ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তুমি তো অনেক ঝামেলা করেছ।
দুলি বলল, যে খেতে ভালোবাসে তাকে খাওয়াতে ভালোলাগে। এবাড়িতে কেউ খেতে পছন্দ করে না। ইস্তিয়াকের কাছে খাওয়াটা অত্যাচারের মতো। ডাল ভাত সে যেমন অনাগ্রহের সঙ্গে খাবে পোলাও কোরমাও সেরকম অনাগ্রহের সঙ্গে খাবে। দুলাভাই আপনি খাওয়া শুরু করুন।
একা একা খাব?
বাসায় আর কেউ নেই যে আপনার সঙ্গে বসবে। আমি বসতে পারি। আমি ভেজে দেবে কে? আপনি সঞ্জুর ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আরাম করে খান।
ওর ব্যাপারে ভাবছি না।
সঞ্জুর মামা সব ব্যবস্থা করবে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। মকবুল সাহেবকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে৷
মকবুল সাহেব কে?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। পুলিশ ইন্সপেক্টর।
ও আচ্ছা।
সেদিন বাসায় এসেছিলেন। আমিও কথা বলেছি৷
ভালো করেছ
এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে ভালো একটা মেয়ে দেখে সঞ্জুর বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। সংসারের জোয়াল কাধে পড়লে অন্য কোনো দিকে তাকাতে পারবে না। ওর নিজের কোনো পছন্দের মেয়ে যদি না থাকে আমাকে বলবেন। আমার হাতে ভালো ভাল কিছু মেয়ে আছে।
আচ্ছা।
খাওয়া শুরু করুন। প্রথম খান কুমড়া বড়া।
ফরহাদ উদ্দিন হেতে শুরু করলেন। যখন খেতে বসেছিলেন তখন মনে হয়েছিল ক্ষিধে নেই–এখন মনে হচ্ছে প্রচুর ক্ষুধা।
ভালো রান্না বিরাট গুণ।
দুলি খুবই গুণী মেয়ে।
দুলাভাই, বড়া খেতে ভালো হয়েছে?
খুব ভালো হয়েছে।
বড়া ভাজায় দশে আমাকে কত নম্বর দেবেন?
দশে নয়।
এখন চেপা ভর্তা খান। চেপা ভর্তা যে ঠাণ্ডা ভাত দিয়ে খেতে হয় এটা জানেন?
না।
চেপা ভর্তায় খুব ঝাল দেয়া হয় বলে গরম ভাত দিয়ে খাওয়া যায় না। ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত দিয়ে খেতে হয়। ঠাণ্ডা ভাত আমি আলাদা করে রেখেছি।
তুমি দেখি দারুণ একটা মেয়ে।
বাইম মাছের তরকারিটা এত ভালো হয়েছে যে খেয়ে ফেলতে পর্যন্ত মায়া লাগছে। দুলি বলল, আমি অনেকবার শুনেছি পারুল আপা আপনার কথা উঠলেই না-কি বলতেন, আপনার মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় না। আপনি এমন কী করতেন যে পারুল আপা এই ধরনের কথা বলত?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, আমি এমন কিছু করি নি।
শুধু শুধু তো একজনের সম্পর্কে এমন কথা বলা হয় না। নিশ্চয়ই কিছু করেছেন।
কিছু করলেও আমি জানি না। আমি বোকা মানুষ। বোকা মানুষ কোনো কাজ ভেবে চিন্তে করে না।
আপনি কি নিজেকে বোকা ভাবেন?
ভাবাভাবির কিছু নাই। আমি বোকা।… আপনার বাইম মাছ রান্না অসাধারণ হয়েছে।
দুলি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে হঠাৎ আপনি করে বলছেন কেন?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, ভুল হয়ে গেছে। আমার মাথাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব কেমন আউলা ঝাউলা লাগে। কোনটা আমার বড় মেয়ে আর কোনটা মেজো ধরতে পারি না। ছোটজনকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। বড় দুজনকে নিয়ে খুবই ঝামেলা হয়। আপনাকে বলতে ভুলে গেছি আমার মেজো মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওর নাম মিতু না সেতু এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ওদের নাম রাখার একটা ফর্মুলা বের করেছিলাম—MSN ফর্মুলা। এটাতেও ঝামেলা লেগে গেছে। MSN না-কি SMN নিয়ে গণ্ডগোল। আমার কথাবার্তা আপনি মনে হয় কিছু বুঝতে পারছেন না।
না।
বোঝার কথাও না। আজ খাওয়াটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে। হাঁসফাস লাগছে। আপনাদের ঘরে পান আছে? পান থাকলে একটা পান খাব। না থাকলে অসুবিধা নেই, দোকান থেকে কিনে নেব।
ফরহাদ উদ্দিন খাওয়া বন্ধ করে হড়বড় করা কথা বলেই যাচ্ছেন। দুলি চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে।
খাওয়া বেশি হয়েছে তো এই জন্যে আজ অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে। শরীরের ক্যালোরি হেঁটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এখান থেকে সরাসরি হেঁটে বাসায় যাব। এতেও কাজ হবে না। আরো হাঁটা দরকার।
দুলি বলল, আপনি হাত ধুয়ে ফেলুন। প্লেটের উপরই ধুয়ে ফেলুন। বেসিনে যাবার দরকার নেই। হাত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন—আমি পান আনিয়ে দিচ্ছি। পানে কি আপনি জর্দা খান?
না জর্দা খাই না। তবে আজ একটু খেয়ে দেখি। এক কাজ কর–পান যখন আনাচ্ছ সেই সঙ্গে একটা সিগারেটও আনাও। খেয়ে দেখি একটা সিগারেট। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রতি মাসে হলে ফিস্ট হতো। ফিস্টের দিন আমি আর বদরুল একটা সিগারেট কিনতাম। ভাগাভাগি করে খেতাম। আমি তিন চারটা টান দিয়ে তাকে দিতাম, সেও কয়েকটা টান দিয়ে আমাকে দিত। ঐ সিগারেট টানাটানি থেকেই বদরুলের সিগারেটের নেশা ধরে গেল। আমার ধরল না।
আপনার জন্যে তো ভালোই।
বদরুলের মেয়েটা এখন আমার কাছে আছে। কনক নাম। অতি ভালো মেয়ে। দেখি একবার আপনার এখানে নিয়ে আসব।
বেশ তো নিয়ে আসবেন।
আমার মনে একটা গোপন ইচ্ছা আছে। সঞ্জুর সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দেয়া। হবে কি-না জানি না। বিয়ের ব্যাপারটা আল্লাহপাক ঠিক করে রাখেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই।
দুলি বলল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? কেমন করে যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।
ফরহাদ উদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। বেশি খেয়ে ফেলেছি এই জন্যে বোধহয়। বমি আসছে। আপনাদের বাথরুমটা কোন দিকে?
তিনি বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারলেন না। তার আগেই ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন। ফরহাদ উদ্দিনের দৃশ্যমান পৃথিবী দুলছে। ঘরটা ঘুরছে, দুলি ঘুরছে, খাবার টেবিল ঘুরছে। তিনি ঘূর্ণায়মান ঘরের দিকে একবার করে তাকাচ্ছেন আর বমি করছেন। তিনি কোথায় শুয়ে আছেন? নিজের বাড়িতে? না-কি এটা হাসপাতাল? নিজের বাড়ির এক ধরনের গন্ধ থাকে। গায়ের ঘামের গন্ধের মতো আপন আপন গন্ধ। সেই গন্ধটা এখন পাচ্ছেন না। তাছাড়া চোখে আলো লাগছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে বাতি কখনো বন্ধ করা হয় না। সারারাত চোখে আলো লাগে। গলব্লাডার অপারেশনের সময় তিনি আটদিন হাসপাতালে ছিলেন। সেই স্মৃতি মনে আছে। ফরহাদ উদ্দিন পিটপিট করে চোখ মেলে আবারও বন্ধ করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন কপালে হাত রাখল। ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এটা হাসপাতাল না। হাসপাতালে চোখ মেলা মাত্র কেউ কপালে হাত রাখে না।