যাচ্ছিস নাকি কোথাও?
হুঁ।
কোথায় যাচ্ছিস?
কোলকাতা যাব।
তোর তো ভাইবা বাকি আছে।
ভাইবার এখনো ডেট হয় নি।
হঠাৎ কোলকাতা যাচ্ছিস কেন?
সঞ্জু জবাব দিল না। ছেলেকে নিয়ে এই সমস্যা—একবার প্রশ্ন করলে জবাব পাওয়া যায় না। একই প্রশ্ন দুবার তিনবার করতে হয়।
তোর মামা বলছিল তোক নিয়ে তার বাসায় যেতে। তোর সঙ্গে কী নাকি জরুরি কথা।
সঞ্জু বিরক্ত মুখে বলল, তোমাকে তো একবার বলেছি যাব না।
আচ্ছা ঠিক আছে, যেতে না চাইলে যাবি না। কোলকাতা কখন যাচ্ছিস?
রাত নটায় বাস ছাড়ে।
টাকা পয়সা লাগবে?
না।
বিদেশে যাচ্ছিস, হাতে কিছু টাকা পয়সা তো থাকা দরকার।
সঞ্জু জবাব দিল না। তার ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। সে বাবার সামনের চেয়ারে বসল। টেবিলে পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ। সে চায়ে চুমুক দিল। পুরো ব্যাপারটা ফরহাদ উদ্দিন খুব আগ্রহ করে দেখলেন। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ আগে চোখে পড়ে নি। বাপ ছেলে দুজনে এক সঙ্গে চা খাচ্ছে। এই ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে। ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন–তোর বেড়াতে ভালো লাগে?
সঞ্জু জবাব দিল না। বাবার দিকে তাকালও না। মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। ফরহাদ উদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন—বেড়ানোর শখ ছিল আমার বন্ধু বদরুলের। সারাক্ষণ নানান প্ল্যান প্রোগ্রাম–অমুক জায়গায় যাবে তমুক জায়গায় যাবে। একবার তো তার পাল্লায় পড়ে বিনা পাসপোর্টে আগরতলা চলে যাচ্ছিলাম। ত্রিপুরার মহারাজার বাড়ি দেখবে। সে এক ইতিহাস,..
ফরহাদ উদ্দিন দীর্ঘ ইতিহাস বলতে পারলেন না। সঞ্জু তার আগেই উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, আমি এখন বের হবো।
তোর কোলকাতা রওনা হবার আগে আমার সঙ্গে দেখা হবে না? আমাকে আবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ইস্তিয়াকের ওখানে যেতে হবে। দুলি আমার জন্য বাইম মাছ রান্না করবে। দুলিদের ওখানে খাওয়া যাবে না। রাতে বাসার সবাই বাইরে খেতে যাচ্ছে। তুই থাকলে ভালো হতো। পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবার উপস্থিত থাকা দরকার।
চায়ের কাপ হাতে ফরহাদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। সঞ্জু মনে হয় বিরক্ত হচ্ছে। তিনি ঘরে বসে আছেন বলে সে বের হতে পারছে না। সে বাইরে গেলে ঘর তালা দিয়ে যায়।
সঞ্জু বলল, বাবা কোলকাতা থেকে তোমার জন্য কী আনব?
ফরহাদ উদ্দিনের মনটা আনন্দে ভরে গেল। ছেলে এখনো বাইরে যায় নি। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে কার জন্য কী আনবে। এরই নাম মায়া। মানুষ যেখানেই থাকুক তার মন পড়ে থাকে সংসারে। ফরহাদ উদ্দিন গাঢ় স্বরে বললেন, কিছু আনতে হবে না রে ব্যাটা। তুই ভালোমতো থাকিস। রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করবি না। কোলকাতা শহরের রোদ খুবই কড়া—এক ঘণ্টায় চামড়া কালো করে ফেলে। আমাদের অফিসের হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছে। শুনেছি।
সারাটা দিন ফরহাদ উদ্দিনের খুব আনন্দে কাটল। তাড়াহুড়া করে পত্রিকা পড়তে হলো না। আরাম করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকা পড়লেন। আজকাল সব পত্রিকার সঙ্গেই একটা করে ম্যাগাজিন থাকে। ম্যাগাজিন পড়েও আনন্দ পেলেন। একটু পর পর কনক এসে জিজ্ঞেস করছে, চাচাজি চা খাবেন? তিনি চা খান না, তারপরেও দুপুর বারোটার মধ্যে তিন কাপ চা খেয়ে ফেললেন।
কনক মেয়েটা অন্যদের মতো না। সে চায়ের কাপ রেখেই চলে যায় না। যতক্ষণ চা খাওয়া না হয় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার সঙ্গে গল্পগুজব করা যায়। কনকের এই স্বভাবটা আগে লক্ষ করলে তিনি ঘন ঘন চা দিতে বলতেন।
ফরহাদ উদ্দিন চা খেতে খেতে অনেক গল্প করলেন। সব গল্পই সামান্য উদ্দেশ্যমূলক। আকারে ইঙ্গিতে সঞ্জুর প্রশংসা। এই মেয়েটার মন সঞ্জুর প্রতি কৌতূহলী করার সূক্ষ্ম চেষ্টা।
বুঝলে মা, সঞ্জুর সঙ্গে তোমার স্বভাবের বেশকিছু মিল আছে। মিলগুলো তুমি লক্ষ করেছ?
না।
একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের মিল-অমিল লক্ষ করতে হয়। এতে অনেক কিছু শেখা যায়। সঞ্জুর সঙ্গে তোমার মিলগুলো হলো—সঞ্জু কথা কম বলে। তুমিও কথা কম বলো। সঞ্জু শান্ত, তুমিও শান্ত। সঞ্জুর সঙ্গে তোমার বাবারও বেশকিছু মিল আছে। সঞ্জু বেড়াতে পছন্দ করে, তোমার বাবাও বেড়াতে পছন্দ করত। আজ এখানে কাল ওখানে। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে একবার যে পাসপোর্ট ছাড়া প্রায় আগরতলা চলে গিয়েছিলাম সেই গল্প বলেছি?
না।
গল্প না, যাকে বলে ইতিহাস। প্রথম গেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বদরুল করল কী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা থেকে আমার আর তার নামে দু’টা পারমিট বের করল। সেখানে লেখা আমাদের দুজনের দু’টা গাই গরু সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গেছে। গরু দু’টা খুঁজে আনার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে থাকার পারমিট। স্থানীয় ভাষায় এর নাম গরু পাসপোর্ট। আমার তো সাহস কম। আমি বদরুলকে বললাম—গরু পাসপোর্ট নিয়ে আমি যাব না। বদরুল রাগ করে আমাকে ফেলে একাই চলে গেল। তার চলে আসার কথা সন্ধ্যার মধ্যে, ফিরল আট দিন পরে। সে ত্রিপুরা মহারাজার বাড়ি, নীর মহল, আরো কী সব হাবিজাবি দেখে এসেছে। এদিকে টেনশানে আমার প্রথমে হয়েছে ডায়রিয়া, তারপর হয়ে গেল রক্ত আমাশা। সঞ্জুরও এরকম অভ্যাস আছে। কাউকে কিছু না বলে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে চলে গেল। একবার ছয়দিন তার কোনো খোঁজ নেই। দরজা তালাবন্ধ করে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলেও যায় নি। সেবারও টেনশানে আমার ডায়রিয়া হয়ে গেল। ডায়রিয়া থেকে রক্ত আমাশা। এই আমার এক সমস্যা।