কনক!
জ্বি।
সঞ্জুর ঘরে একটু যাও তো। ওকে বলো কাপড় পরতে, আমরা এখন রওনা হব।
উনার ঘরে ঢুকলে উনি রাগ করবেন।
তাহলে দরজা থেকে বললো।
কনক উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ উদ্দিন আবারো একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। কী সুন্দর মেয়ে। সঞ্জুর আশেপাশে এরকম সুন্দর মেয়ে ছাড়া কি কাউকে মানায়? কাউকে মানায় না।
.
ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। ফরহাদ উদ্দিন দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলেন–শেষ কবে সঞ্জুকে নিয়ে রিকশায় উঠেছেন। মনে পড়ল না। শেষবার কবে সঞ্জুকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন সেটা মনে পড়ল। গত বৎসর মে জুন মাসের দিকে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে চিটাগাং গিয়েছিলেন। আন্তনগর ট্রেন। ফার্স্ট স্টপেজ ছিল ভৈরব। ভৈরবে দু টাকার কালোজাম কিনলেন। এত মিষ্টি কালোজাম তিনি জীবনে খান নি। পাঁচ টাকার এক ঠোঙা কেনা উচিত ছিল। বিরাট ভুল হয়েছে।
পুরনো ঘটনা আজকাল আর চট করে মনে পড়ে না। যেটা মনে করতে চান সেটা না পড়ে অন্য ঘটনা মনে পড়ে। ফরহাদ উদ্দিনের ধারণা ডায়াবেটিসের কারণে এটা হয়েছে। ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যে শরীরের সব কলকজায় জং ধরিয়ে দেয়, মরচে পড়ে যায়। সবার আগে মরচে ধরে মাথায়। কোনো কিছুই ঠিকঠাক মনে পড়ে না। তিনি শেষ কবে সঞ্জুকে নিয়ে রিকশায় উঠেছিলেন সেটা মনে পড়ল না—ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। যে লোক কালোজাম বিক্রি করছিল তার চেহারা পর্যন্ত মনে পড়ল। থুতনিতে দাড়ি, মাথায় বেতের টুপি। পান খাচ্ছিল। পানের রস গড়িয়ে দাড়িতে পড়েছে। ধবধবে সাদা দাড়ি বেয়ে পানের লাল পিক নামছে–এটাও মনে আছে।
সঞ্চুকে জিজ্ঞেস করলে হয়—সঞ্জু, শেষ কবে তোকে নিয়ে রিকশায় উঠেছি?
ফরহাদ উদ্দিনের সাহসে কুলাচ্ছে না। তাঁর মন বলছে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই সঞ্জু রেগে যাবে। কপালের রগ ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করবে, শেষ কবে তোমার সঙ্গে রিকশায় উঠেছিলাম তা দিয়ে দরকার কী?
রেগে গেলে সঞ্জুর কপালের রগ ফুলে যায় এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মানুষের কপালে যে রগ আছে এটাই তিনি জানতেন না। নিজের ছেলেকে রাগত অবস্থায় দেখার আগ পর্যন্ত তাঁর ধারণা ছিল মাথার খুলির ওপর সলিড চামড়ার একটা লেয়ার থাকে। এখন তিনি জানেন ঘটনা তা না। কপালের ঠিক মাঝখানে দু’টা রগ আছে। কোনো কোনো মানুষ রেগে গেলে এই রগ দু’টা ফুলে উঠে। ফরহাদ উদ্দিন আড় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের দিকে মানে ছেলের কপালের দিকে। রগ ফুলে আছে কি-না তার একটা গোপন পরীক্ষা। নাহ বগ ফুলে নেই। তবে সঞ্জুর মুখ থমথমে। তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, এ জার্নি বাই রিকশা—কেমন লাগছে রে সঞ্জু?
সঞ্জু জবাব দিল না। আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বসে রইল। ছেলের গম্ভীর মুখ দেখে ফরহাদ উদ্দিনের সামান্য ভয় ভয় করতে লাগল। এই তার আরেক সমস্যা হয়েছে—-অকারণ ভয়। অফিসে বড় সাহেব যখন ডাকেন বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠে। অথচ বুকে ধ্বক করার কোনো কারণ নেই। অফিসের বড় সাহেব আর্মির এক্স কর্নেল হাবীবুর রহমান অতি ভদ্রলোক। তিনি না হেসে কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। পাঞ্জাবিপরা হাবীবুর রহমান সাহেবকে দেখে মনেই হয় না তিনি আর্মির কর্নেল ছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হয় কোনো প্রাইভেট কলেজের মাই ডিয়ার টাইপ বাংলার প্রফেসর। অথচ এই ভদ্রলোকের চোখের দিকে পর্যন্ত তিনি তাকাতে পারেন না। তার বুক শিরশির করে। একবার বড় সাহেব কী একটা কাজে তাকে ডেকেছেন। তিনি ভয়ে আধমরা হয়ে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বড় সাহেব হাসি মুখে বললেন–কী ব্যাপার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। ফরহাদ উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লেন। চেয়ারটা যে দুই ফুটের মতো পেছন দিকে সরানো সেটা মনে থাকল না। তিনি ধপাস করে কার্পেটে পড়ে গেলেন। এটাও হয়তো ডায়াবেটিসের কারণে হচ্ছে। খুব সম্ভব অসুখটা সাহসও কমিয়ে দেয়। মানুষ ভীরু টাইপ হয়ে যায়।
নিজের বাড়ির লোকজন ছাড়া তিনি এখন সবাইকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে সঞ্জুকে। তার মানে কি এই যে সঞ্জু এখন বাইরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে? কয়েকদিন আগে বাসে উঠলেন, কন্ডাকটারের দিকে তাকিয়ে ভয়ে তার বুক কেঁপে গেল। এই বুঝি কন্ডাকটার কোনো তুচ্ছ কারণে তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবে, তারপর এক পর্যায়ে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেবে। এরকম ঘটনা যে ঘটছে না, তা-না। ঘটছে। গত মাসেই ইত্তেফাঁক পত্রিকায় উঠেছে—চলন্ত বাস হইতে বৃদ্ধ নিক্ষেপ। কন্ডাকটার পলাতক। পুরো খবরটা পড়তে পারেন নি। শেষ পৃষ্ঠায় নিউজটা ছিল। সেখানে কয়েক লাইন ছাপা হয়েছে, নিচে লেখা—পাঁচের পাতায় দেখুন। পাঁচের পাতায় কিছু নেই। অন্য কোনো পাতায় ছাপা হয়েছে ভেবে তিনি পুরো পত্রিকাটা পড়েছেন। কোথাও নেই।
ফরহাদ উদ্দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কলিং বেলে হাত রাখতে গিয়েও ভয়ে মিইয়ে যান। বুক সামান্য ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। মনে হয় বাড়ি এত চুপচাপ কেন? কোনো দুর্ঘটনা কি ঘটেছে! তার তিন মেয়ের কেউ কি বাথরুমে স্লীপ খেয়ে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে? মাথায় আঘাত লাগা ভয়ংকর ব্যাপার। ব্রেইনে রক্তপাত হয়—বিরাট গণ্ডগোল হয়ে যায়। তার অফিসের এক কলিগের স্ত্রীর এরকম হয়েছে। সাবান পানিতে পিচ্ছিল হওয়া বাথরুমে উল্টে পড়ে মাথায় ব্যথা। সবাই ভাবল তেমন কিছু না। ভদ্রমহিলা রাতে দুবার বমি করে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমুতে গেলেন। ঘুম থেকে উঠে বললেন তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। এই সব ভেবে ঘরে ফেরার সময় ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। অথচ দরজা খুললে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় পরিস্থিতি খুবই ভালো। তাঁর তিন মেয়ে মায়ের সঙ্গে তাস খেলছে। টাকা দিয়ে খেলা হচ্ছে। সবার সামনেই দু টাকার চকচকে নোট। রাহেলা তাঁকে দেখে বলে—আজ খেলা বন্ধ। তোর বাবাকে চা দিতে হবে। তখন এক মেয়ে বলে—এইসব হবে না মা। আমি এখন পর্যন্ত একটা ডিলও পাই নি। বাবাকে বুয়া চা দেবে। তোমাকে আরো পাঁচ ডিল খেলতে হবে। খুবই আনন্দময় পরিবেশ।