ফরহাদ উদ্দিন টেলিফোন করার জন্যে নিজের ঘরে ঢুকলেন। টেলিফোন ধরল কনক। মেয়েটার গলার স্বর টেলিফোনে এত মিষ্টি শুনাচ্ছে।
কেমন আছ গো মা?
চাচাজি আমি ভালো আছি।
কলেজে যাও নি?
কলেজ তো এখন বন্ধ। সামারের ছুটি। আপনাকে আগে বলেছি।
মনে থাকে না মা। কিছুই মনে থাকে না।
আপনার গলার স্বর এমন শুনাচ্ছে কেন চাচাজি? আপনার শরীর কি ভালো?
আমার শরীর ভালো। তোমার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে।
কী সুসংবাদ?
আসলে সুসংবাদ দু’টা। একটা এখন বলি। আরেকটা পরে বলব। সামনা সামনি বসে বলব।
না চাচাজি, দু’টাই এখন শুনব।
প্রথম সুসংবাদ হলো—তোমার মা’র ঠিকানা বের করেছি। এখন আর যোগাযোগ করতে অসুবিধা হবে না।
যে যোগাযোগ করতে চায় না তার সঙ্গে যোগাযোগ করা কি ঠিক? দুনম্বর সুসংবাদটা কী?
সঞ্জু তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কী মা খুশি?
কনক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চাচাজি আপনি খুশি হলেই আমি খুশি।
এই বাড়িতেই থাকবে। কোথাও চলে যেতে হবে না। বদরুল এসে দেখবে তার মেয়ে আমার কাছেই আছে। সে কী খুশিই না হবে।
বাবা আসবে মানে?
ফরহাদ উদ্দিন গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন–কনক শোন, আমার মনের সব ইচ্ছা একে একে পূর্ণ হওয়া শুরু হয়েছে। কুড়ি বছর পার হতে বেশি বাকি নেই তো এই জন্যেই ঘটনাটা ঘটছে। আমার ইচ্ছা ছিল সঞ্জুর সঙ্গে তোমার বিয়ে দেয়া—সেটা হচ্ছে। ঘ্রাণশক্তি যেন ফিরে পাই এই ইচ্ছাটাও ছিল। হঠাৎ হঠাৎ ঘ্রাণ পাচ্ছি। সালু মামা চিকেন কাটলেট খাচ্ছিল। চিকেন কাটলেটের সঙ্গে সস, কাঁচামরিচ আর পিঁয়াজ দিয়েছে। সালু মামা যেই একটা কাঁচামরিচে কামড় দিলেন ওমনি কাঁচামরিচের ঘ্রাণ পেলাম।
চাচাজি আপনার শরীর কি ভালো?
হা শরীর ভালো।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার শরীর ভালো না। আপনি এক কাজ করুন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসুন।
অফিস থেকে ছুটি নিব কিন্তু বাসায় আসতে দেরি হবে রে মা। অনেক কাজ বাকি। তোমাদের বিয়ের কার্ড ছাপতে দিতে হবে। আজ দিনে দিনে কার্ড ছাপায়ে বাসায় নিয়ে আসব।
চাচাজি বিয়েটা কবে?
এইখানে একটা মজা আছে রে মা। বিরাট মজা।
ফরহাদ উদ্দিন ছেলেমানুষের মতো কুই কুই করে হাসছেন। কনক হ্যালো হ্যালো বলছে তিনি তা শুনতে পাচ্ছেন না। তার খুবই হাসি পাচ্ছে।
.
ফরহাদ উদ্দিন বাড়ি ফিরলেন রাত তিনটায়।
দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে সবাই জেগে বসে আছে। মানুষটা এত রাত করে কখনো ফিরে না। কোনো একসিডেন্ট হয় নি তো? বাড়ি ফিরতে দেরি হবে এই খবর টেলিফোনে কনককে জানানো হয়েছে। সেই দেরি মানে এত দেরি? রাত আড়াইটার সময় সঞ্জু বের হয়েছে হাসপাতালে হাসপাতালে খোঁজ নিতে। রাহেলা নফল নামাজ পড়তে বসেছেন। কলিং বেলে শব্দ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নামাজ ছেড়ে উঠবেন না।
কলিং বেল বাজতেই তিনি নামাজ ছেড়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। ফরহাদ উদ্দিন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ দিয়ে ভকভক করে দুর্গন্ধ আসছে। তিনি সহজভাবে দাঁড়াতেও পারছেন না।
রাহেলা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কী হয়েছে?
ফরহাদ উদ্দিন হাসিমুখে বললেন, তেমন কিছু না। মদ খেয়েছি। একটা বিয়ার খেয়েছি। আর দুই গ্লাস হুইস্কি।
রাহেলা স্বামীর হাত ধরলেন। মেয়েরা চোখ বড় বড় করে বাপকে দেখছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য তারা আগে কখনো দেখে নি। ফরহাদ উদ্দিন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন–সস্ত্রর বিয়ের কার্ড ছাপতে দিয়ে এসেছি। চারদিকে রুপালি বর্ডার। কাল সকালে ডেলিভারী দিবে।
রাহেলা বললেন, কথা বলতে হবে না। এসো বিছানায় শুয়ে পড়। কথা যা বলার সকালে বলবে।
.
ফরহাদ উদ্দিন সাহেবের রাতে খুব গাঢ় ঘুম হলো। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলেন বদরুলকে। বদরুলের মুখ ভর্তি হাসি। বদরুল বলল, আমার মেয়েটার বিয়ে ঠিক করলি আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে!
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোর ছেলে পছন্দ হয়েছে তো?
বদরুল বলল, সঞ্জুর মতো ছেলে পছন্দ হবে না মানে? এরকম ছেলে কি পথেঘাটে পাওয়া যায়?
তুই খুশি তো?
অবশ্যই খুশি।
খুব আয়োজন করে বিয়েটা দিতে পারছি না। ব্যাক ডেটে বিয়ে হচ্ছে। তুই কিছু মনে করিস না।
যেভাবে সুবিধা তুই সেভাবে দে।
বিয়ের কার্ড আগামীকাল দিবে। কার্ড বেশি ছাপানো হয় নি। অল্প ছাপানো হয়েছে। তুই তো নিখোঁজ হয়ে আছিস। তোকে কার্ড কীভাবে পৌঁছাব?
আমাকে নিয়ে তুই একদম ভাবিস না। তুই আরাম করে ঘুমো। আমি তোর মাথার চুল টেনে দিচ্ছি।
স্বপ্নে বদরুল তাঁর চুল টেনে দিতে থাকল। তিনি আবারো স্বপ্নহীন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
সঞ্জুর বিয়ের কার্ড
সঞ্জুর বিয়ের কার্ড ফরহাদ উদ্দিনের খুবই পছন্দ হয়েছে। রুপালি বর্ডার দেওয়া কার্ড। লেখাগুলি সবুজ। চিঠির ভাষাটাও সুন্দর। সালু মামা সুন্দর করে সব সাজিয়েছেন।
পরম করুণাময়ের নামে শুরু
সুধী,
আসোলামু আলায়কুম। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার একমাত্র পুত্র আশরাফ উদ্দিন সঞ্জুর শুভ বিবাহের তারিখ …
কার্ডের উল্টো পিঠে বরের পরিচয় কনের পরিচয়। বরযাত্রার সময়। এবং সবশেষে লেখা–
উপহার আনিবেন না। আপনার দোয়াই কাম্য।
সব কিছুই ঠিক আছে শুধু বিয়ের তারিখটা যেন কেমন। এই একটা জায়গায় খটকা। আর কোথাও কোনো খটকা নেই। তারিখের খটকাটা না থাকলে ফরহাদ উদ্দিন তার অফিসের কলিগদের সবাইকে একটা করে কার্ড দিতেন।