- বইয়ের নামঃ নীল অপরাজিতা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
তিনি ট্রেন থেকে নামলেন দুপুর বেলা
তিনি ট্রেন থেকে নামলেন দুপুর বেলা।
দুপুর বলে বোঝার কোন উপায় নেই। চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো। বৃষ্টি এখনো নামেনি, তবে যে কোন মুহূর্তে নামবে বলে মনে হয়। আষাঢ় মাসে বৃষ্টিবাদলার কোন ঠিক নেই। এই বৃষ্টি এই রোদ। ময়মনসিংহ থেকে যখন ট্রেন ছাড়ল তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার। জানালার ওপাশে ঝকঝকে রোদ। তিন ঘণ্টা ট্রেনে কাটিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন ঠাকরোকোনা নামের স্টেশনে। কত দূর হবে, চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মাইল! এই অদূরেই আকাশের এমন অবস্থা? না-কি মেঘে মেঘে ময়মনসিংহ শহরও এখন ঢেকে গেছে?
ট্রেন ছেড়ে যাবার পর তাঁর মনে হল ঠিক স্টেশনে নেমেছেন তো? স্টেশনের নাম পড়েন নি। পাশে বসা এক ভদ্ৰলোক বললেন, এটাই ঠাকরোকোনা–নামেন নামেন। তিনিই অতি ব্যস্ত হয়ে জানালা দিয়ে সুটকেস, বেতের ঝুড়ি, হ্যাণ্ডব্যাগ নামিয়ে দিলেন। তাঁর ব্যস্ততার কারণ অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল–এখানে ট্রেন এক মিনিটের জন্যে থামে। জিনিসপত্র সব নামানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। দুটি পানির বোতল ছিল, একটি নামানো হল। অন্যটি রয়ে গেল সিটের নীচে।
স্নামালিকুম। আপনি কি শওকত সাহেব?
তিনি জবাব দিলেন না। অসম্ভব রোগা এবং আষাঢ় মাসের গরমে কালো কোট পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
স্যার আমার নাম মোফাজ্জল করিম। আমি ময়নাতলা হাইস্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার।
মোফাজ্জল করিম সাহেব দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন। মনে হচ্ছে হ্যাণ্ডশেক জাতীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে চান। মফস্বলের লোকজন হ্যাণ্ডশেক করার জন্যে দুটো হাত বাড়ায়। এরা যা করে তাকে পাশ্চাত্যের হ্যাণ্ডশেক বলা যাবে না। প্রক্রিয়াটির নাম খুব সম্ভব মোসাহাবা। যার দ্বিতীয় অংশে আছে কোলাকুলি। এই মুহূর্তে লোকটিকে জড়িয়ে ধরার কোন রকম ইচ্ছা তার হচ্ছে না। তিনি এমন ভাব করলেন যেন বাড়িয়ে দেয়া হাত দেখতে পাননি। মোফাজ্জল করিম সাহেব তাতে খানিকটা অস্বস্তি ঠিকই বোধ করবেন। তবে মফস্বলের লোকরা এই সব অস্বস্তি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।
করিম সাহেব আপনি ভাল আছেন তো?
জি স্যার ভাল। খুব ভাল। আপনার কোন তকলিফ হয় নাই তো? আমি একবার ভেবেছিলাম ময়মনসিংহ থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। ঘরে লোকজন নাই। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন দুই বৎসর আগে ভাদ্র মাসে। সংসার দেখার কেউ নাই। স্যার আপনার মালপত্র সব এইখানে?
জি। তবে একটা পানির বোতল সীটের নীচে রয়ে গেছে।
এ্যাঁ কি সৰ্বনাশ!
মোফাজ্জল করিম দ্রুত স্টেশনের দিকে রওনা হলেন। তার ভঙ্গি দেখে মনে। হল পানির বোতল না, এক বাক্স হীরে-জহরত সীটের নীচে রয়ে গেছে। শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোকটা যন্ত্রণা দেবে। প্রচুর কথা বলবে। কারণে অকারণে এসে সময় নষ্ট করবে। তিনি কুড়ি দিন নিরিবিলিতে থেকে যে কাজটা করতে যাচ্ছেন তা করতে দেবে না। পানির বোতল ট্রেনে রয়ে গেছে শুনে লোকটি স্টেশনের দিকে ছুটে গিয়ে প্রমাণ করল, সে বেআক্কেল ধরনের এবং অতিরিক্ত উৎসাহী। দুটা জিনিসই খুব বিপদজনক।
মোফাজ্জল করিমকে আসতে দেখা যাচ্ছে। শওকত সাহেব আগে লক্ষ্য। করেন নি, এখন লক্ষ্য করলেন লোকটির বগলে ছাতা। ডান বগলে ছাত, সেই হিসেবে ডান হাতটা অকেজো থাকার কথা, দেখা যাচ্ছে লোকটার ডান হাত খুবই সক্রিয়। ছাতাটা যেন শরীরেরই অঙ্গ।
স্যার ব্যবস্থা করে আসলাম।
কি ব্যবস্থা করে আসলেন?
স্টেশন মাস্টারকে বলেছি–সে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দিয়েছে বারহাট্টা। বারহাট্রা স্টেশনে আমার ছাত্র আছে। সে বোতল পাঠিয়ে দিবে।
এত ঝামেলার কোন দরকার ছিল না।
ঝামেলা কিসের স্যার? কোন ঝামেলা না।
আপনি আমাকে স্যার স্যার করছেন কেন?
মোফাজ্জল করিম বিস্মিত গলায় বললেন, স্যার বলব না? আপনি কি। বলেন? এত বড় একজন মানুষ আপনি, এত বড় লেখক। অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমি একবার ভেবেছিলাম স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্রদের নিয়ে আসি।
শওকত সাহেব আঁৎকে উঠলেন। কি ভয়াবহ কথা। এই বিপদজনক মানুষটিই কি তার কেয়ার টেকার হিসাবে থাকবে? মনে হচ্ছে প্রথম দিনেই জীবন
অতিষ্ট করে তুলবে।
স্যার, স্টেশন মাস্টার সাহেব এক কাপ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। চলেন যাই।
চা এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
একটা চুমুক দিবেন। না হলে মনে কষ্ট পাবে। এরা বিশিষ্ট লোকতো কখনো দেখে না। আপনার নামও শোনে নাই। বই পড়াতো দূরের কথা। দোষ নাই কিছু। অজ পাড়া গা জায়গা। স্যার আসেন। জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা করবেন না। লোক লাগিয়ে দিয়েছি। এরা নৌকায় নিয়ে তুলে ফেলবে।
নৌকায় যেতে হয় না-কি?
জি। বেশী সময় লাগে না। দেড় থেকে দুঘন্টা। বাতাস আছে। পাল তুলে দিব–সাঁ সাঁ করে চলে যাব। স্যার চলেন। চটা খেয়ে আসি।
শওকত সাহেব বিরক্ত মুখে রওনা হলেন।
মোটাসোটা থলথলে ধরনের স্টেশন মাস্টার সাহেব বিনয়ে প্রায় গলে পড়ে। যাচ্ছেন। তাঁর চোখে দেব দর্শন জনিত আনন্দের আভা। তিনি তার চেয়ার শওকত সাহবের জন্যে ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা টুলে বসেছেন। অন্য একটা টুলে। চায়ের কাপ, একটা পিরিচে দুটো নিকি। অন্য আরেকটা পিরিচে বানানো পান, পানের পাশে একটা সিগারেট এবং ম্যাচ। আয়োজনের অভাব নেই।