সঞ্জু!
জেই।
আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো।
সঞ্জু মামার দিকে তাকাল।
একজন ক্রিমিন্যালকে পাশে বসিয়ে আমি যাচ্ছি এবং ক্রিমিন্যালের সঙ্গে কথা বলছি তার কারণ জানো?
সঞ্জু জবাব দিল না। তার কপালের দুটিা রগ ফুলে উঠল ইস্তিয়াক বলল, কপালের রগ ফুলিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। রগ ঠিক কর।
সঞ্জু মামার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিয়েছে। একটা দশ। এখন মধ্য দুপুর। ইস্তিয়াক বলল, তোমার মা কেমন ছিলেন সেটা তুমি জানো না কারণ তাকে তুমি দেখার সুযোগ পাও নি। তোমার বাবাকে তুমি দেখেছ। তিনি কেমন মানুষ তুমি কি জানো?
ভালো মানুষ।
ভালো মানুষের ডেফিনেশন কী? একেকজনের কাছে ভালো মানুষের ডেফিনেশন একেক রকম। একজন ক্রিমিনালের কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা এক রকম, একজন সাধুর কাছে অন্যরকম। আমি তোমার ডেফিনেশনটা শুনতে চাই।
মামা, আমার শরীর ভালো না। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
অন্যের কথা শুনতে কি ইচ্ছা করছে? নাকি অন্যের কথা শুনতেও ইচ্ছা করছে না।
আপনি কী বলবেন বলুন।
তোমার বাবা একজন ভালো মানুষ। তার ভালো মানুষ কোন পর্যায়ের সেই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বলে আমি মনে করি। ধারণা আছে?
না।
তোমার মা’র মৃত্যুর পর তোমার বাবা আবার বিবাহ করেন। তখন আমাদের খুবই দুর্দিন। আমরা দুই ভাই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। টাকা পয়সার ভয়ঙ্কর টানাটানি। তোমার বাবা আমাদের দুই ভাইয়ের ইউনিভার্সিটির পড়ার খরচ শেষ পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। এটা জানতে?
না।
আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচে ছোটজনের নাম আলতাফ। তোমার বাবা তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতো। ও আম খেতে খুব পছন্দ করত। সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। কোন কিছুই খেতে পারত না। যেদিন মারা যাবে সেদিন তাকে আম কেটে দেয়া হয়েছে। দেখা গেল খুব আগ্রহ নিয়ে আম খাচ্ছে। আমগুলি তোমার বাবা নিয়ে এসেছিলেন। আম খেতে খেতে সে তোমার বাবাকে বলল–দুলাভাই, আমি মরে যাচ্ছি এটা জানি। মরে যাবার পর আম খেতে পারব না এটা ভেবে খারাপ লাগছে। তার মৃত্যুর পর একজন মানুষ আম খাওয়া ছেড়ে দিল, সে হলো আমার বাবা। আমরা কেউ কিন্তু আম খাওয়া ছাড়লাম না। তোমার বাবা যে আম খান না এটা কি তুমি জানো?
জানি
কেন খান না জান?
এখন জানলাম।
আরো শুনবে?
না।
আমি খুবই একটা অন্যায় করেছি। তুমি যে ক্রাইমটা করেছ সেটা তাকে বলে তার মনে কষ্ট দিয়েছি। পৃথিবীর সব মানুষকে আমি কষ্ট দিতে পারি, তাকে কষ্ট দিতে পারিনা। আমি তার মনের কষ্টটা দূর করতে চাই।
কীভাবে?
আমি তাকে বলব পুলিশ আসলে একটা ভুল করেছে। সঞ্জু এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত না। তুমিও তোমার বাবাকে এই মিথ্যাটী বলবে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে মানুষটার জীবনের ব্রত সত্যি কথা বলা, তাকে পরামর্শ করে মিথ্যাকথা শুনতে হচ্ছে। চারদিক থেকে সে শুনবে মিথ্যা কথা, কিন্তু তাকে বলতে হবে সত্যি কথা।
গাড়ি উত্তরা ছড়িয়ে চলে গিয়েছিল। ইস্তিয়াক ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল।
সন্ধ্যাবেলা ফরহাদ উদ্দিন হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলেন। ফুলওয়ালী মেয়েগুলো বেলি ফুল বিক্রি করছে। ফরহাদ উদ্দিনের কাছে ভাংতি ছিল না। তিনি দশ টাকা দিয়ে পাঁচটা মালা কিনলেন। ফুলগুলো নাকের কাছে ধরতেই হালকা গন্ধ পেলেন। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। তার কি ঘ্রাণ শক্তি ফিরে আসছে? কুড়ি বছর পূর্ণ হতে বেশি বাকি নেই, এই জন্য কি কিছু কিছু ইচ্ছা পূর্ণ হতে শুরু করেছে? ফরহাদ উদ্দিন আরেকটা দশ টাকার নোট বের করে আরো পাঁচটা মাল কিনলেন। তাঁর শরীর কাঁপছে। আশ্চর্য ঘটনা। ফুলের মালাগুলো দ্বিতীয়বার নাকের কাছে ধরলেন। কোনো গন্ধ পাওয়া গেল না। একটু আগে যে সুঘ্রাণ পেয়েছিলেন এটা কি মনের ভুল? মনের ভুল হবার তো কথা না।
আশেপাশে কোথাও কি কোনো ডাস্টবিন আছে? যার পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকজন নাক চেপে যায়? ফুলের তীব্র গন্ধ না পেলেও ডাস্টবিনের তীব্র পুতিগন্ধ নাকে আসার কথা। ফরহাদ উদ্দিন ডাস্টবিন খুঁজতে লাগলেন। ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবেন নাকে কোনো গন্ধ আসে কিনা পরীক্ষা হয়ে যাবে। এই পরীক্ষা জটিল পরীক্ষা—এসিড টেস্ট। যখন যা খোজা যায় তখন সেটা পাওয়া যায় না। ফরহাদ উদ্দিন হেঁটে যাচ্ছেন কিন্তু চোখে কোনো ডাস্টবিন পড়ছে না। বেছে বেছে কি আজই ঢাকা শহর আবর্জনা মুক্ত হয়ে গেল?
তার বাসার কাছেই ময়লা ফেলার জায়গা একটা আছে। সানসাইন ভিডিওর দোকানটার বামে। লোকজন নাকে রুমাল না দিয়ে ঐ জায়গাটা পারই হতে পারে না। ফরহাদউদ্দিন ঠিক করলেন আজ তিনি সানসাইন ভিডিওর দোকানের আশেপাশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করবেন। ইস্তিয়াক বলেছিল হাসনাত নামের মানুষটা ছিল সানসাইন ভিডিওর মালিক। দোকানটার দিকে তিনি লক্ষ রাখছেন। কিছুদিন বন্ধ ছিল, এখন খুলেছে। লোকজন ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে ঢুকছে, বের হচ্ছে। মালিকের মৃত্যুতে ব্যবসা বন্ধ হয় নি। ব্যবসা চলছে। এমনকি হতে পারে দোকানের লোকজন তাদের মৃত মালিকের ছবি দোকানে টানিয়ে রেখেছে। তাহলে হাসনাত নামের লোকটা দেখতে কেমন ছিল জানা যেত।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মৃত মালিকের ছবি টানিয়ে রাখার রেয়াজ নেই, এতে ব্যবসা কমে যায়; তারপরেও ফরহাদ উদ্দিন কিছু কিছু জায়গায় এরকম দেখেছেন। শাপলা টেইলারিং হাউসে স্যুট টাই সানগ্লাস পরা একটা ছবি আছে।