ভাল থাক, এই শুভ কামনা। সব বাবার মতো আমিও তোমার মঙ্গল কামনাই করছি। তোমার বাইশ বছরের জীবনে আমি তোমার প্রতি ভালবাসার কোনো অভাব দেখাইনি। আমাকে তোমার অসহ্য বোধ হয়েছে জানার পর আমি তোমাকে অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তোমার মার মৃত্যুর পর আমি অনায়াসে। আরেকটি বিয়ে করতে পারতাম। তা করিনি। তোমার অযত্ন হবে, অবহেলা হবে, এই ভেবেই করিনি। তুমি আমার সেই ভালবাসা তুচ্ছ করেছ। এই স্বভাবও তুমি পেয়েছ তোমার মার কাছ থেকে। তোমার মা বেঁচে থাকলে হয়ত সে বলত—রূপা, তুমি যা করেছ ভালই করেছ। আমি তা বলতে পারছি না। যাই হোক, শেষ কথাটি বলছি—আমার বাড়ির দরজা তোমার জন্যে সব সময় খোলা থাকবে তোমার সব আশ্রয় নষ্ট হবার পর যদি ফিরতে ইচ্ছা করে ফিরতে পারবে।
–তোমার বাবা।
প্রথমে ভেবেছিলাম, রূপা ইচ্ছা করেই এই চিঠি টেবিলে ফেলে রেখেছে যাতে আমি পড়তে পারি। সেই ধারণা ঠিক না। রূপার স্বভাবই হচ্ছে এলোমেলো অগোছালো। গোসলখানায় গোসল করতে গিয়ে সে গলার হার খুলে রেখে এসেছিল। মুনিয়া তাতে খুব হৈচৈ করছিল। রূপা অবাক হয়ে বলেছে–সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত হৈচৈ কেন? মুনিয়া বলল, ঘরে তিনটা কাজের লোক, যদি চুরি হত? রূপা বলল, চুরি হলে কি আর করা। এম্নিতেও তো অনেক সময় হারায়। হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়ে।
দামী একটা হার হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়বে?
দামী হার গলা থেকে খুলে পড়তে পারবে না এমন কোনো আইন তো নেই মুনিয়া। মানুষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়, আর সামান্য গলার হার।
মুনিয়ার ধারণা, এসব হচ্ছে রূপার চালবাজি কথা। আমি জানি চালবাজি কথা না। সে যা ভাবছে তাই বলছে। মন রেখে কথা বলার বিদ্যা এখনো বোধহয় শিখে উঠতে পারেনি।
আমি ইজিচেয়ারে বসে আছি। হাতে গতকালকের পত্রিকা। পত্রিকা রেখেছি। পড়ার জন্যে না। মুখ আড়াল করে রাখার জন্যে। মুখ আড়াল করে আমি রূপার কথা শুনছি।
রূপা লাবণ্যের সঙ্গে লুডু খেলতে খেলতে কথা বলছে। ভাঙা ভাঙা কথা, যা একমাত্র ছোটদের সঙ্গেই বলা যায়।
লাবণ্য সোনা, এই নাও চার চাললাম। ওয়ান টু থ্রী ফোর। তোমার দুই হয়েছে, তুমি দুই চালবে। উঁহু, তুমি উল্টোদিকে চলেছ। সব খেলার নিয়ম আছে। যে খেলার যে নিয়ম সেই খেলা সেই ভাবে খেলতে হয়। উল্টো খেলা যায় না। আমি কি বলছি তুমি কি বুঝতে পারছ লাবণ্য?
পারছি।
ভেরি গুড। ছোটরা খুব সহজে জটিল জিনিস বোঝে। বড়রা বুঝতে চায় না। বুঝিয়ে দিলেও ভাব করে যে বোঝেনি। ছোট থাকাই ভাল। তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি কি ছোট থাকতে চাও?
চাই।
কিন্তু ছোট থাকার সমস্যাও আছে। ছোটরা নিজেদের পছন্দমতো জিনিস কখনো পায় না। তাদের চলতে হয় বড়দের পছন্দে। যেমন ধর, আমি এখন চা খাব। তুমি খাবে না।
আমিও পিরিচে ঢেলে চা খাব।
আচ্ছা, দেয়া হবে। যাও, চায়ের কথা বলে আস।
লাবণ্য চায়ের কথা বলতে উঠে গেল। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গতকাল সন্ধ্যায় তোমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা হল। ছাদে গিয়েছিলাম, সে রীতিমতো ধমক দিল—গাল ফুলিয়ে বলল, এখানে কি করছেন?
আমি বললাম, হাঁটছি।
সে বলল, সন্ধ্যাবেলা হাঁটছেন কেন?
আমি বললাম, সন্ধ্যাবেলা হাঁটা কি নিষিদ্ধ?
ছাদে হাঁটা নিষেধ। আমার ডিসটার্ব হয়। পড়াশোনা করছি—এক মাসও নেই। পরীক্ষার। ছাদে কেউ এলেই আমি ডিসটার্বড ফিল করি।
আমি বললাম, আমি ছাদে হাঁটতে এসেছি, আপনি পড়ছেন—এতে আমিও ডিসটার্বড ফিল করছি। ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না। আপনি বরং এক কাজ করুন, বই নিয়ে নিচে চলে যান, আমার হাঁটা শেষ হলে আবার আসবেন।
আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি মুনিয়ারও ছোট।
ও আচ্ছা। বুড়োদের মত দেখাচ্ছে বলে আপনি বলছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি সবার বড়।
আমার গত ডিসেম্বরে ২৫ হয়েছে।
ডিসেম্বরের কত তারিখ?
২৩শে ডিসেম্বর।
ঠিক আছে, পড়াশোনা করতে থাক, আমি নিচে যাই। এই বলে আমি নিচে চলে এলাম। তোমরা ছিটগ্রস্ত পরিবার। তোমার ভাইয়েরও তোমার মতো ব্রেইন এলোমেলো।
আমি বললাম, আমার ব্রেইন কি এলোমেলো?
হ্যাঁ। এক ঘণ্টা ধরে বাসি একটা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে আছ। সারাক্ষণ দেখি ইজিচেয়ারটায় বসে আছে। কি আছে এই চেয়ারটায়?
কিছু নেই।
তাহলে বসে থাক কেন?
বসে থাকতে ভাল লাগে, তাই বসে থাকি।
তোমার এই উত্তর আমার পছন্দ হয়েছে। যা করতে তোমার ভাল লাগে তা। অবশ্যই করবে। কে কি বলছে বা বলছে, না তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কারণ। একটা জিনিস মনে রাখবে—তুমি আছ বলেই এই পৃথিবী টিকে আছে। তুমি নেই পৃথিবীও নেই।
আমার কাছে নেই। অন্যের কাছে তো আছে।
অন্যের কাছে থাকলে তোমার কি? তোমার কিছু যাচ্ছে আসছে না। শোন, তোমার যা ভাল লাগে তুমি করবে। আমি কখনো বাধা দেব না। ঠিক একইভাবে আমি আশা করব আমি যা করব তা আমাকে করতে দেবে। বাধা দেবে না। এই একটা ব্যাপার ঠিক করে নিলে আমাদের কখনো কোনো সমস্যা হবে না।
এইসব কথা তুমি কি তোমার মার কাছে শিখেছ?
হ্যাঁ। তিনি কি সব সময় তোমাকে উপদেশ দিতেন?
মোটেও উপদেশ দিতেন না। তিনি তাঁর সব উপদেশ একদিন দিলেন। তাঁর উপদেশ দেয়ার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। শুনতে চাও?
চাই।
আমার তখন বয়স বার। ঘুমুচ্ছি। রাত দুটার মতো বাজে। মা এসে আমাকে ডেকে তুললেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার? মা বললেন–কফি খাবার জন্য ডাকলাম। আমি বললাম, রাত-দুপুরে কফি খাব কেন? মা বললেন, রাত-দুপুরে কফি খাওয়া যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই লিটল ডার্লিং।