ইস্তিয়াক ঝুঁকে এসে বলল—ভালো করে মনে করে দেখুন এপ্রিল মাসের নয় তারিখ থেকে তের তারিখ পর্যন্ত সে বাড়িতে ছিল না। মোট পাঁচ দিন। মনে পড়েছে?
ফরহাদ উদ্দিন হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
ফরহাদ উদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন, আমি তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। সঞ্জু তো হাসনাত নামের কাউকে চিনেই না। হাসনাতের নাম শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে।
ইস্তিয়াক বিরক্ত গলায় বলল, দুলাভাই আপনি বোকা নাকি বোকার ভান করছেন এটা বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা আপনি ভান করছেন। ভানে কাজ দেবে না। বাস্তব চিন্তা করতে হবে। সঞ্জু লুকিয়ে কোলকাতায় বসে আছে। কত দিন সে ওখানে থাকবে—এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, এক বছর! তাকে তো দেশে আসতে হবে। দেশে এলেই এরেস্ট হবে। আর যদি তার অনুপস্থিতিতে মামলা চলে তাহলে ডেথ পেনাল্টি তো হবেই। ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।
ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ইস্তিয়াকের কোনো কথাই এখন তাঁর মাথায় ঢুকছে না। এখন মনে হচ্ছে ইস্তিয়াক ফিসফিস করে কথা বলছে। বেশির ভাগ কথাই শব্দহীন। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। তাঁর নিজের মাথাও এখন সামান্য দুলছে। এটা হচ্ছে সিগারেটের গন্ধে। সিগারেটের ধোয়া তার সহ্য হয় না। অথচ একটা লোক তার সামনে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে।
আপনি ভেঙে পড়বেন না। আমি আছি, আমার যা করার আমি করব। ব্যাপারটা জানাজানি হতে দেয়া যাবে না। এরেস্ট হয়ে কোর্ট কাছারি হয়ে ছাড়া পাওয়া এক কথা আর একেবারেই জানাজানি হওয়া আরেক কথা। বুঝতে পারছেন কী বলছি?
পারছি।
কাজেই শুরুতেই টাকা দরকার। ভালো এমাউন্টের টাকা দরকার।
ও আচ্ছা।
পুলিশের যে অফিসার এই কেইসটা ইনভেস্টিগেট করছে তাকে আমি সঞ্জুর কথা বলেছি। উনার নাম মকবুল হোসেন। ডিবির পুলিশ ইন্সপেক্টর। কেইসটা চলে গেছে ডিবিতে মকবুলকে বলা হয়েছে। ফাইনাল রিপোর্টে যেন সঞ্জুর নাম না যায়।
ফাইনাল রিপোর্টটা কী?
ফাইনাল রিপোর্ট হলো পুলিশ তদন্ত করে একটা চার্জশিট দেয়। মকবুল কাজটা করবে। তবে তাকে আলাদা করে টাকা দিতে হবে। কোনো উপায় নেই। ছয় সাত লাখ টাকা খরচ হবে। ঘটনাটা কী ঘটেছিল শুনতে চান?
কী ঘটনা?
হাসনাতের খুন হবার ঘটনা। এরা তিনজনে মিলে কাজটা কীভাবে করল।
ফরহাদ উদ্দিন কিছু বললেন না। এখন তার পেটে মোচড় দিচ্ছে। নিঃশ্বাসেও সামান্য কষ্ট হচ্ছে। মাথায় পানি ঢালতে পারলে ভালো হতো।
দুলাভাই, মন দিয়ে শুনুন কী ঘটনা। হাসনাতের ভালো নাম মোহাম্মদ আবুল হাসনাত। আপনাদের বাড়ির কাছেই তার ক্যাবল কানেকশনের অফিস আছে—নাম হোম ভিডিও। তার একটা ভিডিওর দোকানও আছে, সেটার নাম সানসাইন ভিডিও। এটাও আপনাদের বাড়ির কাছে। অফিসে যেতে আসতে নিশ্চয়ই দেখেছেন। সঞ্জু প্রায়ই ভাড়া করে ভিডিওর দোকান থেকে ক্যাসেট আনত। সেই সূত্রে ভিডিওর দোকানের মালিকের সঙ্গে তার ভালো পরিচয়। হাসনাতকে সে ডাকত হাসনাত ভাই। মাঝে মাঝে সে আর তার দুই বন্ধু মিলে হাসনাতের বাসায় আড্ডা দিত। মদ টদ খেত।
কী খেত?
মদ ফেনসিডিল এইসব খেত। ঘটনার দিন সকালবেলা সঞ্জু টেলিফোন করে হাসনাতকে দোকান থেকে বের করে নিয়ে এলো…
ফরহাদ উদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আরেকদিন শুনব। তাছাড়া আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। যে ছেলেটার সঙ্গে সেতুর বিয়ে হচ্ছে তাকে নিয়ে আমরা বাইরে কোথাও খেতে যাব।
ইস্তিয়াক বলল, আমার তো মনে হয় আপনার এখনই শোনা উচিত। রিয়েলিটি ফেস করতে হবে। হবে না?
হুঁ।
আপনার যে একজন মামা ছিলেন, ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ সালু মামা। উনাকে অফিসে ডেকে এনেছিলাম, তিনি পুরো ঘটনা জানেন।
ও।
তার সঙ্গে সব কথা হয়েছে। আমাদের প্ল্যান অব একশান কী হবে সেটাও আলাপ হয়েছে। প্রথম কথা, ছেলেকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দ্বিতীয় কথা, জানাজানি করা যাবে না। আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
হুঁ।
তাহলে থাক। আমাকে আবার একটু বেরুতে হবে। আপনি খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন না? দুলি আপনার জন্যে বাইম মাছ আনিয়েছে। দুলি হাসনাতের পুরো ব্যাপারটা জানে। আপনি ওর কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন।
ফরহাদ উদ্দিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। অদ্ভুত ঘটনা ইস্তিয়াক কী বলছে এখন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। বিদেশী কোনো ভাষায় কথা বললে যেমন ক্যাচ কাঁচ শব্দ মাঝে শোনা যায় সেরকম শোনা যাচ্ছে।
ইস্তিয়াক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো তার বুকের ওপর থেকে বড় একটা চাপ নেমে গেছে। এতক্ষণ কেউ একটা পাথর বসিয়ে রেখেছিল। ইস্তিয়াক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন পাথরটা সরাল। ফরহাদ উদ্দিন পা উঠিয়ে চেয়ারে বসে রইলেন। দুলি যখন এসে বলল, দুলাভাই খেতে আসুন—তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। আজ রাত আটটায় তার যে সবাইকে নিয়ে খেতে যাবার কথা তা আর মনে রইল না। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। ক্ষিধেয় পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে।
দুলি অনেক কিছু রান্না করেছে। কাঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ, বাইম মাছের ঝোল, চেপা ভর্তা, কুমড়া ফুলের বড়া। খেতে বসে ফরহাদ উদ্দিনের মন ভালো হয়ে গেল। কুমড়া ফুলের বড়া সেই কবে ছেলেবেলায় খেয়েছিলেন আর খাওয়া হয়নি। দুলি বলল, আজ সব স্পেসাল আইটেম রান্না হয়েছে। চিংড়ি মাছের একটা প্রিপারেশন আছে গরম ভেজে দিতে হয়। সব রেডি করে রেখেছি। আপনি খেতে বসলেই ভেজে নিয়ে আস।