খেতে ইচ্ছা করলে কিনে ফেল।
দুজন দুটা আমড়া কিনে খেতে খেতে যাই। কি বলিস?
আচ্ছা।
দুটা আমড়া কেনা হত। বাবা আমড়ায় কামড় দিয়েই বলতেন–
বরিশালের আমড়া
বসে বসে কামড়া।
বেলুনওয়ালাকে রাস্তায় দেখা গেলে বাবা অতি অবশ্যি রিকশা থামিয়ে বলবে–দেখি আমাদের দুজনকে দুটা বেলুন দাও তো। অনেক দিন আমি বেলুন নিয়ে খেলি না। খেলতে ইচ্ছা করছে।
কত রকম মজা যে বাবা করে। রিকশায় যাবার সময়ও মাঝে মাঝে তাকে ঘাড়ে বসিয়ে রাখে। হাসতে হাসতে বলে, লোকজন কি রকম অবাক হয়ে তাকাচ্ছে দেখ রে নুহাশ–সবাই ভাবছে এই মেয়েটি এত লম্বা হল কি করে?
আমার ভয় করছে বাবা।
বেশি ভয় করছে?
হু।
আমি কি শিখিয়ে দিয়েছি? ভয় পেলে কি করতে হয়?
একটা গান গাইতে হয়।
তাহলে সেই গানটা গলা ছেড়ে গেয়ে ফেল।
আমার লজ্জা করছে বাবা।
লজ্জা করার কিছু নেই। আচ্ছা, আমিও গাচ্ছি। আমার সঙ্গে গাইলে আর লজ্জা করবে না।
দুজন এক সঙ্গে গাইতে থাকল–
দূর কর দূর কর
দূর কর ভয়।
দূর কর হে
দূর কর হে…
মার সঙ্গে বেরুলে এরকম কোন মজা নেই। চটপটি খেতে ইচ্ছা করলে–মাকে বললে লাভ হবে না। মা বলবে, এসব খেতে হয় না মা। চটপটি ভর্তি থাকে জীবাণুতে। কিলবিল করতে থাকে জীবাণু। নোংরা কুৎসিত সব জীবাণু।
ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছা করলে মা বলবে-তাকিয়ে দেখ ঝালমুড়িওয়ালার হাতগুলি কি ময়লা। সে তার ময়লা হাতে মুড়ি মেখে দেবে। ঐ মুড়ি খেলেই অসুখ হবে।
তারপরেও অবশ্যি মার সঙ্গে বেড়াতে যাবার অন্য রকম মজা আছে। মা এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। কি যে ভাল লাগে। এত আনন্দ হয়।
.
ডাক্তার সাহেব বললেন, তারপর খুকী, তোমার কি নাম?
নুহাশ।
বাহ্ কি সুন্দর নাম! দেখি খুকী, জিভটা বের কর তো।
নুহাশ জিভ বের করল। ডাক্তার সাহেব বললেন, নুহাশ নামের মানে কি খুকী?
কি অদ্ভুত ডাক্তার, জিভ বের করিয় প্রশ্ন করছে, নুহাশ নামের মানে কি? জিভ বের করে রেখে কেউ কি কথা বলতে পারে? ডাক্তার সাহেব নিজে পারবেন?
কি খুকী, নামের অর্থ বলতে পারছ না কেন?
নুহাশ জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে বলল, নুহাশ শব্দের অর্থ হল–কম দামী ধাতু।
কম দামী মানে?
লোহা, পিতল এইসব …
ডাক্তার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ধাতুর নাম যদি রাখতেই হয় তাহলে রাখা উচিত দামী দামী ধাতুর নামে। যেমন প্লাটিনাম, সোনা, রূপা … খুকী জিভ ভেতরে ঢুকিয়েছে কেন? জিভ বের কর। কে রেখেছে এই নাম?
নুহাশ বলল, আমার বাবা রেখেছেন।
আহা, আবার জিভ ভেতরে ঢুকালে। বাচ্চাদের নিয়ে এই যন্ত্রণা। কথা শুনতে চায় না।
ডাক্তার সাহেব নানান ধরনের পরীক্ষা করলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন–হাঁটুতে ব্যথা হয় কি-না। গভীর রাতে খিদে পায় কি-না। চোখ দিয়ে পানি পড়ে কি-না। ঠোঁট শুকিয়ে যায় কি-না। শেষমেশ বললেন, আমি তো তেমন কিছু পাচ্ছি না।
রেবেকা বলল, হঠাৎ হঠাৎ জ্বর আসে। আকাশ-পাতাল জ্বর।
ডাক্তার বললেন, আকাশ-পাতাল জ্বর আবার কি?
অনেক বেশি জ্বর। একশ চার। একশ পাঁচ।
আমি কিছু টেস্টের কথা লিখে দিয়েছি। থরো চেক আপ হোক। কোন একটা ভাল জায়গা থেকে টেস্টগুলি করাবেন। ব্যাঙের ছাতার মত ল্যাবোরেটরি গজিয়েছে। এজনের টেস্টের সঙ্গে আরেকজনের টেস্টের মিল নেই। আমাদের চিকিৎসা করতে হচ্ছে অনুমানে। আপনি টেস্টগুলি করিয়ে দিন পনেরো পরে আসুন। ও কি, খুকী তুমি এখনো জিভ বের করে আছ কেন?
নুহাশ বলল, আপনি তো জিভ ভেতরে ঢুকাতে বলেন নি।
ডাক্তার সাহেব হো হো করে হেসে ফেললেন। নুহাশ মনে মনে বলল, আজ সারাদিনে একজনকে মাত্র হাসাতে পেরেছি। কোন রকমে আরো দুজনকে যদি হাসানো যেত তাহলে চমৎকার হত।
রাস্তায় নেমে রেবেকা বললেন, কিছু কিনতে ইচ্ছে করছে নুহাশ?
না।
ইচ্ছা করলে বল। চকলেট? চকলেট খেতে ইচ্ছা করছে?
হু।
রেবেকা তিন শ টাকা দিয়ে এক টিন কেডবেরিজ চকলেট কিনল। আজ সে বেতন পেয়েছে। বেশ কিছু টাকা ব্যাগে। নুহাশের জন্যে কখনো তেমন কিছু কেনা হয় না। অসুস্থ মেয়ে…
রিকশায় উঠে রেবেকা বলল, টিনটা খুলে একটা মুখে দাও মা।
নুহাশ বলল, বাবাকে নিয়ে খুলব।
বাবাকে কি তোমার বেশি ভাল লাগে মা?
নুহাশ চুপ করে রইল। বাবাকে তার আসলেই অনেক বেশি ভাল লাগে। কিন্তু মাকে এই কথা বললে মা মন খারাপ করবে।
নুহাশ, কথা বলছ না কেন? বাবাকে কি তোমার বেশি ভাল লাগে?
না।
আমাকে বেশি ভাল লাগে?
না।
তাহলে কি দাঁড়াল? কাউকেই ভাল লাগে না?
দুজনকে সমান সমান ভাল লাগে।
দেখ মা, তুমি এখন কথা বলছ ডিপ্লোমেটের মত। ডিপ্লোমেট কি জান তো? ডিপ্লোমেট হচ্ছে রাজনীতিবিদ। এরা কি করে? এরা সবাইকে খুশি করতে চায়। তোমার যা বয়স তাতে সবাইকে খুশি দরকার নেই। তুমি যদি তোমার বাবাকে বেশি ভালবাস তাহলে সেটা বলবে। সত্যি কথা বলার অপরাধে তো তোমাকে আমি শাস্তি দেব না।
আমি তোমাকেই বেশি ভালবাসি মা।
তোমার বাবাকেও নিশ্চয়ই তুমি একই কথা বর। তাকেও নিশ্চয়ই তুমি বল-তোমাকেই আমি সবচে বেশি ভালবাসি বাবা।
না, বলি না। তুমি সব সময় জানতে চাও কাকে বেশি ভালবাসি। বাবা কখনো জানতে চায় না।
জানতে চাইলে বলতে?
হু।
তাহলে কি মিথ্যা কথা বলা হল না? একই সঙ্গে কি দুজনকেই বেশি ভালবাসা যায়?
যায়।
রেবেকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, শোন নুহাশ, আজ রাতে তোমাকে কিছু জরুরী কথা বলা হবে। তুমি চকলেট খেতে খেতে খুব মন দিয়ে কথাগুলি শুনবে।