ছবির নিচে লেখা
শাপলা টেইলারিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা
মাস্টার টেইলার আজিজ মিয়া
মৃত্যু ৭ই আগস্ট ১৯৮২
সানসাইন ভিডিওর দোকানটা তালাবদ্ধ। হাসনাত সাহেবের লোকজন ব্যবসা ঠিকমত দেখছে না। ভিডিও ব্যবসার আসল সময় হচ্ছে সন্ধ্যা। এই সময়ে দোকানে তালা দিয়ে চলে গেলে কীভাবে হবে।
ফরহাদ উদ্দিন ডাস্টবিনের দুদিক দিয়ে দুবার গেলেন। কোনো গন্ধ পেলেন না। তারপর একটু হেঁটে সানসাইন ভিডিওর বারান্দায় গিয়ে উঠলেন। অফিস থেকে হেঁটে এই পর্যন্ত এসেছেন। খুবই ক্লান্তি লাগছে। এটা যদি ভিডিওর দোকান না হয়ে চায়ের দোকান হতো তিনি এক কাপ চা খেয়ে যেতেন। বাড়িতে চা খাওয়ার একরকম মজা আবার চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার অন্য রকম মজা। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ যে মেঘলা হয়ে ছিল এতক্ষণ খেয়াল হয় নি। শহরবাসীরা আকাশের দিকে তাকায় না। ফরহাদ উদ্দিন বুঝতেও পারেন নি আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখতে মাখতে তিনি বাসার দিকে রওনা হলেন। তিনি এগুচ্ছেন অনাগ্রহের সঙ্গে। বাসায় ফিরতে তাঁর ইচ্ছা করছে না। যদিও খুব ক্লান্ত লাগছে তবু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শহরে ঘুরতে ইচ্ছা করছে। বদরুলের পাল্লায় পড়ে এক ভাদ্রমাসে এ রকম কাণ্ড করেছিলেন। তারা দুজনই তখন কিশোরগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছেন। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া করে পান মুখে দিয়েছেন, হঠাৎ টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামল। বদরুল বলল, এই আয় বৃষ্টিতে ভিজি।
ফরহাদ উদ্দিন খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, এখন বৃষ্টিতে ভিজব কেন?
বদরুল বলল, বৃষ্টিতে ভেজার কোনো সময় আছে নাকি? বৃষ্টিতে যখন তখন ভেজা যায়। ভাদ্রমাসের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না—আয় তো নামি।
বদরুলের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া অতি কঠিন কর্ম। তাঁকে বৃষ্টিতে নামতেই হলো। বদরুল বলল, আয় একটা প্রতিজ্ঞা করি—বৃষ্টি যতক্ষণ থাকবে। ততক্ষণ আমরা গায়ে বৃষ্টি মাখব। পাঁচ মিনিট থাকলে পাঁচ মিনিট। একঘণ্টা থাকলে এক ঘণ্টা। তাঁকে প্রতিজ্ঞাও করতে হলো। সেই বৃষ্টি আর থামেই না। সন্ধ্যার পর থেকে আকাশে মেঘের ওপর মেঘ জমতে শুরু করল। ঝড়ো বাতাস বইতে লাগল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন তারা অস্থির হয়ে গেল—মুরুব্বি শ্রেণীর একজন ছাতা হাতে বের হয়ে এসে বললেন—এ-কী পাগলামি করছেন? অসুখে পড়বেন তো।
ততক্ষণে ফরহাদ উদ্দিনের কেমন রোখ চেপে গেছে–শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখা যাক। কিশোরগঞ্জের যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির বড় মেয়ের সঙ্গেই বদরুলের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আসরে রব উঠেছিল—জামাই পাগল। পাগলের সঙ্গে বিবাহ মুসলিম আইনে সিদ্ধ না। তাতে সমস্যা হয় নি।
ফরহাদ উদ্দিন ঠিক করে রেখেছেন যদি সত্যি সত্যি কোনো একদিন বদরুল ফিরে আসে তাহলে পুরনো দিনের মতো বৃষ্টিতে ভেজার ব্যবস্থা করা হবে। এখন তো আর যৌবনকাল নেই—জ্বর জ্বারি হবে। হলে হবে।
অনেকক্ষণ কলিংবেল টেপার পর রাহেলা এসে দরজা খুলে দিলেন। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, বাসায় কেউ নেই?
রাহেলা খুশি খুশি গলায় বললেন, ঐ ছেলে এসে সব মেয়েদের নাটক দেখাতে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। আমাকে এসে বলল, আম্মা আপনিও চলেন। আমি লজ্জায় বাঁচি না।
লজ্জার কী আছে?
বিয়ে হয় নি এখনি মা ডাকছে লজ্জা লাগবে না? এমনভাবে ধরেছিল একবার ভাবলাম চলেই যাই। কোনোদিন মঞ্চ নাটক দেখি নি।
গেলেই পারতে।
তুমি অফিস থেকে এসে দেখবে বাসায় কেউ নেই। আচ্ছা তোমার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে কীসের?
বেলি ফুলের।
ফরহাদ উদ্দিন পকেট থেকে বেলি ফুল বের করলেন। রাহেলার মুখটা সঙ্গে সঙ্গে আহ্লাদী ধরনের হয়ে গেল। গলার স্বরও ভারী হয়ে গেল। তিনি আদুরে গলায় বললেন, সেই কবে তোমাকে বেলি ফুল আনতে বলেছিলাম এতদিন পরে মনে পড়ল। তবে আজকে এনে ভালোই করছে। মেয়েরা কেউ বাসায় নেই। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা দিয়ে রাখলে ওরা হাসাহাসি করতে পারবে না। কাঁচা দুধে বেলি ফুল চুবিয়ে রাখলে ফুলের গন্ধ দুধে চলে যায় এটা জানো?
না।
ঐ দুধ দিয়ে পায়েস রাঁধলে পায়েসে বেলি ফুলের গন্ধ হয়। তোমাকে একদিন বেলি-পায়েস খাওয়াব।
আচ্ছা।
আমি ভেবেছিলাম তোমাকে যে বেলি ফুল আনতে বলেছিলাম তুমি ভুলেই গেছ। আমার কোনো কিছু তো তোমার মনে থাকে না। আমি তো আর তোমার প্রথম স্ত্রীর মতো রূপবতীও না। গায়ের রঙ কালো।
ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি খুবই অবাক হলেন সামান্য কয়েকটা বেলি ফুল পেয়ে কেউ এত খুশি হতে পারে? তিনি যে রাহেলার কথা মনে করে বেলি ফুল কিনেছেন তাও না। ফরহাদ উদ্দিনের লজ্জা লাগছে। এই সত্যি কথাটা তো গোপন রাখা ঠিক হচ্ছে না। রাহেলার তার সম্পর্কে ভুল ধারণা হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন বিব্রত গলায় বললেন, রাহেলা কিছু মনে করো না। বেলি ফুলগুলি তোমার কথা মনে করে কিনি নি। তুমি আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা করছ। ভাবছ আমি সব মনে করে রাখি। এটা ঠিক না।
রাহেলা বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একটু সঞ্জুর ঘরে যাও তো। ওর মনে হয় শরীর খারাপ। সকালবেলা লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হয়েছে সারাদিন ফিরে নি। তুমি আসার ঘণ্টা দুএক আগে ফিরেছে। বাতি জ্বালায় নি। চা-নাশতা কিছুই খায় নি। যে রকম দিয়েছিলাম সে রকম পড়ে আছে।