দুপুরে খাবার পর ফরহাদ উদ্দিন খুবই আরাম করে ঘুমুলেন। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তাদের খাবার কথা রাত নটায়। হাতে সময় আছে। তিনি ইস্তিয়াকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এখন বাজে ছটা। যেতে আসতে এক ঘণ্টা। তিনি থাকবেন আধঘণ্টা। সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে আসবেন।
ঘর থেকে বেরুবার মুখে রাহেলার সঙ্গে দেখা। রাহেলা অবাক হয়ে বললেন, এখন বের হচ্ছে কোথায়? রাতের দাওয়াতের কথা মনে আছে?
ফরহাদ উদ্দিন হাসিমুখে বললেন, মনে আছে। সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরব।
রাস্তায় যদি বেলি ফুলের মালা পাও আমার জন্য নিয়ে এসো। বেলি ফুল পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমি চোখে দেখলাম না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তুমি আগেও বলেছিলে—মনে ছিল না। আজ অবশ্যই নিয়ে আসব।
.
ইস্তিয়াক বিস্মিত হয়ে বলল, আপনাকে বলেছিলাম সঞ্জুকে নিয়ে আসতে, ও কোথায়?
ও গেছে কোলকাতায়। বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট। চারটায় ছিল রিপোর্টিং। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ওকে এয়ারপোর্টে তুলে দিয়ে আসব। যত কাছেই হোক বিদেশ যাত্রা।
আসবে কবে?
আসবে কবে তাতো জানি না। তবে বেশিদিন থাকবে না—তার ভাইবা বাকি আছে। পড়াশোনার ব্যাপারে এই ছেলে আবার খুবই সিরিয়াস।
ইস্তিয়াকের ভুরু কুঁচকে আছে। মানুষটাকে সামান্য বিরক্ত মনে হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন ইস্তিয়াকের বিরক্তির কারণ ধরতে পারছেন না। সঞ্জুকে আনা হয় নি—বিরক্তি কি এই কারণেই? আজ আসে নি, অন্য আরেক দিন আসবে।
ইস্তিয়াক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, দুলাভাই আপনাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে আপনি খুবই আনন্দিত।
আমি বেশির ভাগ সময় আনন্দেই থাকি। অফিসেও এখন ঝামেলা কম। ও আচ্ছা, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি—আমার দুনম্বর মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলের সবই ভালো। একটু বোধহয় নাকে কথা বলে। এটা কোন সমস্যা না। মেয়ের ছেলেকে পছন্দ—এটাই বড় কথা।
ভালো তো।
আমার অবশ্যি ইচ্ছা ছিল প্রথমে সঞ্জুর বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনব, তারপর মেয়ে বিয়ে দেব। সেটা আর হলো না। সঞ্জু চাকরি বাকরি ঠিক না করলে তার বিয়ে দেয়া ঠিক না। তুমি কী বলো?
ইস্তিয়াক জবাব না দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ফরহাদ উদ্দিন তাকিয়ে থাকলেন। তিনি তার সামনে বসে থাকা গম্ভীর চেহারার এই মানুষটাকে ছোটবেলায় দেখেছেন। লাজুক ধরনের ছেলে ছিল। একবার তাকে এসে বলল, দুলাভাই দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক দেখবেন? দড়ি কেটে জোড়া লাগিয়ে দেব।
তিনি হ্যা বলার আগেই সে দড়ি কেটে জোড়া লাগিয়ে ফেলল। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এরকম আশ্চর্য ম্যাজিক তিনি জীবনে কমই দেখেছেন। সেই ছেলে আজ গম্ভীর মুখে সামনে বসে আছে। একটার পর একটা সিগারেট টানছে। পুলিশের বড় অফিসার ভাবটা চেহারাতে চলে এসেছে। কারণ ফরহাদ উদ্দিনের তাকিয়ে থাকতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। অথচ ভয় লাগার কিছু নেই। ইস্তিয়াক তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অনেকদিন যোগাযোগ নেই, তাতে কী হয়েছে! আত্মীয় মানে আত্মীয়। ইস্তিয়াকের পরনে পুলিশের পোশাকও নেই যে ভয় লাগবে। লুঙ্গির উপর একটা গেঞ্জি পরেছে। পুলিশের অফিসার লুঙ্গি পরে বসে আছে ভাবতে জানি কেমন লাগছে।
ইস্তিয়াক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, সঞ্জু যে বিরাট এক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে এটা বলার জন্যেই তাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। সঞ্জুর এক বন্ধু, তার নাম টগর। সে পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সেখানে সঞ্জুর নাম আছে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, হাসনাত সাহেবকে নিয়ে কোনো ঝামেলা? সঞ্জু হাসনাত সাহেবের সঙ্গে কী গণ্ডগোল করেছে আমি জানি না। তবে আমার ধারণা তুমি একটা ভুল করছ। হাসনাতকে সে চিনে না। টগর নামের যে ছেলেটা সঞ্জুর কথা বলেছে সে অন্য কোনো সঞ্জুর কথা বলেছে। ঢাকা শহরে অনেক সঞ্জু আছে। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার সঙ্গে আরো দুইজন ফরহাদ পড়ত। এক ক্লাসে তিন ফরহাদ। ভেবে দেখ কী অবস্থা! আমাদের তিনজনকে আলাদা করার জন্যে ছাত্ররা আমাদের কী ডাকত জানো? একজনকে ডাকত বে ফরহাদ! বে ফরহাদ মানে বেকুব ফরহাদ। আরেকজনের নাম ছিল বু ফরহাদ। বু ফরহাদ মানে বুদ্ধিমান ফরহাদ। আর থার্ডজনের গু ফরহাদ। ওর মুখ থেকে খুব দুর্গন্ধ আসত বলে ওর নাম হয়ে গেল গু ফরহাদ। মুখে গু ফরহাদ বলতে খারাপ লাগে বলে আমরা বলতাম G ফরহাদ। G হলো গু।
ফরহাদ উদ্দিন শরীর দুলিয়ে হাসছেন। ইস্তিয়াকের মুখে হাসি নেই। ফরহাদ উদ্দিন খুবই অবাক হয়ে দেখলেন–ইস্তিয়াকেরও কপালের মাঝখানের দু’টা রগ ফুলে উঠেছে।
কপালের রগ ফুলানোর এই ব্যাপারটা সঞ্জু নিশ্চয়ই তার মামাদের কাছ থেকে পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা মামাদের দিকগুলি বেশি পায়।
দুলাভাই, আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন।
মন দিয়েই তো শুনছি।
যতটুকু মন দিয়ে শুনছেন তার চেয়েও একটু বেশি মন দিন। হাসনাত নামের এক ভিডিও ব্যবসায়ী খুন হয়েছে। যে তিনজন মিলে তাকে খুন করেছে সেই তিনজনের একজন সঞ্জু।
ফরহাদ উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। তিনি ইস্তিয়াকের কথা শুনতে পাচ্ছেন। আবার একই সঙ্গে আরো একজনের কথা শুনতে পাচ্ছেন, তবে বুঝতে পারছেন না কারণ সে বিড়বিড় করছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথা পুরোপুরি খারাপ হবার আগে মাথার ভেতর নানান রকম শব্দ হয়।