সঞ্জু বাবার চোখের দিকে তাকাল। ফরহাদ উদ্দিনের মুখ শান্ত। উত্তেজনাহীন সহজ স্বাভাবিক মুখ। তিনি প্রায় অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করেও কী যেন বললেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে অভয়দানের মতো করে হাসলেন। সঞ্জু বলল, বাবা একটা রিকশা ভকি। আমাকে থানায় নিয়ে চল। আমি সব স্বীকার করব। আর হাতটা ছাড় বাবা—ব্যথা পাচ্ছি।
ফরহাদ উদ্দিন ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন।
.
আকাশে ঝলমলে রোদ।
রোদ গায়ে লাগছে না, কারণ প্রচুর বাতাস। বাতাসে সঙ্গুর চুল উড়ছে। রোদ পড়ায় চুলগুলি এখন আরো সোনালি লাগছে। ফরহাদ উদ্দিন যতটা সম্ভব এক পাশে সরে বসেছেন। গরমের সময় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে সঞ্জুর ভালো লাগে না।
সঞ্জু বলল, বাবা ঠিকমতো বস তো। এরকম হেলে বসে আছ কেন?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, গায়ের সঙ্গে গা লাগলে তোর তো আবার গরম লাগে।
সঞ্জু বলল, তুমি আরাম করে বোস। আমার গরম লাগছে না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এ জার্নি বাই রিকশা কেমন লাগছেরে ব্যাটা?
সঞ্জু জবাব দিল না। হাসল। ফরহাদ উদ্দিনের খুব ইচ্ছা করছে ছেলের হাত ধরতে। সাহসে কুলুচ্ছে না। গায়ে হাত দিলে সঞ্জু খুব রাগ করে। ফরহাদ উদ্দিনকে অবাক করে দিয়ে সঞ্জু বাবার হাত ধরল।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, একটা ধাঁধা তোকে জিজ্ঞেস করছি। দেখি জবাব দিতে পারিস কিনা–
আকাশে জন্মে কন্যা
পাতালে মরে
হাত দিয়া ধরতে গেলে
ছটর ফটর করে।
সঞ্জু বলল উত্তর জানিনা বাবা।
তোর মা রোজ ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। আমি কোনোটার উত্তর দিতে পারি নি। সে নিজেও উত্তর দিত না। উত্তর জিজ্ঞেস করলে হাসত। আমি করতাম রাগ।
সঞ্জু বলল, বাবা আমার ধারণা মা উত্তর জানত না। নিজে বানিয়ে বানিয়ে ধাঁধা বলত–যার কোনো উত্তর নেই।
হতেপারে। আমি এইভাবে চিন্তা করিনি।
সঞ্জু বলল, কাঁদছ কেন বাবা? কাঁদবে না।
ফরহাদ উদ্দিন চোখের পানি মুছে ফেলতে চাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। তার ডান হাত সঞ্জু ধরে আছে। চোখের পানি মুছতে হলে বাঁ হাত দিয়ে মুছতে হয়। বাঁ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছা খুবই অমঙ্গলজনক। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকশা করে যাচ্ছেন এমন মঙ্গলময় মুহূর্তে অমঙ্গল হয় এমন কাজ করা সম্ভব না।
সঞ্জু বলল, বাবা তোমার সত্য সাধনা কবে যেন শেষ হবে।
ফরহাদ উদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বেশি বাকি নেই। ডিসেম্বরের তিন তারিখ।
.
খুবই কাকতালীয় ভাবে সঞ্জুর ফাসি হয় ডিসেম্বরের তিন তারিখ।
ফরহার উদ্দিন অপেক্ষা করতে থাকেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে। ছেলের ডেডবডি তাকে দিয়ে দেয়া হবে ভোর ছটায়। তিনি ডেডবডি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের একটা গাড়িকে খবর দেয়া আছে। সেই গাড়ি এখনো আসেনি। গাড়ি না এলে ডেডবডি নেয়া সমস্যা হবে।
সেদিন গাঢ় কুয়াশা পড়েছিল। এমন কুয়াশায় চারদিকের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সূর্য অনেক আগেই উঠে গেছে কিন্তু সূর্যের কোনো আলো শহরে এসে ঢুকছে না, বরং কুয়াশা গাঢ় হচ্ছে। খুব কাছের মানুষকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো দূরে কাকে যেন দেখা যাচ্ছে। হাঁটার ভঙ্গিটা বদরুল পাশার মতো। লম্বা একজন মানুষ হাত দুলিয়ে দুলিয়ে বদরুলের মতোই হাঁটছে। আজ তাঁর ইচ্ছা পূরণের দিন। বদরুলের সঙ্গে আবার যেন দেখা হয় এই ইচ্ছাটা কি পূর্ণ হতে যাচ্ছে?
ফরহাদ উদ্দিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। যে আসছে সে আসুক। মানুষটা যদি বদরুল হয় ভালোই হয়। ডেডবডি বাড়িতে নিয়ে যাবার মতো ঝামেলার কাজে সে সাহায্য করতে পারে। আর বদরুল না হলেও কোনো ক্ষতি নেই।
ছ’টা বেজে গেছে। জেলখানার মূল ফটক খোলার শব্দ হচ্ছে। মনে হয় এরা এখন সঞ্জুকে নিয়ে আসছে।