সালু মামা বললেন, লক্ষণ বিচার করে বিবাহ করতে হয়। বিয়ে তো তুই একবারই করবি। সেই বিয়েটা দেখে শুনে করা ভালো না?
ফরহাদ উদ্দিন আবারো ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।
তাহলে ওদের নো জানিয়ে দেই?
আচ্ছা।
বদরুল পাশা তখন খুবই অবাক হয়ে বলল, মামা এটা কেমন কথা! কোঁকড়া চুল থাকলে মেয়ে অসতী হয়—এটা বই-এ পড়ে বিয়ে বাতিল করে দেবেন? মেয়ের যে চুল কোঁকড়া এটা আগে দেখেন নি?
সালু মামা বললেন, তুমি এর মধ্যে কথা বলছ কেন? তুমি তো বিয়ে করছ না।
বদরুল পাশা বলল, আপনি তো মামা অন্যায় করতে পারেন না।
সালু মামা বললেন, পরিবারের স্বার্থে আমি অন্যায় করতে পারি। এখনই আমি কনে পক্ষকে না জানিয়ে দিচ্ছি।
ফরহাদ উদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে—-নো জানিয়ে দেবার পর হুলুস্থুল পড়ে গেল। মেয়ের বাড়িতে কান্নাকাটি। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবা আরো দশ হাজার টাকা বাড়তি দিয়ে পরিস্থিতি সামলালেন। নির্বিঘ্নে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ে বাড়ির খাওয়ার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। সালু মামা বললেন—-তিনি তাঁর জীবনে এত ভালো খাসির কালিয়া খান নি। যে বাবুর্চি এই কালিয়া রান্না করেছে। তার হাত রূপা দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়া দরকার। এই বলেই তিনি থেমে গেলেন না, বাবুর্চিকে পাশে দাঁড় করিয়ে হাসি হাসি মুখে ছবি তুললেন। বিয়ের আসরের ছবি তোলার জন্যে তিনি স্টুডিও থেকে ফটোগ্রাফার ভাড়া করে এনেছিলেন। খুবই দুঃখের কথা—দু’টা ছবি তোলার পরই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেল। বিয়ের একমাত্র ছবি যে দু’টা তোলা হলো তা হচ্ছে বাবুর্চির কাঁধে হাত রেখে সালু মামার হাসি হাসি মুখের ছবি।
বাসর ঘরে পারুলকে দেখে ফরহাদ উদ্দিন মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মাথা নিচু করে খাটের মাঝখানে রাজকন্যা বসে আছে। মানুষ এত সুন্দর হয়। পারুল নিঃশব্দে কাঁদছিল। নিতান্তই অপরিচিত, রূপবতী এক তরুণীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে আর তিনি বসে আছেন বোকার মতো। মেয়েটাকে কী বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। কেঁদো না বলবেন, না-কি কাঁদছ কেন? কী জিজ্ঞেস করবেন তা ঠিক করতে তার চল্লিশ মিনিটের মতো লাগল। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, কেঁদো না। বলেই খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন।
নববধূর কান্না তাতে থামল না, তবে কান্নার সঙ্গে শরীর দুলিয়ে হেঁচকি তোলা বন্ধ হয়ে গেল। বাসর ঘরে নববধূর সঙ্গে সুন্দর সুন্দর কথা বলার নিয়ম—-প্রেম ভালোবাসার কথা, ভাবের কথা, সুখ-দুঃখের কথা। তাঁর কোনো কথাই মনে পড়ল না। চুপচাপ বসে থেকে ক্লান্ত হতে হতে এক সময় বললেন, তোমাদের বাবুর্চির রান্না মাশাল্লাহ ভালো।
এই কথা শুনে পারুল চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে সামান্য বিস্ময়। তিনি তখন বললেন, বাবুর্চির নাম কী?
পারুল ক্ষীণ গলায় বলল, ফজলু মিয়া।
তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ফজলু মিয়ার দেশের বাড়ি কোথায়?
পারুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। তবে তার কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। গাল চোখের পানিতে ভেজা ছিল। শাড়ির আঁচল দিয়ে সে গাল মুছল। তার চোখের বিস্ময় আরো প্রবল হলো।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এক গ্লাস পানি খাব। বলেই দেখলেন খাটের সঙ্গে লাগানো টেবিলে পানির জগ, গ্লাস সাজানো। তিনি নিজেই উঠে পরপর দুগ্লাস পানি খেয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কারণ পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ছোট বাথরুম পায়। এখনো পাবে বলাই বাহুল্য। গ্রাম দেশের বাড়ি এটাচড বাথরুম থাকবে না। বাসর ঘর থেকে বের হয়ে দূরের কোনো বাথরুমে যেতে হবে। নতুন জামাই বাসর ঘর থেকে বের হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে। শালা শালীরা শুরু করবে নানান যন্ত্রণা। নতুন জামাইকে যন্ত্রণা দেয়া বিরাট আমাদের ব্যাপার। তিনি নিশ্চিত যে বাথরুমে ঢোকামাত্র তারা বাইরে থেকে বাথরুমের দরজায় তালা লাগিয়ে দেবে। গ্রাম দেশে এই রসিকতা খুবই কমন রসিকতা। তাকে অনেক রাত পর্যন্ত বাথরুমে বসে থাকতে হবে। শালা শালীদের হাসি এবং ঠাট্টা-তামাশা শুনতে হবে। দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে তিনি আরো আধাগ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রস্রাবের বেগ হলো। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, বাথরুমে যাব।
বাসর ঘর নিয়ে মানুষের কত সুখ-স্মৃতি থাকে। তার সবই দুঃখময় স্মৃতি। বাথরুমে ঢোকার পর তারা সত্যি সত্যিই বাইরে থেকে শিকল দিয়ে দিল। শালীর দল আজেবাজে কথা বলে হাসাহাসি করতে লাগল। দুলাভাই হাগে, দুলাভাই হাগে বলে চিকন গলায় বিকট চিৎকার। এদের সঙ্গে বয়স্কদের হাসিও যুক্ত হলো। বয়স্করা মাঝে মাঝে প্রশ্রয় সূচক ধমক দিচ্ছেন—-কী কর, ছেড়ে দাও না। আর কত!
কে কার কথা শুনে। তিনি দুই ঘণ্টার মতো সময় বাথরুমে বসে রইলেন। শেষ পর্যন্ত বাথরুম থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনে পারুল। নতুন বউ এই কাজটা করেছে বলে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে বেহায়া মেয়ে, বেলাজ মেয়ে।
বাসর রাতে পারুল তাকে বাথরুম থেকে নিজে শিকল খুলে বের করে আনিছে—এই দৃশ্য অনেকদিন পরে মনে করে তার কান্না পেয়ে গেল। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভালো মেয়ে ছিল। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দুই বছর এগারো মাস সুখে কেটেছে। তবে মেয়েটাকে বুঝতে বুঝতেই সময় কেটে গেল। চৈত্র মাসের এক দুপুরবেলা সব শেষ। তখন তিনি অফিস ক্যান্টিনে বসে হাফ বিরিয়ানির অর্ডার দিয়েছেন। বিরিয়ানি এরা ভালো বানায়। হাফ প্লেট বিরিয়ানির একটা কাবাব থাকে, অর্ধেকটা ভুনা ডিম থাকে। আলাদা করে প্লেটে তেতুলের ঝাল টক দেয়। হাফ প্লেটে পেট ভরে না, ক্ষিধে লেগে থাকে। ফুল প্লেটে আবার বেশি হয়ে যায়। তিনি ঠিক করে রেখেছেন হাফ প্লেটের পর অবস্থা বুঝে আরো হাফ প্লেটের অর্ডার দেবেন। সেদিন ক্ষিধেটা খুব মারাত্মক লেগেছিল। তিনি যখন খেতে বসেছেন তখন হন্তদন্ত হয়ে বদরুল পাশা উপস্থিত। সে মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছে কিন্তু দিতে পারছে না। খাওয়ার সময় দুঃসংবাদ দিতে নেই। তিনি আরাম করে হাফ প্লেট বিরিয়ানি খাবার পর আরেক হাফ প্লেটের অর্ডার দিলেন। বন্ধুকে খাওয়াবার জন্যে পিড়াপিড়ি করলেন। তিনি বুঝতেই পারেন নি কত ভয়ঙ্কর ঘটনা বাসায় ঘটে গেছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ঐ দিনের বিরিয়ানির স্বাদটা এখনো তার মুখে লেগে আছে।