সঞ্জু হতভম্ব গলায় বলল, আপনি এইসব কী বলছেন?
নোংরা কথা বলছি। তুমি মানুষ খুন করতে পারবে আর আমি দু’টা নোংরা কথা বলতে পারব না। তা তো না। গা থেকে পাঞ্জাবিটা খোল—আর লুঙ্গি খোল। লুঙ্গির নিচে আন্ডারওয়্যার আছে? থাকলে সেটাও খোল। নাংগু বাবা হয়ে যাও।
সঞ্জুর বুক ধ্বক করে উঠল। মকবুল হোসেনের গলার স্বর পাল্টে গেছে। কথা বলার ভঙ্গি পাল্টে গেছে। তবে মুখের অমায়িক ভাবটা এখনো আছে। সঞ্জুর এখন মনে হচ্ছে এই লোক করতে পারে না এমন কাজ নেই।
মকবুল হোসেন সিগারেট ধরাল। আরাম করে ধোঁয়া ছেড়ে ডাকল—-ফতে মিয়া। ঐ ফতে।
হাফ প্যান্ট পরা খালি গায়ের একজন বেঁটে লোক ঢুকল। অত্যন্ত বলশালী লোক। কিন্তু গলার স্বর মেয়েলি। সে চিকন গলায় বলল, স্যাররে আরেক কাপ চা দিমু?
মকবুল হোসেন বলল, দে।
লেম্বু চা না দুধ চা?
দুধ চা। তোর লেম্বু চা মুখে দেওয়া যায় না। চা দেয়ার আগে একটা কাজ কর, চেয়ারে হারামিটা বসে আছে তার কাপড় চোপড় খুলে তারে নেংটা কর। তারপর হাঁটু দিয়ে তার বিচিতে একটা বাড়ি দে। বেশি জোরে দিবি না, মরে যেতে পারে। দুই নম্বরীটা দে।
সঞ্জু তাকিয়ে আছে। বেঁটে লোকটা সত্যি তার দিকে এগিয়ে আসছে। এই তো লুঙ্গিতে হাত দিল। সত্যি সত্যি লুঙ্গি খুলে ফেলছে না-কি? কী হচ্ছে এসব? সঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল—কথা গলায় আটকে গেল। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো দুই পায়ের ফাঁকে তরল আগুন ঢেলে দিয়েছে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে আবার ফিরে আসছে আগের জায়গায়। আবার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর পুড়ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
সীমাহীন ব্যথা ঢেউ-এর মতো উঠা নামা করছে। সঞ্জু আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিল। সেই চিৎকারও গলায় আটকে গেল। তবে মিলিয়ে গেল না, মাথার ভেতর চিৎকারটা হতে থাকল। হতেই থাকল। সময় কি থেমে গেছে? কতক্ষণ পার হয়েছে? সে চেয়ারে এসে কখন বসেছে?
সঞ্জু!
উ
উ কীরে হারামজাদা! বল ইয়েস স্যার।
ইয়েস স্যার।
হাসনাতকে কে খবর দিয়ে এনেছে?
আমি।
ঘটনাটা কী ছিল?
টগর বিদেশে যাবার একটা সুযোগ পেয়েছিল। দুই লাখ পঁচিশ হাজার টাকার দরকার। টাকাটা জোগাড় হচ্ছিল না। প্রথমে সে টাকাটা ধার হিসেবে চেয়েছিল। হাসনাত ভাই রাজিও হয়েছিলেন টাকাটা দিতে। হঠাৎ বললেন, না। টগর গেল রেগে। আমরা ভয় দেখিয়ে উনার কাছ থেকে টাকাটা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলাম। উনি হঠাৎ এমন চিৎকার শুরু করলেন—দোতলার ভাড়াটে উপরে চলে আসল। তখন হাসনাত ভাই-এর মুখ চেপে ধরা হয়েছে যাতে শব্দ কেউ না শোনে।
এটা ঘটছে টগরের বাসায়?
জ্বি না টগরের চাচার বাসায়। ঐ বাসাটা খালি বাসা দেখা শোনার জন্য টগর সেখানে একা থাকত।
মুখ চেপে ধরার কারণে হাসনাত মারা গেল? মুখ কী দিয়ে চেপে ধরেছিলে, বালিস দিয়ে?
জ্বি।
তুমিই তো ধরেছ তাই না?
জ্বি।
তারপর ডেডবডি সরালে কীভাবে?
টেলিভিশন যে কার্টুনে থাকে সে রকম একটা বড় কার্টুন বাসায় ছিল। সেই কার্টুনে ভরে বেবিট্যাক্সি করে নিয়ে গেছে।
বেবিট্যাক্সি করে জসিম একা ডেডবডি নিয়ে গেছে?
জি একা নিয়ে গেছে।
মানুষ খুন করতে কেমন লাগল?
সঞ্জু চুপ করে আছে। মকবুল হোসেন বলল—তোমাকে যে ছোট্ট চিকিৎসাটা এখানে করলাম বিচি চিকিৎসা। এই চিকিসার কথা মনে রাখবে। চিকিৎসাটা করেছি ইস্তিয়াক স্যারের নির্দেশে। তুমি তেরিবেরি করছিলে তো–এই তেরিবেরি বন্ধ করার জন্য। স্যার খবর দিলে যাও না, হাসনাত নামের। কাউকে চেনো না—এইগুলি যেন পুরোপুরি বন্ধ হয়। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তিনজনে মিলে কাজটা করেছ। সেই তিনজনের ভেতর কেউ যদি ধরা পড়ে তাহলে সে বাকি দুজনকে ফাঁসাবে। তিনজনের একজনকে বাদ দেয়া যায় না। বাদ দিলে তিনজনকেই বাদ দিতে হয়। তখন অন্য কাউকে ফাসাতে হয়। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
বিচির ব্যথা কমেছে?
জ্বি না।
এই ব্যথা এক মাস থাকবে। চা খাবে?
জ্বি না।
ফতে মকবুল হোসেনের জন্য চা নিয়ে এসেছে। মকবুল হোসেন ফতের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল—-ফতে তোর আগের বাড়িটা দুই নম্বরী দিতে বলেছিলাম–তা তো দিস নাই। তিন নম্বরী বাড়ি দিয়েছিস। এর ব্যথা কমে গেছে। দেখ না কেমন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
স্যার দুই নম্বুরী একটা দিব?
দে।
সঞ্জু বিড় বিড় করে কী যেন বলল। কিছুই বোঝা গেল না। মকবুল হোসেন সঞ্জুর দিকে ঝুঁকে এসে বলল এখন তোমাকে দুই নম্বরী বাড়ি দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ জ্ঞান থাকবে না। বুঝতে পারছ? দুই বিচির জন্যে দু’টা ঠিক আছে না?
জ্বি।
জ্ঞান ফেরার পর পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে নিও। তোমার মামা আমাদের স্যার ইস্তিয়াক সাহেব এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। উনাকে খবর দেয়া হয়েছে। ঠিক আছে?
জ্বি।
আমাদের দুজনের মধ্যে সামান্য যে খেলাধুলা হলো এটা কাউকে বলার দরকার নাই।
জ্বি।
তাহলে দুই নম্বর বাড়ির জন্য তৈরি হও। দুই নম্বর বাড়িটা না খেলে ঘটনা বুঝতে পারবে না।
সঞ্জু গোঙাতে গোঙাতে বলল, স্যার একটু আস্তে বাড়ি দিতে বলেন।
.
সঞ্জু পুলিশের জিপে বসে আছে। সঞ্জুর পাশে তার মামা ইস্তিয়াক। দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না। ইস্তিয়াক মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে সঞ্জুকে দেখছে। যতবার সে তাকাচ্ছে ততবারই তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। সঞ্জু এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডিবি অফিস থেকে বের হয়ে সে বেশ অবাক হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল বাইরে এসে দেখবে রাত রাস্তার হলুদ বাতি জ্বলছে। অথচ বাইরে ঝকঝকে রোদ। সূর্যটা কোথায় দেখা যাচ্ছে না। সূর্য দেখা গেলে সময়ের আন্দাজ করা যেত। সঞ্জুর হাতে ঘড়ি নেই। তার মামার হাতে ঘড়ি আছে। আড়চোখে একবার তাকালেই সময় জানা যায়। আড় চোখে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ি বনানী পার হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। সঞ্জুদের বাসা বা তার মামার বাসা কোনোটাই এদিকে নয়।