ওর নাম আমি জানি না। ওকে সবাই মুনার-মা ডাকে।
মুনা’স মাদার? ভাগ্য ভাল সে আমার বাড়িতে চাকরি করছে না। আমার বাড়িতে চাকরি করলে এতক্ষণে চাকরি নট হয়ে যেত।
মুনার-মা চায়ের কাপ ট্রেতে সাজিয়ে ঢুকল। সে ডাক্তার সাহেবের জন্যে এতক্ষণ চা বানাচ্ছিল। ডাক্তার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তোমাকে বলা হয়েছে রুগীর মাথায় পানি ঢালতে। তুমি বানাচ্ছ চা। তুমি নিতান্ত ভাগ্যবতী যে আমার বাড়িতে চাকরি করছ না। আমার বাড়িতে চাকরি করলে এতক্ষণে তোমার চাকরি নট হয়ে যেত। চা-টাও তো ভাল হয় নি। ঠাণ্ডা হয়ে আছে। এখনো চা বানানো শেখ নি? তাহলে এতদিনে কি শিখেছ?
ডাক্তার সাহেব এক চুমুকে চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, রাত দশটার মধ্যে এই মেয়ের বাবা-মা না ফিরলে তুমি এক দৌড়ে আমাকে খবর দেবে। আমি রাত এগারোটা পর্যন্ত চেম্বারে থাকি। মনে থাকবে?
জ্বি-থাকব।
এখন আর দেরি না করে পানি ঢালা শুরু কর। খুকী আমি যাচ্ছি।
নুহাশ খুব উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। যা রাগী ডাক্তার। বাবা মা রাত দশটার মধ্যে না এলে তাঁকে খবর দিতে হবে। তিনি এসে বাবা মার সঙ্গে হয়ত একটা ঝগড়াই বাঁধিয়ে বসবেন।
.
নুহাশের মা রেবেকা এগারোটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে বাসায় ফিরল। অসুস্থ মেয়েকে ফেলে এতক্ষণ বাইরে থাকতে তার নিজেরই খারাপ লাগছিল। বাধ্য হয়ে থাকতে হয়েছে। ভদ্রলোক খাবারই দিয়েছেন দশটার পর।
রেবেকা সব সময় ঘরে ঢুকেই কিছুক্ষণ মুনার মার সঙ্গে ঝগড়া করে। কেন ঘর পরিষ্কার হয় নি? কেন আলনা অগোছালো? মেঝেতে ধুলা কেন? চায়ের কাপটা কাত হয়ে আছে কেন? চেয়ারের উপর ভেজা তোয়ালে কেন?
আজ রেবেকা ঝগড়া করল না। নুহাশের খুব জ্বর এসেছিল শুনে চুপ করে গেল। নুহাশের ঘরে ঢুকে তার কপালে হাত রাখল। নুহাশ জেগেই ছিল। কিন্তু ভান করল যেন সে গভীর ঘুমে।
কই জ্বর তো নাই।
মুনার-মা বলল, এখন কমছে। মাথাত পানি ঢালছি। তারপরে ডাক্তার সাব অষুধ দিছেন।
ডাক্তার সাব অষুধ দিয়েছেন মানে। ডাক্তার পেলে কোথায়?
আমি খবর দিয়া আনছি আম্মা। পাড়ার ডাক্তার।
আলগা মাতব্বরি কর কেন মুনার-মা? তোমাকে আলগা মাতব্বরি করতে কে বলেছে?
জ্বর খুব বেশি ছিল আম্মা।
পানির মত ঠাণ্ডা গা। বলে জ্বর বেশি ছিল। কাকে না কাকে ডেকে নিয়ে এসছে। আমি লক্ষবার বলেছি–আমরা বাসায় না থাকলে কোন বাইরের লোক যেন ঘরে না ঢুকে। তোমাকে কি এই কথা অসংখ্যবার বলা হয় নি?
জে আম্মা বলছেন–আফার জ্বর দেইখ্যা আমরার মাথা গেল আউলাইয়া।
চট করে মাথা আউলানো ভাল না। বড় ডাক্তার নুহাশের চিকিৎসা করছেন। মাঝখান থেকে অন্য একজন এসে কি-না-কি অষুধ দিয়েছে–
অষুধ ভাল দিছে আম্মা। খাওনের পরে পরে জ্বর কমতির দিকে।
আমার সামনে থেকে যাও তো মুনার-মা। মুখে মুখে কথা বলবে না। নুহাশের বাবা আসে নি?
জ্বে-না।
কোন খবর পাঠায় নি?
জে না।
রেবেকার মুখ পাথরের মত হয়ে গেল। গলার স্বর হল হিমশীতল। নুহাশের মনে হল আজ রাতে বাবা-মার মধ্যে ভয়ংকর একটা ঝগড়া হবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঝগড়াটা আজ তাদের বাসায় হবে। অবশ্যি বাবা কিছুই বলবেন না, চুপ করে শুনবেন, মাঝে মাঝে দুএকটা হাসির কথা বলে মাকে হাসাবার চেষ্টা করবেন। বাবার জন্যে নুহাশের খুব খারাপ লাগতে শুরু করল।
.
মিনহাজ উদ্দিন এক হাতে দুটা আনারস ঝুলিয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় শিস দিতে দিতে বাড়ি ফিরল। রেবেকা যে কাপড় পরে বাইরে গিয়েছিল সেই কাপড় এখনো বদলায় নি। হাত-মুখ ধোয়নি। চোখ-মুখ কঠিন করে সে। স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছে। কলিং বেল বাজতেই সে নিজেই উঠে দরজা খুলল। মিনহাজ আনন্দিত গলায় বলল, ওরে বাপরে, আজ দেখি তোমাকে পরীর মত লাগছে। সবুজ শাড়িটা তো আগে কখনো দেখি নি। খুব সুন্দর।
রেবেকা কিছু বলল না। মিনহাজ আনারস দুটি রাখতে রাখতে বলল, আসল জলডুবি। মধুর চেয়ে এগারো গুণ বেশি মিষ্টি। এই আনারস খাবার পর রসগোল্লা খেলে পানসে লাগবে।
রেবেকা বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে। বস এখানে।
মিনহাজ হাসিমুখে বলল, কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ঝগড়া করবে। দূরবর্তী বিপদ সংকেত পাচ্ছি।
রসিকতা করবে না। আমার সামনে বস, আমি কি বলছি মন দিয়ে শোন।
যা বলার দয়া করে আধঘণ্টা পর বল। আধঘণ্টা পরে বললে কি হবে জান? এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। আধঘণ্টা পর বারোটা বাজবে নতুন দিন শুরু হবে। এবং আমি বলতে পারব যে একটা পুরো দিন আমরা ঝগড়া ছাড়া পার করেছি।
নুহাশকে আজ বিকেল পাঁচটায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা ছিল না?
হ্যাঁ, ছিল।
নিয়ে গিয়েছিলে?
মনে হয় নিয়ে যাই নি।
কেন?
বলতে চাচ্ছি না।
কেন বলতে চাচ্ছ না?
নুহাশকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে যাবার কারণ বলার সঙ্গে সঙ্গে তুমি খুব লজ্জা পাবে। এই জন্যে বলতে চাচ্ছি না।
কারণটা বল।
রেবেকা, না বললেই ভাল হয়। যদি বলি তাহলে তোমার খুব খারাপ লাগবে। এই ভেবে খারাপ লাগবে যে কেন সব না জেনেই রাগ করলাম। যাই হোক, জানতে চাচ্ছ যখন বলি–আমি বদরুলের মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তোমাকে তো আগেই বলা হয়েছে বদরুলের মা গত একমাস ধরে মরার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। আজরাইল এর মধ্যে চার-পাঁচ বার এসেছে-মুখ বেজার করে ফিরে গেছে। আজরাইলের মত ক্ষমতাধর একজন ফেরেশতাকে যদি নব্বই বছরের একজন বৃদ্ধাকে নেবার জন্যে এতবার আসেত হয় তাহলে …