ফরহাদ উদ্দিন আতঙ্কিত গলায় বললেন, তুমি কী বলছ মামা? ও মানুষ কীভাবে মা’রবে?
আচ্ছা যা মারে নাই। হাসনাতকে কোলে বসিয়ে গালে চুমু দিয়েছে। এটা ভেবে যদি মনে শান্তি পাস তাহলে তাই ভাব। মনে শান্তি পাওয়া দিয়ে কথা।
মামা এরকম করে কথা বলবে না। সঞ্জু তোমার ছেলে না। তুমি তাকে চিনবে না। আমার ছেলে আমি চিনি।
সালু মামা গম্ভীর গলায় বললেন, মানুষ নিজেকেই চিনে না সে তার ছেলেকে চিনবে কীভাবে? রবী ঠাকুরের বিখ্যাত গান আছে না–চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী ভুল গান। গানটা হওয়া উচিত—চিনি না চিনি না তোমারে ওগো বিদেশিনী। ফরহাদ চল তোর ঘরে আবার যাই। কয়েকটা টেলিফোন করি। দেখি কনকের মা’র ঠিকানা বের করা যায় কি-না। সময় নষ্ট করা ঠিক না। টাইম ইজ মানি।
সালু মামা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, সঞ্জুর ওজন কি পাঁচ ছয় কেজি বেড়েছে। ওজন বাড়ার কথা।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ওজন বাড়বে কেন?
মানুষ খুন করার পর খুনির ওজন বাড়তে থাকে। আট দশ কেজি পর্যন্ত বাড়ে। পরীক্ষিত সত্য। কেন বাড়ে জানি না। ব্যাপারটা রহস্যময়।
.
সঞ্জুর গায়ে জ্বর। কোলকাতা থেকে সে ফিরেছে জ্বর নিয়ে। আজ সারা দিনই সে দরজা বন্ধ করে বিছানায় পড়েছিল। এখন তার গায়ে ঘাম দিচ্ছে। জ্বর ছেড়ে যাবার লক্ষণ। গত দুদিন সে কোনো সিগারেট খেতে পারে নি। তামাকের গন্ধেই শরীর উল্টে যেত। সিগারেট ধরানো দূরের কথা সিগারেটের কথা ভাবলেই মাথা ঘুরত। এখন সে-রকম হচ্ছে না। সঞ্জুর মনে হলো সে একটা সিগারেট ধরাতে পারে। তার জ্বরটা সেরেছে কি-না সে পরীক্ষাও হয়ে যাবে। সিগারেট অর্ধেকের মতো টানতে পারলেও বুঝতে হবে জ্বর কমে যাচ্ছে।
ঘরে কোনো সিগারেট নেই। টেবিলের ড্রয়ারে একটা রিজার্ভ প্যাকেট সব সময় থাকে। সেই প্যাকেটটাও নেই। কোলকাতায় যাবার সময় কি সে এই প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল? মনে পড়ছে না। সে সিগারেট কেনার জন্য ঘর থেকে বের হলো। লুঙ্গি পরে সে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। আজ আর লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে ইচ্ছা করছে না। বাসার সামনেই দোকান। লুঙ্গি পরে যাওয়া যায়।
সঞ্জু দুপ্যাকেট সিগারেট কিনল। সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট হাতে নিল আর ঠিক তখনই অমায়িক চেহারার পাঞ্জাবি পরা লম্বা রোগী এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলল–আপনি সঞ্জু না?
সঞ্জু বলল, জ্বি।
ফরহাদ উদ্দিন সাহেবের বড় ছেলে?
সঞ্জু বলল, জ্বি।
ভালো আছেন?
সঞ্জু বলল, আপনাকে চিনতে পারছি না।
আমার নাম মকবুল। মকবুল হোসেন। আমাকে চেনার কথা না। আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনাকে কষ্ট করে একটু আমার সঙ্গে আসতে হবে।
কোথায়?
ডিবি অফিসে। দুএকটা রুটিন প্রশ্ন করব। পাঁচ-দশ মিনিটের ব্যাপার।
এখানে করুন।
একটু কষ্ট করতে হবে যে ভাইয়া। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, গাড়িতে উঠুন।
মকবুল হোসেন হাত বাড়িয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশের জীপ দেখাল। সঞ্জু শান্ত গলায় বলল, এখনই আমি গাড়িতে উঠতে পারব না। আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা বাড়িতে জানিয়ে যেতে হবে। আমার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে হবে।
মকবুল হোসেন হাসি হাসি মুখে বলল—লুঙ্গি তো খুব ভালো পোশাক। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ সারা জীবন লুঙ্গি পরেছেন। লুঙ্গি পরে দেশে বিদেশে ঘুরেছেন।
সঞ্জু কড়া গলায় বলল, আপনি সময় নষ্ট করছেন, আমি এভাবে যাব না।
সঞ্জুর কঠিন কথায় মকবুল হোসেনের মুখের হাসি নষ্ট হলো না। বরং তার মুখ আরো অমায়িক হয়ে গেল। সে এগিয়ে এসে সঞ্জুর কাঁধে হাত রেখে বলল—ভাইয়া গাড়িতে উঠতে হবে। এই মুহূর্তে। আমি হেংকি পেংকি পছন্দ করি না।
.
মোটামুটি অন্ধকার খুপড়ির মতো একটা ঘর। দিনের বেলাতেও সেই ঘরে বাতি জ্বলছে। তাতে অন্ধকার দূর হচ্ছে না কারণ একমাত্র জানালাটাও বন্ধ। ঘরের আসবাব বলতে বড় একটা কাঠের টেবিল। টেবিলের দুপাশে দু’টা হাতাওয়ালা কাঠের চেয়ার। ঘরের দু’টা দেয়াল ভর্তি র্যাক। র্যাকে ফাইলপত্র। সব ফাইলের ওপর ধুলা জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিন কেউ এইসব ফাইলে হাত দেয় না। মেঝেতে এক জোড়া ছেঁড়া গামবুট। এই ঘরেই কোথাও উঁদুর-টিদুর মরে পচে আছে। বিকট দুর্গন্ধ আসছে। সঞ্জু পাঞ্জাবি দিয়ে নাক ধরে আছে। তার ঠিক সামনেই বসে আছে মকবুল হোসেন। সে নির্বিকার। মনে হচ্ছে পচা ইঁদুরের গন্ধে তার কিছু যাচ্ছে আসছে না। মকবুল হোসেনের সামনে এক কাপ চা। সে বেশ আয়েশ করেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সঞ্জু বলল, কী জিজ্ঞেস করতে চান তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করুন। আমি এই ঘরে থাকতে পারছি না।
মকবুল হোসেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সঞ্জুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, হাসনাতকে বাসা থেকে টেলিফোন করে কে এনেছে তুমি না—না-কি তোমার অন্য দুই বন্ধুর একজন।
সঞ্জু বলল, হাসনাত নামে আমি কাউকে চিনি না।
মকবুল হোসেন বলল, ভাইয়া আমাকে রাগাবেন না। রেগে গেলে আমি খারাপ লোক হয়ে যাই। ড. জ্যাকেল মিস্টার হাইডের গল্প জানেন না?
খারাপ লোক হন আর যাই হন আমি হাসনাতকে চিনি না।
চিনেন না?
না।
মকবুল হোসেন চায়ে তৃপ্তির একটা চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোমার লুঙ্গির নিচে দু’টা বিচি আছে না? ঐ বিচি দু’টা যখন টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলব তখন সব চিনবে।