ফরহাদ উদ্দিন নাম জিজ্ঞেস করবেন কী করবেন না এই নিয়ে কিছুটা ভাবলেন। যখন পুরোপুরি ঠিক করলেন জিজ্ঞেস করবেন তখন খাবার ঘর থেকে টেলিফোন বাজতে থাকল। সেতু চলে গেল টেলিফোন ধরতে। বাড়িতে টেলিফোন নতুন এসেছে। টেলিফোনে রিং হলেই সবাই খুব আগ্রহ বোধ করে। শুধু তিনি নিজে শংকিত বোধ করেন। টেলিফোন বাজলেই তার মনে হয় অফিস থেকে জরুরি কল আসছে। এক্স কর্নেল হাবীবুর রহমান কোনো একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছেন না। ফাইলটা ফরহাদ উদ্দিনের টেবিলে থাকার কথা।
সেতু ফিরে আসছে। নিশ্চয়ই রং নাম্বার। পরিচিত কারোর টেলিফোন এলে সেতু এত সহজে ছাড়ত না। তার তিন মেয়েই টেলিফোনে কথা বলতে খুব পছন্দ করে। কোনো একজনের টেলিফোন এলে বাকি দুইজনও টেলিফোন সেটের আশে পাশে থাকে। একজন কথা বলে, বাকি দুজন নিচু গলায় সারাক্ষণ হাসে।
সেতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন।
ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, আমার টেলিফোন! বলিস কী? এত রাতে কে টেলিফোন করবে?
দেখ কে করেছে?
তুই জিজ্ঞেস করিস নি?
না।
ছেলে না মেয়ে? আমার অফিসের কেউ না তো?
তুমি টেলিফোনটা ধরলেই তো জানবে ছেলে না মেয়ে কথা বলে। কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন?
পরিচিত কাউকে টেলিফোন নাম্বার দেইনি তো এইজন্যই অবাক হয়েছি। দিব কীভাবে, আমি নিজেই বাসার টেলিফোন নাম্বার জানি না। একটা কাগজে লিখে মানিব্যাগে রেখেছিলাম। সেই কাগজটাও হারিয়ে ফেলেছি।
বাবা টেলিফোনট গিয়ে ধরো। প্লিজ। আর ধরতে না চাইলে আমি বলে আসি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ।
আমি তো ঘুমাই নাই। মিথ্যা বলাটা ঠিক হবে না। মিথ্যা বললে আয়ু যে কমে এটা জানিস?
না।
তুই যতক্ষণ মিথ্যা বলবি ততক্ষণ আয়ু কমবে। কেউ সারা দিনে পাচ মিনিট মিথ্যা কথা বললে তার আয়ু থেকে পাঁচ মিনিট মাইনাস করা হয়। মিথ্যাবাদী লোক কখনো দীর্ঘজীবী হয় না।
ফরহাদ উদ্দিন টেলিফোন ধরতে গেলেন। রাত বাজে বারোটা একুশ। এত রাতে কে তাকে টেলিফোন করবে।
হ্যালো
দুলাভাই স্লামালাইকুম। আমি ইস্তিয়াক। আপনি জেগে আছেন এইজন্যেই কথা বলতে চাইলাম। আপনার শরীর এখন কেমন?
ভালো
দুলির কাছে শুনলাম আপনার শরীর খুবই খারাপ করেছিল–তারপরেও আপনি একা একা হয়েছেন, কাজটা ঠিক করেননি
এখন ভালো আছি।
আপনাকে একা ছেড়ে দিয়েও দুলি ঠিক করে নি। আমি ওর উপরও রাগ করেছি। কাল আসছে ত দুলাভাই?
হা আসব
সন্ধ্যার পর থেকে আমি থাকব। কোনো কাজ রাখব না। আপনি সঞ্জুকে নিয়ে আসবেন। আমার মা ওকে খুবই দেখতে চাচ্ছেন। অসুস্থ মানুষ, মাথায় বিকার উঠে গেছে। সারাক্ষণ সঞ্জু সঞ্জু করছেন। সঞ্জু বাসায় আছে তো?
হা বাসায় আছে।
ও যেন বাসা থেকে কোথাও না যায়। আসলে ওর সঙ্গেই আমার কথা বলা দরকার। আমি চাচ্ছি কথা বলার সময় আপনিও সামনে থাকেন। দুলাভাই আপনি এখনই সঞ্জুকে বলে দিন।
আমি বলে দেব। তবে ইয়ে ইস্তিয়াক শোন—-ও তোমাদের এখানে যেতে চাচ্ছে না। লাজুক টাইপের তো? কোথাও যেতে চায় না। তারপরেও আমি বলব। লাজুক হোক যাই হোক, মানুষকে সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে। মানুষ হলো সামাজিক জীব। ম্যান ইজ এ সোশ্যাল এনিমেল। ঠিক না?
হ্যা ঠিক।
তাই বলে জোর করে কিছু করানোও ঠিক না। এতেও মনের উপর চাপ পড়ে। মনের উপর চাপ পড়লে তার ফল খুবই অশুভ হয়। এই জন্যে আমার নীতি হলো কারো মনের উপর চাপ না দেয়া। বুঝলে ইস্তিয়াক, সঞ্জু আসতে না চাইলে আমি তার উপর জোর করব না। তবে আমি নিজে চলে যাব। মা’র সঙ্গেও দেখা করে আসব। অনেক দিন তাকে দেখতে যাই নি এটা খুবই অন্যায় হয়েছে। দেখা হলে আমি পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব।
ইস্তিয়াক বলল, দুলাভাই আপনি সঞ্জুকে একটু টেলিফোনটা ধরতে বলুন আমি বলে দিচ্ছি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ও রাত জাগে না। সকাল সকাল ঘুমায়। এইটা তার একটা ভালো অভ্যাস। মেয়েগুলির স্বভাব আবার সম্পূর্ণ উল্টা। যত রাত জাগবে তত তাদের চোখ থেকে ঘুম চলে যাবে।
ইস্তিয়াক বলল, সঞ্জু একটা সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ওর সঙ্গে এই জন্যেই কথা বলাটা আমার জরুরি।
হাসনাত নামের কাউকে নিয়ে সমস্যা? দুলি এই নামটা বলেছিল।
হা।
ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, তুমি কোথাও বিরাট একটা ভুল করছ। সঞ্জু হাসনাত নামে কাউকে চিনেই না।
ও খুব ভালো করেই চিনে। যাই হোক আপনি ওকে টেলিফোন ধরতে বলুন।
ফরহাদ উদ্দিন টেলিফোন রেখে বারান্দায় এলেন।
বারান্দায় সেতু এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। তার সামনে সঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই নিচু গলায় কথা বলছে। কোনো হাসির কথা হচ্ছে। সঞ্জু হঠাৎ হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠছে। বাবাকে দেখে সঞ্জু হাসি থামিয়ে তাকাল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন—রাত অনেক হয়েছে, ঘুমুতে যা। তার ইচ্ছা না সঞ্জু তার মামার সঙ্গে কথা বলুক। কথা বললেই মেজাজ খারাপ হবে। রাতের ঘুমের সমস্যা হবে। তিনি সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললেন—তুই তো রাত জাগিস না। আজ জেগে আছিস কেন?
সেতু বলল, বাবা তুমি আমাদের ঘুমের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এই নিয়ে তিনবার ঘুমের কথা বললে। তোমার ঘুম পেলে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। কাজের মেয়েটা মনে হয় জেগে আছে। হয়তো চা বানাচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিনের ছেলেমেয়েদের চায়ের অভ্যাস আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের চা খেতে ইচ্ছা করে। একবার রাত তিনটার সময় খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙেছে। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন বাসার সব বাতি জ্বলছে। খাবার ঘরের টেবিলে তিন মেয়ে তাদের মা-কে নিয়ে গল্প করছে। ওদের সঙ্গে সও আছে। সবার হাতেই চায়ের কাপ। খুবই আনন্দময় পরিবেশ। পরিবারের সবাই এক সঙ্গে বসে আনন্দ করছে দেখতেই ভালো লাগে। আনন্দের উৎসবে পরিবারের এক আধজন সদস্য বাদ পড়ছে এটা কোনো বিষয় না। একজন দুজন বাদ পড়তেই পারে।