কনক কোনো জবাব দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তবে তার মুখ দেখে মনে হলো—এতক্ষণ একটা ভয়ের মধ্যে সে ছিল, এখন এই ভয় তার কেটে গেছে।
রাহেলা বললেন, তুমি তাস খেলতে জানো?
কনক না-সূচক মাথা নাড়ল।
রাহেলা বললেন তাস খেলা শিখে নিও। আমি আমার মেয়েদের সঙ্গে মজা করে তাস খেলি। বড় মেয়েটা খেলতে চায় না। কিছুক্ষণ তাস খেললেই তার নাকি মাথা ধরে। তুমি তাস খেলা শিখে নিলে আমাদের প্লেয়ারের সর্ট হবে না।
কনক হেসে ফেলল। সেই হাসি দেখে ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো মেয়েটা অনেক দিন এরকম হাসার সুযোগ পায় নি। তার মনটা মায়ায় ভরে গেল।
রাহেলা বললেন—শোন মেয়ে, তুমি তোমার চাচার ঘরে ঘুমুবে। একা একা ঘুমুতে ভয় পাবে এই জন্যে নীতু ঘুমাবে তোমার সঙ্গে। আর তোমার চাচা যখন খবরাখবর না নিয়ে হুট করে তোমাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তার শাস্তি হিসেবে ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমুবে। আমি আমার ঘরে তাকে জায়গা দেব না। এমন নাক ডাকে আমি এক সেকেণ্ডের জন্যেও ঘুমুতে পারি না।
এক সপ্তাহ পর তিনি কনককে তার মা’র কাছে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কনকের মা, তার স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে গেছে। খবরটা তারা গোপন রেখেছে। কেউই কিছু জানে না।
ফরহাদ উদ্দিন কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, মা তুমি জানতে ওরা বিদেশে চলে যাবে?
কনক হা-সূচক মাথা নাড়ল।
তোমাকে কি আমার কাছে ফেলে গেছে?
কনক আবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
ফরহাদ উদ্দিন ভীত গলায় বললেন, এখন কী করা যায় বলো তো মা? রাহেলা এই খবর শুনলে কী করবে কে জানে। কেন জানি মনে হচ্ছে, সে খুবই রেগে যাবে। আমার তো খুবই ভয় লাগছে। তোমার ভয় লাগছে না?
কনক বলল, না।
ভয় লাগছে না কেন?
চাচিজি সব জানেন।
চাচিজি সব জানেন মানে কী? রাহেলা কী জানে? তোমার মা যে তোমাকে আমার ঘাড়ে ফেলে চলে গেছে এটা জানে?
হুঁ। তাকে বলেছি।
আমাকে বলো নি কেন?
কনক অন্যদিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসল। যেন মানুষটাকে বোকা বানিয়ে সে মজা পাচ্ছে। এই মেয়েও তার বাবার মতো অদ্ভুত হচ্ছে কিনা কে বলবে। মনে হয় হচ্ছে। পিতার স্বভাব কিছু না কিছু তো পাবেই।
ফরহাদ উদ্দিন খুবই অবাক হলেন।
কনক সহজ গলায় বলল, চাচাজি আমি একটা আইসক্রিম খাব।
তিনি আইসক্রিম কিনে আনলেন। তাঁর কাছে মনে হলো মেয়েটাকে তার মা ফেলে রেখে গিয়ে ভালোই করেছে।
.
চাচাজি আপনার চা।
কনক চা এনে রেখেছে। ফরহাদ উদ্দিন চায়ে চুমুক না দিয়েই বললেন, অসাধারণ চা হয়েছে মা। সাধারণের আগে একটা অ বসেছে। একটা অ না বসে দু’টা বসলে ভালো হতো—অঅসাধারণ চা। তুমি চলে যাচ্ছ কেন? বোস, গল্প করি। আমার হাতে এখনো বার তের মিনিট সময় আছে।
কনক বসল না, খাট ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রইল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমার চায়ের নেশা নেই। চায়ের নেশা ছিল তোমার বাবার। চায়ের দোকান দেখলেই চা খেতে দাঁড়িয়ে যাবে। সে কী ঠিক করেছিল জানো? সে ঠিক করেছিল ঢাকা শহরে যত চায়ের দোকান আছে সব দোকানে সে চা খাবে। তারপর যে দোকানের চা সবচে ভালো তাকে আধভরি ওজনের একটা গোল্ড মেডেল দেবে। মেডেলের নাম বদরুল পাশা টি মেডেল। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে কত দোকানের চা যে খেয়েছি।
মেডেল দেয়া হয়েছিল?
না দেয়া হয় নি। তোমার বাবার কোনো শখই বেশিদিন থাকে না। একটা জিনিস ধরে, কিছুদিন এটা নিয়ে কচলাকচলি করে তারপর ছেড়ে দেয়। একবার কী করল শোন, কোত্থেকে খবর নিয়ে এলো কুড়ি বছর যদি কেউ মিথ্যা না বলে তাহলে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়। তার মনের সকল ইচ্ছা তখন পূর্ণ হয়। তোমার বাবা মিথ্যা বলা ছেড়ে দিল। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে আমিও মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলাম। সে তার স্বভাব মতো তিন মাস পরে বলল—আরে দূর, মিথ্যা না বলে মানুষ থাকতে পারে। মানুষের জন্মই হয়েছে ফিফটি পার্সেন্ট সত্য বলার জন্যে আর ফিফটি পার্সেন্ট মিথ্যা বলার জন্যে।
আপনিও কি বাবার মতো ছেড়ে দিলেন?
না আমি ছাড়ি নি। বিশ বছর হতে আর বেশি বাকিও নেই। আগামী ডিসেম্বরে হবে। তখন একটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হবে।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কী?
মনের শক্তি। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হলে আমি যা ইচ্ছা করব তাই হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি—কথার কথা আর কী। মনে কর, আমার খুব ইচ্ছা সঞ্জুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়। কিন্তু সঞ্জু এটা চাচ্ছে না। যেহেতু আমি ইচ্ছা করেছি বিয়ে হবেই। সঞ্জু যদি নাও চায় তারপরেও হবে।
কনক ক্ষীণ গলায় বলল, সঞ্জু ভাইয়ার একজন পছন্দের মেয়ে আছে, তার নাম রিনি। সঞ্জু ভাইয়া উনাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, ডিসেম্বর মাস পার হবার পর আর পারবে না। তখন আমার ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। আমার যে ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে তা তো তুমি জানো। তখন যদি আমি ইচ্ছা করি তাহলে ঘ্রাণশক্তি ফিরে আসবে।
কনক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, এখন বসল। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে। সে খুবই মজা পাচ্ছে।
মেয়েটার সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভালোই লাগত। কিন্তু আর সময় নেই। সঞ্জুকে নিয়ে বের হতে হবে।
ফরহাদ উদ্দিনের খুব ইচ্ছা সঞ্জুর সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে তাকে এ বাড়িতেই রেখে দেন। এরকম ভালো একটা মেয়ে অথচ সঞ্জু তার দিকে ফিরেও কেন তাকাচ্ছে না সেটা একটা রহস্য। ঠিক মতো কয়েকবার তাকালেই মায়া লেগে যেত। একবার মায়া লেগে গেলে আর চিন্তা ছিল না। ফরহাদ উদ্দিন অবশ্য নিজের মতোই চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যখন তখন কনককে সঞ্জুর কাছে পাঠাচ্ছেন। টুকটাক কথা হতে হতে দেখা যাবে মায়া লেগে গেছে। মায়া লাগার জন্যে কথা চালাচালি করা খুবই জরুরি।