সঞ্জু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে এর মানে কী? সে কী ঝামেলায় জড়াবে। পলিটিক্স যারা করে তারা ঝামেলায় জড়ায়, বিজনেস ম্যানেরা ঝামেলায় জড়ায়। সঞ্জু এর কোনটাতেই নেই। রাত নটা বেজে গেছে সঞ্জু বাসায় ফিরে নি এরকম কখনো হয় নি। এই ছেলে কী ঝামেলায় পড়বে। সমস্যাটা কী? ইস্তিয়াকের কাছ থেকে জেনে নেয়া ভালো ছিল।
তার মাথা দপদপ করছে। সমস্যার পুরো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ঘুম আসবে না। ঘুমের সমস্যা তার নেই, তবে মাঝে মাঝে খুব ছোট ছোট জিনিস তাকে যন্ত্রণা দেয়। কেউ তাকে একটা ধাঁধা জিঞ্জেস করল তিনি উত্তর বের করতে না পেয়ে রাতে বিছানায় জেগে বসে থাকলেন। ধাঁধা জিজ্ঞেস করত পারুল। মশারি খাটাতে খাটাতে জিজ্ঞেস করল, এই বলো তো দেখি—
কুটুর মুটুর শব্দ হয়
আসলে তা শব্দ নয়।
জিনিসটা কী?
জানি না তো জিনিসটা কী?
চিন্তা করে বের কর। কুটুর মুটুরের মধ্যেই উত্তরটা আছে।
এটা খুবই কঠিন ধাঁধা, এটা পারব না।
চেষ্টা না করেই বলছ পারব না—চেষ্টা কর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাব।
তখন তাঁর আর ঘুম আসে না। মাখার ভেতর ধাঁধা চলতে থাকে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন। তার পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায় পারুল।
জেগে রাত পার করার এই অভ্যাস সঞ্জুরও আছে। ছোট বয়স থেকেই আছে। মা’র মৃত্যুর পর তিনি সঞ্জুকে নিয়ে ঘুমুতেন। সঞ্জুর আলাদা বিছানা হলো সঞ্জু ক্লাস ফাইভে উঠার পর। তখন হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তিনি লক্ষ করেছেন সঞ্জু তার গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে আছে। যেন পাথরের মূর্তি। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সময়ও মানুষের শরর সামান্য নড়াচড়া করে সঞ্জুর তাও হচ্ছে না। সে মশারির একটা কোনার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
সঞ্জু কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
বাথরুমে যাবি?
না।
পানি খাবি?
না।
ঘুম আসছে না?
আসছে।
আসছে তাহলে জেগে বসে আছিস কেন?
জানি না।
কোনো কিছু নিয়ে মন খারাপ?
না।
স্কুলে মাস্টার বকেছে?
না।
শুয়ে থাক, পিঠ চুলকে দেই।
আচ্ছা।
তিনি অনেকক্ষণ পিঠ চুলকে দেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এক সময় নিশ্চিত হয়ে যান সঞ্জু ঘুমুচ্ছে। তখন কোমল গলায় বলেন, সঞ্জু ঘুমাচ্ছিস?
সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলে, হু।
ঘুমের মধ্যে কথা বলছিস কীভাবে?
আমি ঘুমের মধ্যে কথা বলতে পারি।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেলেন। শিশুদের সঙ্গে জীবনযাপন করা খুব আনন্দের ব্যাপার। না এখানে ভুল করা হলো, মানুষের সঙ্গে জীবনযাপন করাই আনন্দের। সঞ্জুর সঙ্গে এখন গিয়ে টুকটাক গল্প করতে পারলে তার আনন্দই হবে। আগের দিনের মতো বিছানায় নিজের পাশে নিয়ে ঘুমুতে পারলে আরো আনন্দ হবে। সঞ্জু খালি গায়ে শুয়ে থাকল, তিনি পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন—সঞ্জু একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব দেখি উত্তর দিতে পারিস কি-না—-
কুটুর মুটুর শব্দ হয়।
আসলে তা শব্দ নয়।
ধাঁধাটা তোর মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি জবাব দিতে পারি নি। তোর তো বুদ্ধি আমার চেয়ে অনেক বেশি, তুই হয়তো পারবি। আচ্ছা আয় এক কাজ করি দুজনে মিলে ভেবে ভেবে বের করি উত্তরটা কী? বুঝলি সঞ্জু, তোর মা মোটামুটি অদ্ভুত মেয়ে ছিল ধাঁধা ধরত কিন্তু ধাঁধার উত্তর দিত না। আমরা কী করি? একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, উত্তর না পারলে নিজেরা বলে দেই। তোর মা এই কাজটা কখনো করত না। কত ধাঁধা যে জিজ্ঞেস করেছে একটারও উত্তর দিয়ে যায় নি। সবগুলি এখন মনেও নেই। ও আচ্ছা আরেকটা মনে পড়েছে—
আকাশে জন্মে কন্যা
পাতালে মরে
হাত দিয়া ধরতে গেলে
ছটর ফটর করে।
কি পারবি? সহজ না, কঠিন আছে। তোর মা যে সব ধাঁধা জিজ্ঞেস করত সবই কঠিন।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। শহরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। রাত গম্ভীর হলেই শুধু শোনা যায়। জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া আসছে। শরীরটা মনে হয় খারাপ করছে। জ্বর সত্যি সত্যি আসছে। জ্বর না এলে এত ঠাণ্ডা লাগার কথা না। গায়ে চাদর আছে তারপরেও শরীর কাঁপছে। ইস্তিয়াকদের ওখানে কাল মনে হয় যাওয়া হবে না। জ্বর নিয়ে তো কেউ আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় না। দুলি বেচারি বাইম মাছ রান্না করে বসে থাকবে। কিছু করার নেই। অসুস্থ অবস্থায় অতি সুখাদ্যের কথা ভাবলেও বমি বমি ভাব হয়।
বারান্দায় কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে। সঞ্জু কি হাঁটছে? তাকে ডেকে ঘরে নিয়ে এলে কেমন হয়? অসুস্থ বাবার পাশে খানিকক্ষণ বসল। এতে ক্ষতি তো কিছু নেই। বরং কথায় কথায় জিজ্ঞেস করা যেতে পারে সে কোনো সমস্যায় পড়েছে কিনা। প্রেম বিষয়ক কোনো সমস্যা না তো? তবে ইস্তিয়াকের গলার স্বরে মনে হচ্ছিল জরুরি কিছু। ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসলেন। খাটে হেলান দিয়ে অন্ধকারে বসে রইলেন। সঞ্জুর মায়ের একটা ধাঁধারও তিনি সমাধান বের করতে পারেন নি। এখন আর চেষ্টা করে লাভ নেই। সমাধান বের করলেও সেই সমাধান তাকে জানাতে পারবেন না। তবু উত্তরটা জানা থাকল। কন্যা বাস করে আকাশে, তার মৃত্যু হয় পাতালে। হতি দিয়ে ধরলে সে ছটর ফটর করে। কী হতে পারে? বৃষ্টি কি হতে পারে? বৃষ্টির জন্ম আকাশে, তার মৃত্যু মাটিতে কিন্তু হাত দিয়ে ধরলে সে তো ছটর ফটর করে না।
হাসাহাসির শব্দে ফরহাদ
হাসাহাসির শব্দে ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভাঙল।
তিনি অনুভব করলেন সারা বাড়িতে আজ তুমুল উত্তেজনা। মেয়েরা ছোটাছুটি করছে। একজন দরজায় ধাক্কা খেয়েছে, ব্যথা পেয়েও হাসছে। তুমুল আনন্দের মুহূর্তে শারীরিক ব্যথা-বেদনাও আনন্দময় মনে হয়।