এখনো ভয়ে তিনি কুঁকড়েই আছেন। আড় চোখে বারবার সঞ্জুর কপাল দেখতে চেষ্টা করছেন। কপাল দেখতে গিয়ে ছেলেকে দেখা হয়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর ছেলে! গায়ের রং সুন্দর। স্বাস্থ্য ভালো। মাথা ভরতি চুল। বাতাসে মাঝে মাঝে কিছু চুল কপালে এসে পড়ছে, সে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে। জরির পোশাক পরিয়ে মাথায় একটা মুকুট দিয়ে দিলেই রাজপুত্র। কিংবা একটা নীল রঙের স্যুট পরিয়ে গলায় টাই দিয়ে দিলে বিলেত ফেরত সাহেব পুত্র। এরকম ছেলেকে পাশে বসিয়ে রিকশায় ঘুরতেও আনন্দ। তিনি ছেলের হাত ধরলেন। সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, হাত ধরবে না তো বাবা।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
একটু সরে বোস না। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছ। এমনিতেই গরমে বাঁচি না।
ফরহাদ উদ্দিন সরে বসলেন।
হালকা গলায় বললেন, কনক মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে রে।
সঞ্জু বলল, কোনো রকম লাগে না।
খুবই দুঃখী মেয়ে। লাজুক, পাখি স্বভাব। অন্তরটা টলটলা পানির মতো। মাশাল্লাহ্। এরকম মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না।
সঞ্জু বলল, বাবা কথা বলতে বলতে তুমি আবারো আমার দিকে আসছ।
ফরহাদ উদ্দিন সরে বসলেন। রিকশা বেশ দ্রুত চলছে। চৈত্রমাস রাস্তা তেতে আছে। কানের পাশ দিয়ে গরম বাতাস বইছে। নাকের ভেতর সামান্য জ্বালা করছে। শুক্রবার ছুটির দিন, রাস্তায় যানজট নেই। ফরহাদ উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, চৈত্র মাসের গরমের একটা মজা আছে এটা কি তুই লক্ষ করেছিস?
সঞ্জু বলল, কী মজা?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, সব সিজনেরই আলাদা আলাদা মজা আছে। পৌষ মাসে যখন আঁকিয়ে শীত পড়ে সেই শীতের মজা আছে। আবার চৈত্র মাস যখন তালু ফাটা গরম পড়ে তারও মজা আছে।
সঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, মজা থাকলে তো ভালোই।
তোর কাছে কোন ঋতুটা ভালো লাগে? জানি না বাবা।
তোর ফেভারিট কোনো ঋতু নেই? বর্ষা? বর্ষা কেমন লাগে? স্কুলে রচনা লিখিস নি–আমার প্রিয় ঋতু?
বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সঞ্জু হঠাৎ থমথমে গলায় বলল, বাবা রিকশা থামতে বলো।
ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আমি অন্য রিকশায় যাব।
অন্য রিকশায় যাবি কেন? এখনো চাপাচাপি হচ্ছে? আচ্ছা আমি আরো সরে বসছি।
সরে বসতে হবে না। তুমি আরাম করে বোস। আমি অন্য রিকশায় যাব।
ফরহাদ উদ্দিন আহত গলায় বললেন, কেন? বেশ তো দুজনে গল্প করতে করতে যাচ্ছি।
সঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে বাবা।
ফরহাদ উদ্দিন ঢোক গিললেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুই সিগারট খাস না-কি?
সঞ্জু বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে থামাল। হুট করে রিকশা থেকে নেমে গেল। বাবাকে বলল, বাবা তুমি তোমার মতো চলে যাও। আমি আসছি।
রিকশা চলতে শুরু করেছে। ফরহাদ উদ্দিন পেছনে ফিরে ছেলেকে দেখার চেষ্টা করছেন। তাকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট ফাঁকা—এর মধ্যে সে কোথায় চলে গেল। শেষ পর্যন্ত যাবে তো?
তাঁর ইচ্ছা করছে রিকশা থামিয়ে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করতে–এটা ঠিক হবে না। সে সিগারেট খাবে। এতে তাঁর অস্বস্তি, ছেলেরও অস্বস্তি। তিনি ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি আবার বন্ধ হয়ে আছে। গত এক সপ্তাহে তিনবার ঘড়ি বন্ধ হলো। নতুন একটা ঘড়ি কেনা দরকার। আজকাল ঘড়ি সস্তা হয়ে গেছে। দেড়শ দুশ টাকায় ঘড়ি পাওয়া যায়। সমস্যা হলো ফরহাদ উদ্দিন পুরনো ঘড়ির মায়া ছাড়তে পারছেন না। এই ঘড়ির বয়স সঞ্জুর বয়সের কাছাকাছি। ইসলামপুর থেকে কিনেছিলেন তিনশ একুশ টাকা দিয়ে। ঘড়ি কেনার সময় তার সঙ্গে ছিল বদরুল পাশা। সে-ই পছন্দ করে ঘড়ি কিনেছে। ফেরার পথে বদরুল হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে নর্দমায় পড়ে গেল। তারপর আর উঠতে পারে না। ধরাধরি করে তোলা হলো। কত ঘটনা। বদরুল পাশা তার অতি প্রিয় বন্ধু ছিল। হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। আবার কোনো একদিন কি ফিরে আসবে? দুপুররাতে কলিং বেল টিপে আঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গম্ভীর গলায় বলবে—এই আমার মেয়ে কোথায়?
তিনি বলবেন, তুই এতদিন কোথায় ছিলি?
আমি এতদিন কোথায় ছিলাম তা দিয়ে তোর দরকার কী? আমার মেয়ে বের করে দে। প্যাচাল কথা এখন শুনব না।
রোদের তেজ কমে এসেছে। মনে হয় চারটা সাড়ে চারটা বাজে। তিনি যাচ্ছেন তাঁর প্রথম পক্ষের শ্বশুর বাড়িতে। সঞ্জুর নানার বাড়ি। সঞ্জুর মা’র মৃত্যুর পর এই বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ শেষ হয়ে গেছে। সাত বছর পর এই প্রথম যাচ্ছেন। তার শাশুড়ি খবর পাঠিয়েছেন—সঞ্জুকে নিয়ে তিনি যেন শুক্রবার বিকেলে অবশ্যই আসেন। জরুরি প্রয়োজন।
আজ কি বিশেষ কোনো দিন? সঞ্জুর মা পারুলের জন্মদিন, মৃত্যুদিন কিংবা বিয়ের দিন। পারুল সম্পর্কে সবকিছুই ফরহাদ উদ্দিন ভুলে গেছেন। মাথার চুল সঞ্জুর মতো কোঁকড়া ছিল এইটুকু শুধু মনে আছে। এটাও মনে থাকত না, মনে আছে কারণ কোঁকড়া চুল নিয়ে বিয়ের সময় খুব ঝামেলা হয়েছে। বিয়ে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবার পর ফরহাদ সাহেবের বড় মামা (সালু মামা) হঠাৎ ঘোষণা করলেন এই বিয়ে হবে না। মেয়ের মাথার চুল কোঁকড়ানো। কোঁকড়ানো চুলের মেয়ে অসতী হয়। লক্ষণ বিচার বইয়ে তিনি এই তথ্য পেয়েছেন। মেয়ের মাথার চুল শুধু যে কোঁকড়া তা-না। লালচে ভাবও আছে। অসতী নারীর চুল লালচে হয় এটিও না-কি শাস্ত্রে আছে। সালু মামা তার ভাগ্নেকে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কিরে বদু (বদু ফরহাদ উদ্দিনের ডাক নাম) তুই জেনেশুনে অসতী নারী বিবাহ করবি? ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় অস্পষ্ট শব্দ করলেন যা খানিকটা না-এর মতো শুনালো।