ফরহাদ উদ্দিন রান্নাঘরের দিকে এগুলেন। ইস্তিয়াক টেলিফোন ধরে বসে আছে। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ঠিক না হলেও কিছু করার নেই। মানুষ সব সময় ঠিক কাজ করতে পারে না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হয়ে যায়।
যা ভাবছিলেন তাই। চুলায় চায়ের কেতলি। অপরিচিত মাঝ বয়েসী একটা মেয়ে চায়ের কাপ ধুচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিনকে দেখে সে মাথায় কাপড় দিল। ফরহাদ উদ্দিন অপরিচিত বুয়াকে দেখে অবাক হলেন না। এ বাড়িতে প্রায়ই বুয়া বদল হয়। একদিনে তিনবার বুয়া বদলের ঘটনাও ঘটেছে। সকালে ছিল একজন। তার চাকরি চলে গেল দুপুরের আগে আগে। বিকেলে নতুন একজন এলো। রাতে ভাত খাবার সময় দেখা গেল অন্য আরেকজন।
ফরহাদ উদ্দিন ঘোমটা পর বুয়াকে বললেন, আমাকে এক কাপ চা দিও
বুয়া মাথা নাড়ল।
চিনি দিও না, আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। চিনি খাওয়া নিষেধ। আমাকে দিবে হালকা লিকারের চা।
জ্বি আচ্ছা।
শুধু সকালবেলা দুধ চা দিবে। সেখানেও চিনি দেয়ার দরকার নেই। কনডেন্সড মিল্কে যতটুকু চিনি থাকে তাতেই আমার চলে।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি কি রান্নাঘরে ঘুমাবে নাকি?
বুয়া জবাব দিল না। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, রান্নাঘরে ঘুমালে অবশ্যই গ্যাসের চুলার চাবি ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাবে। চাবি সামান্য খোলা থাকলেও গ্যাস লিক করে। রান্নাঘর ভর্তি হয়ে যায় গ্যাসে। একসিডেন্ট হয়। পত্রিকা খুললেই এরকম একটা দু’টা একসিডেন্টের খবর পাওয়া যায়। বুঝতে পারছ কি বলছি?
জ্বি।
ফরহাদ উদ্দিন কথা বলার আর কিছু পাচ্ছেন না। আরো কিছুক্ষণ কথা বললে হতো। আরো কিছু সময় পার হতো। এর মধ্যে ইস্তিয়াক নিশ্চয়ই টেলিফোন রেখে দেবে। পুলিশের লোকের এত ধৈর্য থাকবে না যে দশ মিনিট টেলিফোন কানে নিয়ে বসে থাকবে। ইস্তিয়াকের সঙ্গে এখন আর তাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি যা করবেন তা হলো টেলিফোনের কানেকশন খুলে রাখবেন।
বুয়া তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
মইমনসিং।
মৈমনসিংহ তো বিরাট জায়গা। মৈমনসিং-এর কোথায়?
ফুলপুর।
ঢাকা থেকে যাতায়াত ব্যবস্থা কী? বাস?
জ্বি।
মৈমনসিং-এর অনেক জায়গায় গিয়েছি। ফুলপুরে যাওয়া হয় নি। দেখি একবার যাব।
বারান্দায় চটির ফটফট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ব্যস্ত পায়ে কে যেন আসছে। সেতু আসছে। তিন মেয়ে উপস্থিত থাকলে কে আসছে তার জন্যে আগে ভাগে বলে দেয়া মুশকিল হতে। তিন মেয়েই একই ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটে।
বাবা, তুমি রান্নাঘরে কী করছ?
চা দিতে বললাম।
চায়ের কথা বলতে এতক্ষণ লাগে। রান্নাঘর থেকে বের হও তো।
ফরহাদ উদ্দিন রান্নাঘর থেকে বের হলেন। সেতু তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে আছে। ফরহাদ উদ্দিন খাবার ঘরে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার কানে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন, হ্যালো। ও পাশ থেকে কেউ জবাব দিল না। শোঁ শোঁ শব্দ হতে থাকল। ইস্তিয়াক টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে। ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। টেলিফোন লাইন খুলে দিয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। সবচে ভালো হয় বৃষ্টি নামা’র পর ঘুমুতে গেলে।
বাবা, তোমার ঘটনাটা কী বলো তো? রাত একটার সময় কাকে টেলিফোন করছ?
কাউকে না।
কাউকে না মানে কী? তুমি তো কানের কাছে টেলিফোন ধরে আছ।
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত মুখে টেলিফোন রাখলেন।
এই নাও তোমার চা। হঠাৎ তোমার চা খাবার ইচ্ছা কেন হলো এটাও তো বুঝছি না। তুমি তো চা খাও না।
সকালে এক কাপ খাই।
ফরহাদ উদ্দিন চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে রেখে দিলেন। রাতদুপুরে চা খাবার কোনো মানে হয় না। ঘুমটা নষ্ট হবে। সেতু এগিয়ে এসে বাবার কপালে হাত রেখে বলল, জ্বর তো নেই। তোমার কপালে হাত দিয়ে মনে হচ্ছে উল্টো আমারই জ্বর। এত ঠাণ্ডা তোমার গা। বাবা যাও, শুয়ে থাক আর ঘুরঘুর করবে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে?
না।
ও আমি তো ভুলেই গেছি এখন তো আবার কনক তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তোমার ভালো লাগে না।
কী যে তুই বলিস!
ঠিকই বলি। তুমি কনককে গোপনে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে এসেছ।
ঐ বেচারি কখনো চিড়িয়াখানায় যায় নি। আর তোরা তো চিড়িয়াখানা পছন্দ করিস না। চিড়িয়াখানায় গেলে পশুদের গন্ধে তোদের বমি আসে।
কনককে তুমি এত পছন্দ কর কেন বাবা?
দুঃখি মেয়ে। এই জন্যে।
মা’র ধারণা কমক দেখতে অনেকটা আমাদের সৎমার মতো। বাবা এটা কি সত্যি?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। এই ভাবে তিনি আগে চিন্তা করেন নি। মেয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি। পারুলের মুখ লম্বাটে ছিল। কনকের মুখও লম্বাটে।
বাবা।
হু।
তোমার স্বভাবের মধ্যে গোপন করার একটা ব্যাপার আছে। এটা ভালো না।
আমি কী গোপন করলাম?
অনেক কিছুই গোপন কর। এতে মা খুব কষ্ট পায়। মা হয়তো আমাদের সৎ মা’র মতো না। কিন্তু মা খুবই ভালো মেয়ে। তাকে কষ্ট দিও না। যাও ঘুমুতে যাও।
তিনি বাধ্য ছেলের মতো ঘুমুতে গেলেন। দরজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নামল। গভীর রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করাতেও আনন্দ। তবে আজ আনন্দটা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। বড় একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা চেপে বসেছে মাথায়। নাম নিয়ে কি সমস্যা? আচ্ছা ইংরেজি শব্দটা যে তৈরি করেছেন সেটা কি SMN না-কি MS? এটা তো দেখি আরেক যন্ত্রণা হলো।