বিরাট আনন্দের কিছু ঘটেছে। কী ঘটেছে তিনি অনুমান করার চেষ্টা করলেন। অনুমান করা গেল না। বালিশের নিচে রাখা হাতঘড়িতে সময় দেখলেন—এগারোটা দশ। তাঁর আঁতকে উঠার কথা। অফিস শুরু হয় নটায়। কোনো কারণ ছাড়াই অফিস কামাই হলো। কিন্তু তিনি আঁতকে উঠলেন না, যে ভাবে শুয়ে ছিলেন সেই ভাবেই শুয়ে রইলেন।
মেয়েরা হাসছে। ছোটাছুটি করছে। শুনতে ভালো লাগছে। তবে শরীর ক্লান্ত। কাল সারা রাত জেগে ছিলেন। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এখনো কাটছে না। তবে একটা ভালো কাজ হয়েছে—সকালের আলোয় মনে হচ্ছে গত রাতটা জেগে কাটানোর কোনো কারণ ছিল না। ভুল বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা। ইস্তিয়াক সঞ্জুকে চিনে না। তিনি চেনেন।
ফরহাদ উদ্দিন বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললেন। রাহেলা বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিনি চায়ের কাপ হাতে উঠে এলেন। রাহেলার মুখ হাসি হাসি। আনন্দময় যে ঘটনায় বাড়ির সবাই উল্লসিত সে ঘটনায় রাহেলারও ভূমিকা আছে। ঘটনাটা কী হতে পারে?
তোমার ঘুম শেষ পর্যন্ত ভাঙল? কতবার যে দরজা ধাক্কানো হয়েছে। ঘটনা কী বলো তো? অফিসও তো মিস করেছ! সেতু বলল তুমি সারা রাত ঘুমাও নি। সে রাত চারটার সময় ঘুম ভেঙে পানি খেতে খাবার ঘরে এসে দেখে তুমি বারান্দায় বসে আছ।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, শরীরটা একটু খারাপ।
শরীর খারাপ সে তো তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় ডায়াবেটিস আরো বেড়েছে। ব্লাড সুগারটা আরেকবার দেখাও। এক কাজ কর, আজ যখন অফিসে যাও নি–আজই যাও।
দেখি।
মিতু বাবাকে দেখতে পেয়ে দূর থেকে নাকি গলায় বলল, বাবা চা খাবে? চা বানিয়ে আঁনব?
ফরহাদ উদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, এই মেয়ে নাকি গলায় কথা বলছে। কেন?
রাহেলা মুখের হাসি চাপতে চাপতে বললেন, সেতুর যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে নাকি নাকে কথা বলে। এই জন্যে সবাই নাকে কথা বলা প্র্যাকটিস করছে।
নাকে কথা বলে?
আরে না, নাকে কথা বলবে কী জন্যে? তোমার মেয়েরা হয়েছে জগতের ফাজিল। সবকিছু নিয়ে ফাজলামি করে।
সেতুর ছেলে পছন্দ হয়েছে?
মুখে বলছে ছেলে পছন্দ হয় নি। নাকে কথা বলে কাজেই ভূত-টাইপ ছেলে। আমার ধারণা খুবই পছন্দ। দশটার সময় ছেলের টেলিফোন এসেছে। সেতু এখনো কথা বলছে।
বিয়ে কবে?
বিয়ে কবে সেটা তো তুমি ঠিক করবে। তুমি মেয়ের বাবা। সবকিছু আমি ঠিক করব নাকি?
.
নীতু বারান্দায় ছুটে এসে মাকে বলল, মা সেঁতু আঁপা এতক্ষণ আঁপনি আঁপনি করে কথা বলছিল। এখন উঁমি তুমি করে বঁলছে। এসো, শুনে যাও। কী যে হাস্যকর লাগছে।
রাহেলা বললেন, তোরা শোন, আমি কী শুনব?
আঁড়াল থেকে শুনবে। খুব মজা পাবে।
নীতু এসে মায়ের হাত ধরে টানছে। রাহেলা এমনভাবে এগুচ্ছেন যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় যাচ্ছেন। অথচ তাঁর চোখে মুখে আগ্রহ ফেটে বের হচ্ছে।
ফরহাদ উদ্দিন শাস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার কাছে মনে হলো সংসার অতি সুখের জায়গা। যে-কোনো মূল্যে এই সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়। রাহেলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিরে আসছেন। ফরহাদ উদ্দিনের হঠাৎ ইচ্ছা করল মেয়েদের মতো নাকি সুরে কথা বলে রাহেলাকে চমকে দেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি যদি বলেন–কী হয়েছে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাঁসছ কেন? তাহলে কেমন হয়? না, ভালো হয় না। মেয়ে-জামাইকে নিয়ে রসিকতা করা যায় না।
রাহেলা বললেন, কী হয়েছে, এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? হাত মুখ ধুয়ে এসো নাশতা খাই। আমি তোমার জন্যে এখনো নাশতা খাই নি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, কনক কোথায়?
কনক কলেজে গেছে। ওর পরীক্ষার রুটিন দিবে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আজ যখন অফিস মাটিই হলো তখন এক কাজ করা যায়। চল আমরা সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাই।
কখন যাবে?
এখন চল।
সেতু বলছিল তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে—এখন তো মনে হচ্ছে আসলেই তাই। দুপুরের এই রোদে কেউ চিড়িয়াখানায় যায়। আর তোমার মেয়েদের কি এখন চিড়িয়াখানায় যাবার বয়স আছে? বরং এক কাজ কর—চল রাতে সবাইকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাই।
চল যাই।
ছেলেটাকেও খেতে বলি। তুমি তো তাকে দেখ নি। দেখবে, কথা কথা বলবে।
আচ্ছা বলো।
রাহেলা অনিন্দিত ভঙ্গিতে এই খবর বড় মেয়েকে দিতে গেলেন আর তখনই ফরহাদ উদ্দিনের মনে পড়ল আজ তার দুলিদের বাসায় যাবার কথা। ইস্তিয়াক কী যেন বলবে। দুলি তাকে বাইম মাছ খাবার দাওয়াত দিয়েছে। ভালো ঝামেলা হয়ে গেল।
ফরহাদ উদ্দিন ঠিক করলেন—সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ও বাড়িতে যাবেন। আধ ঘণ্টাখানিক থেকে চলে আসবেন। দুলিকে বলবেন মাছের তরকারিটা ফ্রিজে রেখে দিতে। পরে কোনো একদিন এসে খেয়ে যাবেন। দুলিকে বিষয়টা বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে। দুলি অবুঝ মেয়ে না।
.
সঞ্জুর ঘরের দরজা খোলা। চায়ের কাপ নিয়ে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরের দিকে এগোলেন। তাঁর কাছে মনে হলো হঠাৎ করে অফিস বাদ দিয়ে ভালোই হয়েছে কাজের দিনের সংসারের স্বাদটা পাওয়া যাচ্ছে। ছুটির দিনের সংসার এক রকম আবার কাজের দিনের সংসার আরেক রকম।
কী করছিস সঞ্জু? বলতে বলতে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরে ঢুকে পড়লেন। সঞ্জু সিগারেট টানছিল। জানালা দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে বাবার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। তার হাতে কালো রঙের বড় একটা হ্যান্ডব্যাগ। সে হ্যান্ডব্যাগে কাপড় রাখছে। ফরহাদ উদ্দিনের সামান্য মন খারাপ হলো। ছেলেটা আরাম করে সিগারেট খাচ্ছিল—বাবাকে দেখে ফেলে দিতে হলো।