা তো ঠিকই।
তোর বাবা বলছিলেন—বিনা কারণে একটা মানুষ দিন রাত শুয়ে থাকে কি ভাবে?
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, বিনা কারণে শুয়ে থাকিনা তো। শুয়ে শুয়ে ভাবি। কি ভাবিস?
একটা খুন করার কথা ভাবছি।
কি বলছিস তুই?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি কথা বলছি মা।
কাকে খুন করবি?
সেটা এখনো ফাইনাল করিনি।
রূপাদের বাড়ি থেকে একটা মাছ এসেছে
রূপাদের বাড়ি থেকে একটা মাছ এসেছে। তার আকৃতি হুলস্থূল ধরনের। মাছ বললে এই জলজ প্রাণীটির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হয় না। মৎস্য বললে কিছুটা হয়। সেই মৎস্য দুজন ধরাধরি করে বারান্দায় এনে রাখল। আমাদের বাসার সবারই হতভম্ব হয়ে যাওয়া উচিত ছিল—কেউ হতভম্ব হলাম না। বরং সবাই এমন ভাব করতে লাগলাম, যেন খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের বাসার অলিখিত নিয়ম হচ্ছে–রূপাদের প্রতিটি কার্যকলাপে আমরা বিরক্ত হবো। রূপাদের কোনো আত্মীয় টেলিফোন করলে আমরা শুকনো গলায় বলব, এখন কথা বলতে পারছি না, খুব ব্যস্ত, পরে করুন। এরপর আর টেলিফোন করা উচিত নয়। তবু যদি লজ্জার মাথা খেয়ে কেউ করে, তখন বলা হয়, বাসায় নেই। কখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না।
রূপার চাচা কিছুদিন আগে এসেছিলেন। তাঁকে বসার ঘরে একা একা ঘণ্টখানিক বসিয়ে রাখা হল। আমাদের কাজের ছেলের হাতে চা পাঠিয়ে দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত বাবা অবশ্যি দেখা করতে গেলেন। কয়েকবার হাই তুলে বললেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসার বেড়েছে। আজ আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। আরেকদিন আসুন। চ-টা খেয়েছেন তো?
প্রকাণ্ড পাংগাশ মাছ বারান্দায় পড়ে আছে। সবাই বিরক্ত মুখে দেখছে। শুধু আমাদের বেড়ালটা মনের আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না, লাফঝাঁপ দিচ্ছে। বেড়ালটাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি যে ও বাড়ির কোনো কিছুতেই এত আনন্দিত হতে নেই। আমার মা ক্রু কুঁচকে বললেন, এই মাছ এখন কে কাটবে?
যে লোক মাছের সঙ্গে এসেছে, সে হাসিমুখে বলল, আম্মা, মাছ কাটার লোক সঙ্গে নিয়ে এসেছি, বটিও এনেছি। আগে সবাই দেখুন, তারপরে কাটার ব্যবস্থা হবে।
মাছ কাটার লোক কোথায়?
গাড়িতে বসে আছে আম্মা, সবাইকে ডাকুন, সবাই দেখুক।
মা বললেন, এত দেখাদেখির কি আছে? বড় মাছ কি আমরা আগে দেখিনি?
লোকটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, অবশ্যই দেখেছেন আম্মা, অবশ্যই দেখেছেন। এই মাছটার ওজন হল এক মণ। এক সের কম এক মণ। ঊনচল্লিশ সের। আপাকে ডাকেন। আপা দেখুক, স্যার বলে দিয়েছেন। আপাকে না দেখিয়ে মাছ যেন কাটা না হয়।
রূপাকে ডাকা হল। সে মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ, কি অদ্ভুত সুন্দর! রূপার পাতের মতো ঝিকমিক করছে।
আমি দোতলায় উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, মানুষের সৌন্দর্যবোধের নানা দিক আছে। মাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে কেটেকুটে আমরা খেয়ে ফেলছি। এর কোনো মানে হয়!
রাতে খেতে বসে রূপা বলল এ কি, বড় মাছটা রান্না হয়নি?
মুনিয়া বলল, না।
না কেন?
ডীপ ফ্রীজে রেখে দেয়া হয়েছে। পরে রান্না হবে। আমাদের নিজেদের বাজার রান্না করা হয়েছে।
রূপা আর কিছু বলল না, কিন্তু তার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা দূর হল না। বড় মাছটা রান্না হয়নি, এটা সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আমি বললাম, পাংগাশ মাছ কি তোমার খুব প্রিয়?
রূপা বলল, পাংগাশ মাছ প্রিয় হবে কেন? কোনো মাছই আমার প্রিয় না। ইলিশ মাছের ডিম খানিকটা প্রিয়।
তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মাছটা রান্না না হওয়ায় আপসেট হয়ে পড়েছ।
আপসেট হবার কারণ আছে বলেই আপসেট হচ্ছি। তুমি যদি শোন, তুমিও আপসেট হবে। এই জন্যেই তোমাকে শোনাব না। কেন আপসেট হচ্ছি, পরশু বলব।
এখনি বলে।
না।
রূপা খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। তার মন খারাপ ভাব স্থায়ী হল না। ঘরে ঢুকেই গান চালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাজগোজ করলে কেমন হয়? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, রাত এগারোটায়!
হুঁ। রাত এগারোটায় সাজা যাবে না, এমন তো কোনো আইন নেই। আর এ রকম আইন থাকলেও আমি মানতাম না। আচ্ছা শোন, তুমি কি মানবেন্দ্রের ঐ গানটা শুনেছ, ওগো সুন্দরী আজ অপরূপ সাজে, সাজো সাজো সাজো…