রাহেলা বললেন, এখন কেমন লাগছে?
ফরহাদ উদ্দিন নিচু গলায় বললেন, ভালো।
তোমাকে ওরা রাত এগারোটার সময় দিয়ে গেছে। এখন বাজে সাড়ে তিনটা। এতক্ষণ তুমি ঘুমাচ্ছিলে।
ও আচ্ছা।
আমি যে কী ভয় পেয়েছি একমাত্র আল্লাহপাক জানেন।
ঘরের আলোটা একটু নেভাও না। চোখে লাগছে।
রাহেলা বললেন, ঘরে বাতি জ্বলছে না তো। বারান্দায় বাতি।
ও আচ্ছা। আর মানুষজন কোথায়?
সবাই জেগে আছে। আমি এ ঘরে আসতে নিষেধ করেছি। ডাক্তার বলে দিয়েছে কেউ যেন তোমাকে ডিসটার্ব না করে।
ও আচ্ছা।
এখন কি শরীরটা ভালো লাগছে?
হুঁ।
কিছু খাবে?
খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাব।
রাহেলা পানি আনার জন্যে উঠে গেলেন। দরজায় মিতু, সেতু, নীতু আর কনক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেউ ঘরে ঢুকছে না। সেতু বলল, ভালো আছ বাবা?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভালো আছিরে মা।
তুমি সবাইকে ভয় দেখাতে এত পছন্দ কর কেন বলো তো বাবা? ভয়ে আমার সর্দি লেগে গেছে।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেললেন। এই মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলে না হেসে পারা যায় না। ভয়ে আবার কারো সর্দি লাগে না-কি?
রাহেলা পানির গ্লাস নিয়ে ঢুকলেন। মেয়েরা দরজা থেকে সরে গেল। রাহেলা বললেন, চায়ের চামচ দিয়ে পানি মুখে দিয়ে দেব?
ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসতে বসতে বললেন, আরে না। আমি ভালো আছি। এখন শরীরটা ঝরঝরে লাগছে।
তিনি তৃপ্তি করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করলেন। রাহেলা বললেন, তুমি আজ যে আমাদের কী বিপদে ফেলেছ! আমরা সবাই সেজে গুঁজে বসে আছি। তোমার দেখা নেই। তুমি কোথায় গিয়েছ তাও জানি না। রাত নটা বেজে গেল। ঐ ছেলে রেস্টুরেন্টে একা বসে আছে। একটু পর পর সেখান থেকে টেলিফোন করছে। শেষে তোমাকে ছাড়াই চলে গেলাম।
খুব ভালো করেছ।
সেখানে গিয়ে আমি পড়লাম লজ্জায়। ঐ ছেলে কিছুতেই বিল দিতে দিবে। সে যে শুধু খাবারের বিল দিল তা না প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা গিফট। আমার জন্যে শাড়ি, তোমার জন্যে পাঞ্জাবি। প্রত্যেক মেয়ের জন্যে একটা করে শাড়ি। কোনোটাই এলেবেলে না। দামি জিনিস। ছেলের খরচের হাত বেশ ভালো।
ফরহাদ উদ্দিন হাসলেন। রাহেলা বললেন, ছেলের এই দিকটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। খরুচে ছেলে, কাউটা না।
কাউটা জিনিসটা কী?
কাউটা হলো কৃপণ। মেয়েরা সবাই খুবই আনন্দ করেছে। আর সেতু কী করেছে এটা শোন~ সে বলল, আপনি সবার জন্যে গিফট এনেছেন, আমার ভাইয়ার গিফট কোথায়? ওর জন্যে গিফট আনেন নি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, এক কাজ করুন—ক্যাশ টাকা দিয়ে দিন, আমরা পছন্দ মতো কিনে নেব। আর আমাদের কাজের মেয়ে আছে, সে বাদ পড়বে কেন। বুঝে দেখ তোমার মেয়ের অবস্থা।
ফরহাদ উদ্দিন হাসছেন। রাহেলা বললেন, হাসবে না। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোমাকে দেখে সে-রকম মনে হচ্ছে না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই খুশি। খুবই আনন্দিত।
আনন্দিতই ছিলাম, বাসায় এসে দেখি তুমি বিছানায় আধমরা হয়ে পড়ে আছ। কাজের মেয়েটা বলল—একজন মহিলা এসে গাড়ি করে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মহিলা বলে গেছেন তোমার শরীর সামান্য খারাপ। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। এবং বলেছেন যেন তোমাকে জাগানো না হয়।
ভদ্রমহিলা কে? তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।
রাহেলা বললেন তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে? তোমার জন্যে খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এসেছি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমি কিছু খাব না।
রাহেলা বললেন, তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
তিনি শুয়ে পড়লেন। তাঁর একটু শীত শীত লাগছে। ফ্যানের স্পিড একটু কমিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু এই কথাটা রাহেলাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। রাহেলা কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর খুবই ভালো লাগছে।
রাহেলা বললেন, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে যাই তোমার ঐ মামা, সালু মামা—কয়েকবার টেলিফোন করেছেন। তোমাকে তার নাকি বিশেষ দরকার। কী দরকার বলো তো?
জানি না।
রাহেলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার কাছে অনেক কিছু গোপন কর। এটা আমার ভালো লাগে না। কারো কাছে কোনো কিছু গোপন করার অর্থ তাকে অবিশ্বাস করা। দীর্ঘ দিন তোমার সঙ্গে জীবন যাপন করেও তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারি নি এটা খুবই দুঃখের কথা।
রাহেলা বললেন, আজ সন্ধ্যায় তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। এরকম ভাব করলেন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইচ্ছা করে নিঃশ্বাসের শব্দ ভারী করলেন। রাহেলার প্রশ্নের জবাব দিলে তাকে সত্যি কথা বলতে হবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মিথ্যা বলা যাবে না। রাহেলাকে এই মুহূর্তে কোনো সত্যি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?
ফরহাদ উদ্দিন ঘুমের অভিনয়টা আরো ভালো করার চেষ্টা করলেন। গাঢ় ঘুমের সময় মানুষ নিঃশ্বাস দ্রুত ফেলে না ধীরে ধীরে ফেলে এটা মনে পড়ছে না। মনে পড়লে ভালো হতো।
সালু মামা বললেন
সালু মামা বললেন, ব্যাপার কী তুই তো বুড়ো হয়ে গেছিস! চুলটুল পাকিয়ে গাল ভেঙ্গে কী অবস্থা। চাপার দাঁত পড়েছে? চাপার দাঁত না পড়লে তো গাল ভাঙ্গার কথা না।
ফরহাদ উদ্দিন বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। সালু মামা তার থেকে খুব কম করে হলেও পনেরো বছরের বড়। তাকে মোটেও সে-রকম লাগছে না। সুন্দর করে আঁচড়ানো কুচকুচে কালো চুল। পরনে ঘি রঙের ফতুয়া। মুখভর্তি হাসি। এক একবার হাসছেন ধবধবে সাদা দাঁত ঝকঝক করে উঠছে। মানুষের এত সাদা দাঁত সচরাচর চোখে পড়ে না। ফরহাদ উদ্দিন মোটামুটি মুগ্ধ চোখে তার মামার দাঁতের দিকে তাকিয়ে আছেন। সালু মামা বললেন, কলপ দিস না কেন? আমাকে দেখ, ইয়াং ভাব এখনো কিছুটা আছে না? ‘