ঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বরফের মতো ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোঁটা। ঠাণ্ডায় ফরহাদ সাহেবের শরীর জমে যাচ্ছে—কিন্তু তার পরেও কানের কাছে গরম লাগছে। সেই সঙ্গে এমন ঘুম লাগছে যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। যেভাবেই হোক কিছুক্ষণ জেগে থাকতেই হবে। পাঁচ ছয় মিনিট জেগে থাকতে পারলেই হবে। রিকশা গলির ভিতর ঢুকে পড়েছে। গলির মাঝামাঝি একটা নাপিতের দোকান—আশা হেয়ারকাটিং। নাপিতের দোকানের সামনে থেকে বাঁ দিকে আরেকটা গলি বের হয়েছে। সেই গলির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা বড় কাঠগোলাপের গাছ আছে। বিশাল গাছ কিন্তু কোনো ফুল ফুটে না। বাড়ির একটা সুন্দর নাম আছে, নামটা মনে পড়ছে না। নামটা মনে পড়লে খুব লাভ হতো, রিকশাওয়ালাকে বাড়ির নাম বলে ঘুমিয়ে পড়তেন। ফরহাদ সাহেব বাড়ির নাম মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ফুলের নামে নাম। খুবই পরিচিত ফুল। নামের মধ্যেই জঙ্গল জঙ্গল ভাব আছে। নামটা মনে হলেই নাকে ফুলের গন্ধ লাগে এবং কেমন ছায়া ছায়া ভাব হয়। একটা গানেও নামটা আছে। গানটা মনে পড়লেই ফুলের নাম মনে পড়বে। সাত ভাই চম্পা জাগরে। বাড়ির নাম কি চম্পা হাউস? না চম্পা হাউস না, ইংরেজি নাম না, বাংলা নাম। পুরো গানটা যেন কী—
সাত ভাই চম্পা জাগরে
কেন বোন পারুল ডাকরে।
বাড়ির নাম মনে পড়েছে—পারুল কুটির। এই নামটা এতক্ষণ মনে পড়ল। অথচ তার স্ত্রীর নামে নাম। পারুল কুটির নামে জঙ্গল জঙ্গল কোনো ভাব তো নেই। তাহলে কেন মনে হলো জঙ্গল জঙ্গল ভাব? পারুলের ইংরেজি কী? সব ফুলেরই ইংরেজি নাম আছে। গোলাপ—রোজ, যুই—-জেসমিন, পারুলের কি কোনো ইংরেজি নেই? পারুলের ইংরেজি কী ভাবতে ভাবতে ফরহাদ উদ্দিন রিকশার ওপর ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলো। তার চেয়েও বিকট শব্দে ফাটল ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ট্রান্সফরমা’র। এতেও তার ঘুম ভাঙ্গল না।
.
ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যায়। চোখ মেলেই তিনি খুব আরাম পেলেন। নরম ফোমের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। গায়ে ধোঁয়া চাদর। ধোয়াঁ চাদর থেকে আরামদায়ক গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আঙুলগুলি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে সে হাত বুলাবার আগে তার আঙুল ডীপ ফ্রিজে কিছুক্ষণ রেখে ঠাণ্ডা করে আনছে। কনক না-কি? কনকের হাতের আংগুল এরকম ঠাণ্ডা। সে এ বাড়িতে আসবে কীভাবে। না-কি কেউ তাকে খবর দিয়ে এনেছে। ফরহাদ উদ্দিন পাশ ফিরলেন। আর তখনই কে একজন বলল, এখন কি একটু ভালো লাগছে?
তিনি ভালোমতো চোখ মেললেন। অপরিচিত একজন মহিলা বিছানার ডান পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। একজন চেনা মানুষের দেখা পেলে হতো। ভদ্রমহিলা একটু কাছে ঝুঁকে এসে নরম গলায় বললেন, উঠার দরকার নেই। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। এখন কি একটু ভালো লাগছে?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, জ্বি লাগছে।
আমরা তো খুবই ভয় পেয়েছিলাম। ডাক্তার এসে দেখে গেছে। ডাক্তার বলেছে সব ঠিক আছে। ব্লাড প্রেসার সামান্য কম, অতিরিক্ত দুর্বলতা থেকে এরকম হয়েছে। আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি এখন ঠিক আছি।
এরকম কি আগেও হয়েছে?
জ্বি না। সঞ্জু কোথায়?
দুধ নিয়ে আসি, এক গ্লাস দুধ এনে দেই?
জ্বি আচ্ছা।
ভদ্র মহিলা দুধ আনতে গেলেন। ফরহাদ উদ্দিন মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন এতক্ষণ কে কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আশ্চর্য, কেউ নেই। পুরো ব্যাপারটা মনে হয় স্বপ্নে ঘটেছে। স্বপ্নটা আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভালো হতো।
একটা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে ভদ্রমহিলা আবার ঢুকলেন। তাকে আগে যতটা অচেনা লাগছিল এখন তারচেয়েও অচেনা লাগছে। এমন কি হতে পারে যে তিনি ভুল কোনো বাড়িতে ঢুকেছেন? তিনিও এদের চেনেন না, এরাও তাঁকে চেনে না। রিকশা হয়তো অন্য একটা বাড়ির সামনে থেমেছে। বাড়ির লোকজন দয়া করে তাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়েছে। সঞ্জু সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। সঞ্জুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। সে হয়তো শেষ পর্যন্ত আসে নি।
দুধটা খান।
একটু পরে খাই।
ঠিক আছে একটু পরেই খান। আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন।
ভদ্রমহিলা আবারো আগের চেয়ারটায় বসলেন। এবার তাকে একটু যেন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে একটা মানুষকে কিছুক্ষণ চেনা লাগছে আবার কিছুক্ষণ অচেনা লাগছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? ফরহাদ উদ্দিন হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
মিথ্যা সূচক হ্যাঁ মাথা নাড়া ঠিক হয় নি। মুখে মিথ্যা বলাও যা–মিথ্যা মাথা নাড়াও তা। না বলা উচিত ছিল। সেটা অবশ্যি ঠিক হতো না। আত্মীয়স্বজনকে চিনতে না পারা খুবই লজ্জার ব্যাপার। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেই পরিচয় বের হয়ে আসবে। ভদ্রমহিলা বললেন, অনেকদিন পরে দেখা তো এই জন্যে ভাবলাম চিনতে পারেন নি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আপনি ভালো আছেন?
আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?
ও আচ্ছা ঠিকই তো। আপনি করে কেন বলছি। বয়স হয়েছে তো—উল্টাপাল্টা কাজ করি। আপনি তুমি-তে জট পাকিয়ে ফেলি। তুমি ভালো আছ?
জ্বি ভালো।
ছেলেমেয়েরা ভালো?