ফরহাদ উদ্দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বদরুলের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার সোহাগীতে গিয়েছেন। তার ক্ষীণ সন্দেহ ছিল—বদরুল হয়তো তার গ্রামের বাড়িতে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বদরুলের যে স্বভাব তার জন্যে এটা বিচিত্র কিছু না। গ্রামের বাড়িতে তাকে পাওয়া গেল না, তবে কিছুদিন পরপরই উড়ো খবর পাওয়া যেতে লাগল। একজন তাকে দেখেছে মুন্সিগঞ্জে এক চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। একজন তাকে দেখেছে অজিমীর শরীফে খাজা বাবার দরগায়।
কনকের মা সাবেরা বেগম মেয়েকে নিয়ে পড়ল মহা বিপদে। একজন মানুষ মরে যাওয়া এক কথা আর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অন্য কথা। মৃত মানুষের ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না। নিখোঁজ মানুষের সে সম্ভাবনা থাকে। সেই সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুতি থাকতে হয়।
সাবেরা বেগম ছয় মাসের মতো বদরুলের ভাড়া করা বাড়িতে থাকল। তারপর সংসার গুটিয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে গেল। ভাইয়ের বাসায় বেশি দিন থাকা গেল না। থাকার কথাও না। ঢাকা শহরে একটা পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো মানুষ বেশি নেই। শুরু হলো সাবেরা বেগমের যাযাবর জীবন। এর বাড়িতে কিছুদিন। চার মাস পর আরেক বাড়িতে কিছুদিন। মাঝে মাঝে ফরহাদ উদ্দিন তাদের দেখতে যান। সাবেরা বেগম কাঁদো কাদো গলায় বলে—-ভাই সাহেব, একটা কিছু বুদ্ধি দেন তো। আমি কী করব? পড়াশোনাও জানি না যে চাকরি বাকরি করব। আয়ার চাকরি করতে পারি কিন্তু মেয়েটাকে রাখব কোথায়? মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন। আগুনের মতো রূপ হয়েছে—তার বাপ আমাকে যে যন্ত্রণায় ফেলেছে এই মেয়ে তারচে দশগুণ যন্ত্রণায় আমাকে ফেলবে।
তারপর একদিন শুনলেন কনকের মা’র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ধর্মের দিক থেকে এই বিয়ে শুদ্ধ। যে সময় পর্যন্ত স্বামী নিখোঁজ থাকলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায় বদরুল তার চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। সাত বছর তিন মাস। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেই ছেলে কী একটা এনজিওতে কাজ করে। ভালো বেতন পায়। ফরহাদ উদ্দিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক সব রক্ষা হয়েছে। একদিন ওদের নতুন সংসার দেখতে গেলেন। দেখে মুগ্ধই হলেন। বেশ সুন্দর গোছানো ছিমছাম সংসার। ঘরে টিভি, ফ্রিজ আছে। নতুন সোফা সেট। কনকের সৎবাবী ঘরে ছিল না, তবে বসার ঘরে কনকের মা’র সঙ্গে তোলা দুজনের ছবি দেখলেন। ভদ্রলোকের কেমন যেন গুণ্ডা গুণ্ডা চেহারা। রাগী রাগী চোখ। বদরুল পাশার একেবার বিপরীত। বদরুলের ছিল ঠাণ্ডা চেহারা। যখন হাসত তখন মনে হতো সারা শরীর দিয়ে হাসছে। নিজে হাসত অন্যকে হাসাত। ছবির এই ভদ্রলোক সে-রকম হবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে একেকজন মানুষ একেক রকম। কেউ হাসবে, কেউ রাগী চোখে ঠোঁট মুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকবে।
সাবেরা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কোনো উপায় না দেখে বিয়েতে রাজি হয়েছি। ভাই, আপনি আমার উপর রাগ করবেন না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ছিঃ ছিঃ ভাবি। আমার রাগ করার কথা আসছে কেন? আপনি যা করেছেন ভালোই করেছেন।
আমার শুধু ভয় লাগছে এখন যদি কনকের বাবা ফিরে আসে তাহলে কী হবে?
আসুক ফিরে তারপর দেখা যাবে।
আমার মন বলছে ফিরে আসবে। যখনই এটা মনে হয় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ভাই, আপনি সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। আমি দুঃখী একটা মেয়ে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভাবি আমি অবশ্যই যোগাযোগ রাখব।
ফরহাদ উদ্দিন যোগাযোগ রেখেছেন।
গত মাসে হঠাৎ একদিন কনকের মা তার অফিসে টেলিফোন করলেন—খুবই প্রয়োজন, তিনি যেন পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও তাদের বাসায় আসেন। সম্ভব হলে আজই। তিনি সেদিনই অফিস শেষ করে গেলেন।
সাবেরা বেগম ফরহাদ উদ্দিনকে দেখে অকূলে কূল পেয়েছেন এরকম ভাব করলেন। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভাবি কেমন আছেন? অনেক দিন পরে কথা হচ্ছে। নতুন টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন? তার আগে বলেন, আপনি আছেন কেমন?
সাবেরা বেগম বললেন, বেশি ভালো না। ভাই সাহেব, আপনি আমার ছোট্ট একটা উপকার করবেন? ছোট্ট উপকার না, আসলে বড় উপকার।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, অবশ্যই করব। কী করতে হবে বলুন।
ছয়-সাত দিনের জন্যে আমার মেয়েটাকে আপনার বাসায় রাখবেন। আমি ওর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। আমি কনককে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। বুঝতেই তো পারছেন—গ্রাম দেশ, নানান জনে নানান কথা বলবে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, বদরুলের মেয়েকে এক সপ্তাহের জন্যে নিজের বাসায় নিয়ে রাখব এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি বলুন কবে এসে নিয়ে যেতে হবে। আমি সেদিনই আসব।
আবার কবে আসবেন, না আসবেন—আজই নিয়ে যান। ভাই সাহেব, আপনার পায়ে পড়ি। আমার এই উপকারটা আপনি করেন। আমি কনকের স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছি। সাতটা দিন একটু কষ্ট করেন।
ফরহাদ উদ্দিন অবাকই হলেন। এত তাড়াহুড়া কেন বুঝতে পারলেন না। তিনি কনককে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলেন। কথা নেই বার্তা নেই বন্ধুর মেয়ে নিয়ে উপস্থিত হওয়াটা রাহেলা কী চোখে নেবে কে জানে। মেয়েটা থাকবেই বা কোন ঘরে। বাড়তি ঘর তো নেই। কনক থাকবে কোথায়? ভালো সমস্যা হলো তো!
তিনি যে-রকম ভেবেছিলেন সে-রকম কিছু হলো না। রাহেলা অবাক হয়ে বললেন—এই মেয়েকে তো আমি ছোটবেলায় দেখেছি। সে তো তখন এত সুন্দর ছিল না। এখন এত সুন্দর হয়েছে কীভাবে। এই মেয়ে তুমি কী সাবান মাখ?।