ক্যান্টিনে ঢুকে সালু মামা দু’টা সিঙ্গাড়া এবং আলুর চপ খেলেন। চাইনিজ চিকেন কর্ন সুপ পাওয়া যাচ্ছে। এক বাটি পঁচিশ টাকা। স্যুপেরও অর্ডার দিলেন। ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে বললেন—তোর যে সত্যি কথা বলার একটা বাতিক উঠেছিল সেটা এখনো আছে?
ফরহাদ উদ্দিন হুঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
কত বছরের যেন তোর প্ল্যান? কুড়ি না পঁচিশ?
কুড়ি।
শেষ হবে কবে?
ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরের তিন তারিখ।
তখন কী হবে? তুই কি পীর দরবেশ কিছু হয়ে যাবি?
না—তখন মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
সালু মামা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই যে এত বোকা জানতাম না। ডিফ এন্ড ডাম অর্থাৎ বোবারা কি মিথ্যা কথা বলতে পারে? তারা সারা জীবনে মিথ্যা বলতে পারে না। কথাই বলতে পারে না, মিথ্যা বলবে কী? তাদের কোন ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়? তুই যে শুধু বোকা তা না। মহাবোকা। এই জন্যে তোকে অত্যধিক স্নেহ করি। তোকে কতবার বলেছি কোনো সমস্যায় পড়লে আমার কাছে আসবি। নিজে নিজে সলভ করতে পারবি না। তোর সেই ক্ষমতা নেই। সব গুবলেট করে ফেলবি। আছে কোনো সমস্যা?
না।
সমস্যা ছাড়া মানুষ আছে? বন আছে পাখি নাই, মানুষ আছে সমস্যা নাই এটা কখনো হবে না। ভেবে টেবে দেখ।
একটা ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারবে মামা?
সালু মামা বিস্মিত হয়ে বললেন—কার ঠিকানা?
কনক বলে একটা মেয়ে আমার এখানে থাকে, তার মা’র ঠিকানা। ভদ্রমহিলা কাউকে কিছু না বলে অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে গেছেন। অনেক চেষ্টা করে উনার অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানা পাচ্ছি না।
তোর বন্ধু বদরুলের বউ-এর কথা বলছিস?
তোমার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? তার ঠিকানা বের করা কোনো ব্যাপারই না। অস্ট্রেলিয়ান এম্বেসির মাধ্যমে এগোতে হবে। সরাসরি এম্বেসির কাছে গেলে ওরা পাত্তা দিবে না। রেডক্রসের মিসিং পারসন ব্যুরোর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। তুই একটা কাগজে ভদ্রমহিলার নাম লিখে দে। নাম, বাবার নাম, স্বামীর নাম—পাত্তা লাগিয়ে দেব। এটা কোনো মামলাই না। সাত ধারার মামলার মতো সহজ মামলা। কোটে উঠার আগেই খালাস।
স্যুপ এসে গেছে। সালু মামা গভীর আগ্রহে স্যুপ খাচ্ছেন। ফরহাদ উদ্দিনের কেমন জানি গা গুলাচ্ছে। বমি ভাব হচ্ছে। মনে হচ্ছে সুপ থেকে কোনো বাজে গন্ধ ফরহাদ উদ্দিনের নাকে আসছে। কাঁচা মুরগির মাংসের গন্ধ। তার কি ঘ্রাণ শক্তি ফিরে আসছে?
তুই এমন নাক কুচকাচ্ছিস কেন?
শরীর খারাপ লাগছে।
এক বাটি স্যুপ খা। স্যুপটা এরা ভালো বানায়। দশে এদের আট সাড়ে আট দেয়া যায়। মাঝে মাঝে তোর অফিসে এসে স্যুপ খেয়ে যাব। গাদাখানিক সিঙ্গাড়া সমুচা খাওয়ার চেয়ে এক বাটি স্যুপ খাওয়া ভালো।
ফরহাদ উদ্দিন বমি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। সঞ্জু কোলকাতা থেকে ফেরার পর তার সঙ্গে যখন দেখা হলো তখনো ফরহাদ উদ্দিনের এমন হলো। সঞ্জুর গা থেকে কি কোনো গন্ধ আসছিল? ভেজা কাপড় অনেকদিন ট্রাংকে রেখে দিলে ছাতা পড়ে এক ধরনের গন্ধ বের হয় সে-রকম কিছু? যে গন্ধে বমি বমি ভাব হয়। কিন্তু বমি হয় না। খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। সঞ্জুর সামনে তিনি বমি বমি ভাব নিয়ে বসে রইলেন। সঞ্জু বলল, বাবা তোমার জন্যে এক জোড়া স্যান্ডেল এনেছি। রাদুর স্যান্ডেল। সঞ্জু ব্যাগ থেকে স্যান্ডেল বের করে তার সামনে রাখল। তখন তিনি বুঝলেন–এতক্ষণ তিনি যে গন্ধ পাচ্ছেন সেটা কাঁচা চামড়ার গন্ধ। সঞ্জুর সামনে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। সালু মামার সামনে বসে মনে হচ্ছে ঘ্রাণশক্তি সত্যি সত্যি ফিরে আসছে। তার জীবনে খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি ঘ্রাণশক্তি ফিরে পাচ্ছেন। কাগজি লেবুর গন্ধ কেমন তিনি ভুলেই গেছেন! প্রথম যেদিন পাবেন সেদিন আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটবে। প্রথম হয়তো কিছুক্ষণ বুঝতেই পারবেন না গন্ধটা কিসের।
ফরহাদ, তুই ঝিম ধরে আছিস কেন?
শরীরটা ভালো লাগছে না মামা।
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নে। আমার সঙ্গে চল।
কোথায় যাব?
ইন্টারেস্টিং কোনো জায়গায় নিয়ে যাই চল। বাসা-অফিস, অফিস-বাসা করে তো জীবনটাই শেষ করে দিলি। শরীরের আর দোষ কী? শরীর আনন্দ চায়, উত্তেজনা চায়। মদ খেয়েছিস কখনো?
জি না।
কী আশ্চর্য কথা, একটা জীবন পার করে দিলি জিনিসটা চেখে না দেখেই? সারা পৃথিবীর মানুষ এই জিনিস খাচ্ছে মদের ব্যবসা হলো কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা। সেই জিনিস এক ঢোক খাবি না? আমার সঙ্গে চল আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। গান বাজনা শুনবি। ইচ্ছা হলে এক আধটু বিয়ার টিয়ার খাবি। বিয়ার মদের মধ্যে পড়ে না। বিয়ার খেলে দোষ নেই। সঞ্জুর ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করার জন্যেও এটা করা দরকার। মাইন্ড রিলাক্সেসন।
মামা থাক।
আচ্ছা থাক। সঞ্জু যে কোলকাতা থেকে ফিরেছে তার আচার ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন দেখেছিস?
না।
শক্ত ছেলে, ভেরি টাফ। গাইডেন্সের অভাবে পিছলে পড়ে গেছে। টেনে তুললেও লাভ হবে না, আবার পড়ে যাবে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, মামা, ও হাসনাত নামের কাউকে চিনে না। আমি মিথ্যা কথা বলছি না মামা। তুমি তো জানো আমি মিথ্যা বলি না।
তুই অবশ্যই সত্যি কথা বলছিস। সত্য কথা বলার সাধনা করছিস, সত্যি কথা তো তোকে বলতেই হবে। তোর ছেলে তো আর সে-রকম কোনো সাধনা করছে না। ও মিথ্যা বলছে। মানুষ যে মারে তার কাছে মিথ্যা কিছু না।