ফরহাদ সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, খেতে ভালো হয়েছিল। খুবই সুস্বাদু হয়েছিল।
রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কী উল্টাপাল্টা কথা বলছ? খেতে ভালো হয়েছে তুমি বুঝলে কীভাবে? তুমি তো মুখেও দাও নি। ভর্তা যেমন পাঠিয়েছিলাম সে-রকম ফেরত এসেছে। তোমার সমস্যাটা কি বলবে? তুমি কি আমাদের কোনো কথাই মন দিয়ে শোন না? সারাক্ষণ কপাল কুঁচকে কী চিন্তা কর?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দেন নি। খুব মন দিয়ে আলুর রুটি খেতে শুরু করেছিলেন। বড় রকমের কোনো ধাক্কা খেলে যে-কোনো একটা কাজ খুব মন দিয়ে করা শুরু করতে হয়। এতে ধাক্কাটা কম লাগে। স্মৃতি সংক্রান্ত জটিলতায় সেদিন তিনি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিলেন। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে তাঁর সবস্মৃতিই এলোমেলো হয়ে গেছে। সবুজ পাথর বসানো রূপার যে হারটা দুলতে দেখেছিলেন সেই হারটাও কি রাহেলার? রাহেলার গলায় এই হার তো কখনো দেখেন নি। রূপার গয়না রাহেলার পছন্দ না। সে বলে—রূপা পরবে ছেলেরা, তাদের হাতে থাকবে রূপার আংটি। সোনা পরবে মেয়েরা। এই কথাগুলি রাহেলার তো? না-কি পরে দেখা যাবে কথাগুলি আসলে বলেছিল পারুল।
খুবই জটিল সমস্যা। কারো সঙ্গে সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। কার সঙ্গে আলাপ করবেন? সবচে ভালো হতো নিজের ছেলের সাথে আলাপ করলে। ছেলের সঙ্গে আলাপ করার সুবিধা হচ্ছে ঘরের কথা ঘরে থাকবে। বাইরে বের হবে না। সঞ্জু খুবই চুপচাপ ধরনের ছেলে। তাকে দেখে মনে হয় সে সারাক্ষণই কিছু ভাবে। বড় হলে হয়তো কবি টবি হবে। তার আত্মীয়স্বজনের বিরাট গুষ্ঠির মধ্যে কোনো কবি সাহিত্যিক নেই। একজন থাকলে ভালোই হয়।
জ্যাম কেটেছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। দিনের আলো ফস করে নিভে গেছে। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। বৎসরের প্রথম বৃষ্টি ভিজতে পারলে ভালো হতো। গায়ের ঘামাচি মরে যেত। বৎসরের প্রথম বৃষ্টিতে থাকে ঘামাচির ওষুধ। বৎসরের শেষ বৃষ্টিতে থাকে চোখ ওঠা রোগের
আল্লাহপাক মানব জাতির জন্যে রোগ যেমন দিয়েছেন, রোগের ওষুধও দিয়েছেন। গাছপালায় ওষুধ দিয়ে পাঠিয়েছেন। বৃষ্টিতে ওষুধ দিয়ে পাঠিয়েছেন। অকাশের মেঘ কনট্রোল করার জন্যে তিনি আলাদা একজন ফেরেশতা রেখেছেন। ফেরেশতার নাম মীকাইল। হযরত মীকাইল আলায়হেস সালাম। তার দায়িত্ব হলো—মেঘ পরিচালনা করা আর মানুষের রুটি-রুজি বণ্টন করা।
টপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি ফরহাদ উদ্দিনের মাথায় পড়ল। তিনি চমকে আকাশের দিকে তাকালেন। বৎসরের প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা যার উপর পড়ে তার উপর আল্লাহপাকের অসীম রহমত। তার একটি ইচ্ছা তৎক্ষণাত পূরণ করা হয়। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যে তার উপরই পড়েছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে পড়তেও তো পারে। যদি পড়ে থাকে তাহলে তার একটি ইচ্ছা পূরণ হবে। দ্রুত কোনো কিছু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। কী চাওয়া যায়? কিছুই মাথায় আসছে না। ফরহাদ উদ্দিন অস্থির বোধ করছেন। নিঃশ্বাসেও খানিকটা কষ্ট হচ্ছে। কানের কাছে গরম লাগছে। শরীর ভারী হয়ে আসছে। খারাপ কিছু ঘটছে না তো। হার্ট এটাক? হার্ট এটাকের সময় বুকে ব্যথা হয়। তার বুকে অবশ্যি ব্যথা হচ্ছে না। তবে তার কেন জানি মনে হচ্ছে এক্ষুণি ব্যথা শুরু হবে। তিনি দুহাতে রিকশার হুড ধরলেন। সঞ্জু পাশে থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। সে শক্ত করে বাবাকে ধরে থাকত। আশেপাশের কোনো রিকশায় সঞ্জুকে দেখা যাচ্ছে না। খুব পানির পিপাসা হচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে তিনি কি বলবেন রিকশা থামিয়ে তাঁর জন্যে পানির একটা বোতল নিয়ে আসতে? ঠাণ্ডা এক বোতল পানি। খানিকটা খাবেন, খানিকটা গায়ে মুখে মাখবেন।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। আরাম লাগছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো হঠাৎ তার শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
তিনি কি রিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন? রিকশায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তাঁর আছে। একবার অফিস থেকে বাড়িতে ফেরার পথে তিনি রিকশায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখেন রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে চায়ের গ্লাসে পাউরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে। তাঁকে জেগে উঠতে দেখে কাছে এসে বলল স্যারের শইল খারাপ? ঘুমাইয়া পড়ছিলেন এই জন্যে রিকশা খাড়া করাইছি। গরম এক কাপ চা খাইবেন?
তিনি শুধু যে চা খেলেন তা না। তাঁর ক্ষিধে লেগেছিল, তিনি রিকশাওয়ালার মতো একটা পাউরুটি নিয়ে ঠিক তার মতোই চায়ে ডুবিয়ে আরাম করে খেলেন। চা-পাউরুটির দাম দিতে গেলেন—রিকশাওয়ালা তাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, দাম দেওন লাগব না। রিকশাওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে তার কিছু বলা উচিত ছিল। তিনি কিছুই বলেন নি। বরং এমন ভাব করেছেন যে প্যাসেঞ্জারের চা-নাশতার পয়সা রিকশাওয়ালা দেবে এটাই স্বাভাবিক। রিকশাওয়ালার সঙ্গে ছয় টাকা ভাড়া ঠিক হয়েছিল, তিনি তাকে ঠিক ছয় টাকাই দিলেন। একটা টাকা বেশি দিলেন না। তবে মনে মনে ঠিক করে রাখলেন—কোনো একদিন তাকে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবেন। ঢাকা শহর এমনই এক শহর যে ঘুরে ফিরে পরিচিত সবার সঙ্গেই কখনো না কখনো দেখা হবে। তখন দাওয়াতটা দিলেই হলো। রিকশাওয়ালার চেহারা তার মনে আছে। বিখ্যাত এক ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে তার চেহারার খুবই মিল আছে—আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। গালভাঙা মুখ, দাড়ি লম্বা। চোখ কোটরে ঢোকা। ঢাকা শহরে হরতালের দিন বোমাবাজিতে কিছু রিকশাওয়ালা মারা যায়। তাদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। ফরহাদ উদ্দিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখেন। আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে তাদের চেহারার কোনো মিল আছে কি-না। যখন দেখেন কোনো মিল নেই তখন স্বস্তি বোধ করেন।