আজ আরেক চৈত্র মাস। তাহলে কি আজ পারুলের মৃত্যুদিবস? সেই উপলক্ষে কোনো আয়োজন? বাদ আছর মিলাদ হবে? ফরহাদ উদ্দিন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন স্ত্রীর মৃত্যুর তারিখ তার মনে নেই। এটা লজ্জারই কথা। সঞ্জুর জন্মের তারিখ মনে আছে। সেখান থেকে হিসাব নিকাশ করে পারুলের মৃত্যুর তারিখ বের করা যাবে। একে বলে ব্যাক ক্যালকুলেশন চট করে করা যাবে না, কাগজ কলম লাগবে।
জ্যামে রিকশা গাড়ি সব আটকা পড়ে আছে। কখন জ্যাম ছুটবে কে জানে। চুপচাপ রিকশায় বসে থাকার চেয়ে মনে মনে অংকটা করার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। সঞ্জুর একবছর আঠারো দিন বয়সে তার মা মারা গেল। মূল ব্যাপার হলো আঠারো দিন। এইআঠারো দিন হয় যোগ করতে হবে কিংবা বাদ দিতে হবে। অংকের সুবিধার জন্য আঠারো দিনটী ধরা যাক পনেরো দিন। তিন হাতে থাকুক। পরে এই তিন হয়তোবা যোগ করতে হবে কিংবা বিয়োগ করতে হবে। ফরহাদ সাহেবের মাথা অল্প মায়ের মধ্যেই জট পাকিয়ে গেল। তিনি হতাশ চোখে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। তখনই সঞ্জুকে দেখলেন। সঞ্জুর রিকশাটা ঠিক তার রিকশার বাম পাশে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছা করলেই তিনি সঞ্জুর রিকশায় উঠে যেতে পারেন। সঞ্জু গম্ভীর চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, এই সঞ্জু!
সঞ্জু তাকাল। বিরক্তিতে তার ভুরু কুচকে গেল।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোর জন্ম তারিখ কবে?
মে মাসের ন’ তারিখ।
ন’ তারিখ থেকে পনরো বাদ দিলে কত হয়?
কী বলছ কিছু বুঝতে পারছি না।
ফরহাদ উদ্দিন হঠাৎ খুশি খুশি গলায় বললেন, এক কাজ কর, আমার রিকশায় চলে আয়।
কেন?
গল্প করতে করতে যাই। তোর সিগারেট খাওয়া তো হয়ে গেছে, নাকি আরেকটা খাবি?
সঞ্জু আবারো গম্ভীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেমেয়ে সব সময় বাবার মতো হয় এটাই নিয়ম। সঞ্জু কার মত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। তার মতো নিশ্চয়ই হয়নি। পারুল গম্ভীর ছিল না। কিংবা কে জানে হয়তো গম্ভীর ছিল। তিনি ভুলে গেছেন। পারুলের বিষয়ে তার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। কিছু কিছু স্মৃতি আবার খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে৷
যেমন পারুল সম্পর্কে তাঁর খুব স্পষ্ট একটা স্মৃতি হচ্ছে বিয়ের পর পর সে যখন ঢাকায় থাকতে এলো তখনকার ঘটনা। সকালবেলা নাশতা খেতে গিয়ে গলায় রুটি আটকে গেল। হাত-পা এলিয়ে চেয়ারে পড়ে গেল, সেখান থেকে মেঝেতে। বাড়িতে তখন তিনি আর একটা কাজের মেয়ে। বেবীট্যাক্সি এনে অতিদ্রুত পারুলকে কোন হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি ছুটে ঘর থেকে বের হতে গেলেন—দরজার কোণায় ধাক্কা লাগে তিনি নিজেই মেঝেতে উল্টে পড়ে অচেতন। যখন জ্ঞান হলো তিনি দেখেন তাকে খাটে শোয়ানো হয়েছে। তার মাথায় পানি ঢালছে পারুল নিজেই। জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্ত এবং জ্ঞান ফিরে পাবার পরের প্রতিটি ঘটনা তার মনে আছে। পারুল যে মুখ টিপে হাসতে হাসতে তার মাথায় পানি ঢালছে এটা তার মনে আছে। পারুলের গলায় সবুজ পাথর বসানো একটা রূপার মালা দুলছিল সেটি পর্যন্ত মনে আছে। এই ঘটনাটা নিয়ে তিনি কখনো কারো সঙ্গে আলাপ করেন নি।
পারুলের মৃত্যুর পর রাহেলাকে বিয়ে করলেন। রাহেলার সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর কোনো গল্প করার প্রশ্নই উঠে না। নাশতার টেবিলে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে পারুলের গলায় রুটি আটকে যাবার ঘটনাটা মনে পড়ে। ব্যস এই পর্যন্তই। গত মাসের প্রথম দিকে শুক্রবারে তিনি নাশতা খেতে বসেছেন। ডিমভাজা, রুটি আর সুজির হালুয়া। রাহেলা বসেছে তার বাদিকের চেয়ারটায়। রাহেলা বলল, আজকের রুটিটা যে অন্যরকম বুঝতে পারছ?
তিনি বললেন, না।
রাহেলা বলল, তোমাকে নতুন কিছু করে খাওয়ানো অর্থহীন। কিছুই বুঝতে পার না। আজকের রুটি তো আটার রুটি না। আলুর রুটি। আলু সিদ্ধ করে কাই বানিয়ে বেলে রুটি বানানো হয়েছে।
তিনি বললেন, ও।
রাহেলা তখন হঠাৎ তাঁকে চমকে দিয়ে বলল, রুটি গলায় আটকে আমি যে একবার মরতে বসেছিলাম তোমার মনে আছে?
ফরহাদ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলেন। রাহেলা কী বলছে? সে আবার কখন গলায় রুটি আটকে মরতে বসল!
এইভাবে তাকাচ্ছ কেন? সমস্যাটা কী?
কোনো সমস্যা না।
তোমার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয় কোনো সমস্যা যাচ্ছে। অফিসে কিছু হয় নি তো?
না।
রুটি গলায় আটকে যাবার কথা শুনে এমন চমকে গেলে কেন বলো তো?
চমকাই নি তো!
রাহেলা বলল, কতদিন আগের ঘটনা অথচ মনে হয় এই তো গত সপ্তাহে। তুমি ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেয়ে ধরাম করে পড়ে গেলে। তোমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়েই মনে হয় আমার গলা দিয়ে রুটি নেমে গেল। তোমাকে নিয়ে তখন দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি। মাথায় পানি ঢালাঢলি।… এরকম করে তাকাচ্ছ কেন? মনে নেই?
ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, মনে আছে।
আলু-রুটি খেতে কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
ভালো হয়েছে তাহলে মুখে রুটি নিয়ে বসে আছ কেন? খেতে ভালো না লাগলে বলো—নরম্যাল রুটি সেঁকে দেব।
আচ্ছা।
আলু-রুটি তোমার বড় মেয়ে বানিয়েছে। কোন বই-এ যেন রেসিপি পড়েছে। এই মেয়েটার রান্না-বান্নার দিকে ঝোঁক আছে। প্রায়ই এটা সেটা রাধে। ঐদিন করল চিনাবাদামের ভর্তা। চিনাবাদাম পিষে, সরিষার তেল, কাঁচামরিচ, আদা দিয়ে মেখে সামান্য তেলে ভেজে করেছে। খেতে অসাধারণ হয়েছে। তোমাকেও তো অফিসে পাঠিয়েছিলাম।