ফরহাদ উদ্দিন দ্রুত ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। সঞ্জু সরলরেখার মতো খাটে শুয়ে আছে। তার গায়ে চাদর। সঞ্জু থমথমে গলায় বলল, বাবা বাতি জ্বালিও না।
ফরহাদ উদ্দিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে? জ্বর না-কি?
জানি না। কপালে হাত দিও না।
কপালে হাত না দিলে বুঝব কি করে জ্বর কি-না।
বোঝার দরকার নেই।
জ্বর বেশি হলে ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার, মাথায় পানি ঢালা দরকার।
তুমি ব্যস্ত হয়ো না বাবা। ব্যস্ত হবার মতো কিছু হয় নি।
সঞ্জুর ঘরে বাতি নেই, কিন্তু বারান্দার আলো এসে ঘরে পড়েছে। সে আলোতে দেখা যাচ্ছে সঞ্জুর মুখ রক্তশূন্য। ঠোঁট ফ্যাকাশে। চোখের নিচে মনে হয় কালি পড়েছে। ফরহাদ উদ্দিন বললেন–একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি।
না।
এরকম করছিস কেন রে ব্যাটা? আমি তো তোর খুব কাছের একজন মানুষ দূরের তো কেউ না।
সঞ্জু চাপা গলায় বলল, বাবা আমার খুব মাথা ধরেছে। আমাকে একা একা চুপচাপ শুয়ে থাকতে দাও—মাথার যন্ত্রণাটা কমুক।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? মাথা ধরা আরাম হবে।
না। বাবা তুমি আমার সামনে বসে থেকো না তো।
ফরহাদ উদ্দিন উঠলেন না। বসে রইলেন। তাঁর কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হচ্ছে যে তাঁর ছেলে এত বড় হয়েছে। লম্বা করে শুয়েছে–খাটের একেবারে এ মাথা ওমাথা। অথচ সেদিনই তো ছোট্ট ছিল। রাহেলাকে যখন বিয়ে করেন তখন সঞ্জুর বয়স ছ বছর। তিনি আর রাহেলা থাকেন এক ঘরে, সঞ্জু থাকে পাশের ঘরে। মাঝখানের দরজাটা খোলা থাকে। যেন ছেলে রাতে ঘুম ভেঙ্গে ভয় না পায়। প্রায় রাতেই বুকে একটা চাপ ব্যথা নিয়ে ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যেত। বুকে চাপ ব্যথার কারণ হচ্ছে সঞ্জু পাশের ঘর থেকে চলে এসেছে। সে তার অভ্যাস মতো গলা জড়িয়ে বাবার বুকের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।
ফরহাদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে রওনা হলেন। তখন তাকে বিস্মিত করে সঞ্জু ডাকল–বাবা, একটা কথা শুনে যাও। ফরহাদ উদ্দিন আবারো এসে চেয়ারে বসলেন। সঞ্জু বলল বাবা তুমি মনে কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার যে কাজটার জন্যে তুমি কষ্ট পাচ্ছ সেই কাজটা আমি করি নি। আজ হোক কাল হোক পুলিশ ভুল স্বীকার করবে। এখন আমার কথা কি তোমার কাছে যথেষ্ট না?
ফরহাদ উদ্দিন গাঢ় স্বরে বললেন, যথেষ্ট।
সঞ্জু বলল, এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে গিয়ে ঘুমাও। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখতে চাচ্ছিলে—জ্বর দেখ।
ফরহাদ উদ্দিন ছেলের কপালে হাত রাখলেন। সঞ্জুর গায়ে জ্বর। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে ছেলেটা শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। মায়ায় ফরহাদ উদ্দিনের মনটা ভরে গেল।
ফরহাদ উদ্দিনের অফিস
ফরহাদ উদ্দিনের অফিস ক্যান্টিনে সালু মামা বসে আছেন।
আজ তাকে খুব বিরক্ত মনে হচ্ছে। ক্যান্টিনে চিকেন কর্ন স্যুপের অর্ডার দিয়েছিলেন। স্যুপ আজ তৈরি হয় নি। সপ্তাহের সব দিন না-কি হয় না। রবিবার এবং বৃহস্পতিবার এই দুদিন হয়। এ ধরনের কথা শুনলে মেজাজ খারাপ হবার কথা। সালু মামা থমথমে গলায় বললেন, তোদের ক্যান্টিন ম্যানেজারকে তো চাবকানো উচিত। সপ্তাহে দুদিন স্যুপ হবে এটা কোন নিয়মে? এই দুদিন ছাড়া স্যুপ খাওয়া নিষেধ এরকম আইন কি জাতীয় পরিষদে পাশ হয়েছে?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, মামা অন্য কিছু খান।
আমি কিছু খাই বা না খাই সেটা অন্য ব্যাপার। সপ্তাহে দুদিন স্যুপ কোন আইনে হবে এটা আমাকে বুঝিয়ে বল। এই দুদিনের বিশেষত্ব কী?
ভেজিটেবল প্যাকোরা দিতে বলি মামা?
আরে না।
সালু মামা সিগারেট ধরালেন। ফরহাদ উদ্দিন মামার মেজাজ ঠিক হবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মামার কাণ্ডকারখানা দেখে তাঁর খুবই মজা লাগছে।
ফরহাদ।
জ্বি।
এই কাগজটা রেখে দে, পরে দিতে ভুলে যাব।
কীসের কাগজ?
কনকের মা’র ঠিকানা চেয়েছিলি—ঠিকানা লেখা আছে। সিডনিতে থাকে, ব্লাকটাউন সিডনি।
ফরহাদ উদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, সত্যি জোগাড় করে ফেলেছ?
ভাগ্নের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে সালু মামার বিরক্ত ভাবটা অনেকখানি কাটল। তিনি হাসি মুখে বললেন, তোকে কী বলেছিলাম, ঠিকানা জোগাড় করা আমার কাছে সাত ধারার মামলা। কোর্টে নেবার আগেই খালাস।
ঠিকানা যে তুমি সত্যি যোগাড় করে ফেলবে আমি ভাবি নি। মামা, তুমি চিকেন কাটলেট একটা খেয়ে দেখ। এরা চিকেন কাটলেট ভালো বানায়।
দিতে বল। আর ভেজিটেবল প্যাকোরা না কী যেন বললি ঐটাও এক প্লেট অর্ডার দে।
সালু মামা হাতের সিগারেট ফেলে ফরহাদ উদ্দিনের দিকে ঝুঁকে এলেন। গলা নামিয়ে বললেন—সঞ্জুর ব্যাপারটাও এখন আমি সাত ধারার মামলা বানিয়ে ফেলেছি। পুলিশ ফাইনাল রিপোর্টে সঞ্জুর নাম দিলেও কিছু করতে পারবে না। মন দিয়ে শোন কী করেছি—ঘটনাটা ঘটেছে আটই জুলাই।
কোন ঘটনা?
সঞ্জু টেলিফোনে সানসাইন ভিডিওর মালিক হাসনাতকে ঐ দিন বাড়ি থেকে বের করে নিল।
ফরহাদ উদ্দিন হাসিমুখে বললেন, সঞ্জু ঐ ঘটনার সঙ্গে নেই। এটা সঞ্জু বলেছে। ইস্তিয়াকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেও বলেছে পুলিশ ভুল করেছে।
সালু মামা অবাক হয়ে বললেন, ইস্তিয়াক এই কথা বলেছে?
হা বলেছে। তবে এটাও বলেছে যে পুলিশ ভুল করলেও আমাদের কাজ কর্ম চালিয়ে যেতে হবে। কারণ পুলিশ সহজে ভুল স্বীকার করবে না। তোমার পরিকল্পনা মতো কাজ করতে বলেছে। তোমার পরিকল্পনাটা কী?