টানা বারান্দার শেষ মাথায় বেতের একটা চেয়ার রাখা। কে যেন চেয়ারে এসে বসল। তার তিন মেয়ের কোনো একজন কি? কোন মেয়ে? বড় মেয়ে? তারা তিনজন সব সময় এক সঙ্গে থাকে। একজন যদি বারান্দায় এসে বসে বাকি দুজন কিছুক্ষণের মধ্যে এসে উপস্থিত হবে। মেয়ে তিনটা ছোটবেলায় তিন রকম ছিল। যতই তাদের বয়স হচ্ছে ততই তার এক রকম হয়ে যাচ্ছে। স্বভাব এক রকম হবার পেছনে যুক্তি আছে শুধু স্বভাব না, এদের চেহারাও এখন কাছাকাছি চলে আসছে। তিনজনেরই গোল মুখ, ফোলা ফোলা গাল। তিনজনই উঁচু গলায় সামান্য ক্যানক্যানা স্বরে কথা বলে। যখন শাড়ি পরে তিনজনই একসঙ্গে শাড়ি পরে। যখন সালোলায়ার কামিজ পরে তখনও তিনজনই সালোয়ার কামিজ পরে।
ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি মনে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে একা পাওয়া গেছে, টুকটাক দুএকটা কথা মেয়ের সঙ্গে বলা যাবে। তিন বোন এক সঙ্গে থাকলে তিনি কথা বলতে পারেন না। তিনজনের দিকে একসঙ্গে তাকানো যায় না বলেই হয়তো এ সমস্যাটা হয়।
ফরহাদ উদ্দিন দূর থেকেই বললেন, কে?
বাবা আমি সেতু।
করছিস কী তুই?
বসে আছি।
বসে আছিস কেন?
কী আশ্চর্য কথা! বসে থাকতে পারব না?
ফরহাদ উদ্দিন সামান্য হকচকিয়ে গেলেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন বুঝতে পারছেন না। এটি তার বড় মেয়ে না মেজো মেয়ে। তাঁর তিন মেয়ের খুবই কাছাকাছি নাম–মিতু, সেতু, নীতু। ছোটটার নাম নীতু এটা ঠিক আছে। এখানে তার গণ্ডগোল হয় না, কিন্তু বড় আর মেজোর নামে বেশ কিছুদিন ধরেই গণ্ডগোল হচ্ছে। সেতু কার নাম? বড়টার না মেজোটার? তিনি নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে পারেন না–তুই বড় মেয়ে না মেজো মেয়ে?
সেতু চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। বারান্দায় একটাই চেয়ার। দুটো চেয়ার থাকলে ফরহাদ উদ্দিন আরেকটা চেয়ারে বসতেন। তার অবশ্যি দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। মেয়ে সামান্য বেয়াদবি করছে—বাবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে পা দোলাচ্ছে। যাই হোক এটা এমন কোনো বড় বেয়াদবি না। খুব প্রিয়জনদের সঙ্গে বেয়াদবি করা যায়।
তুই একা কেন? তোর বাকি দুই বোন কোথায়? থ্রি মাস্কেটিয়াস! টিভি দেখছে না-কি?
সেতু বিরক্ত মুখে বলল, কী যে প্রশ্ন তুমি করো বাবা। রাতে খাবার সময় তো তোমাকে বললাম—মা নীতু, মিতু আপা আর কনককে নিয়ে ছোট খালার বাসায় গিয়েছে। ওদের বাসার সামনের রাস্তায় পানি জমে গেছে। আজ রাতে আর ফিরবে না।
আরে তাই তো!
তোমার ভুলোমন ভুলোমন ভাবটা দূর করো তো বাবা। বিরক্তি লাগে।
ফরহাদ উদ্দিন মেয়ের কথা বলার ভঙ্গিতে খুবই আনন্দ পেলেন। আনন্দটা বেশি হচ্ছে কারণ মেয়ের কথা থেকে তিনি ধরে ফেলেছেন এই মেয়ে হলো সেতু, তার মেজো মেয়ে। একটু আগেই সে বলেছে—মা নীতু, মিতু আপা আর কনককে নিয়ে ছোট খালার বাড়িতে গিয়েছে। মিতু আপা বলছে, কাজেই মিতু সবচে বড় বোন।
প্রথম মিতু, তারপর সেতু, সবচে শেষে নীতু। কে বড় কে মেজো কে ছোট মনে রাখার জন্য ভালো কোনো বুদ্ধি বের করা দরকার। কী বুদ্ধি করা যায়? সব মেয়ের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে একটা শব্দ বানাতে হবে। শব্দটা মনে রাখলেই কার পরে কে বোঝা যাবে। মিতুর M, সেতুর S, নীতুর N। শব্দটা হলো MSN. সহজ বুদ্ধি। এই বুদ্ধি খাঁটিয়ে তিনি ছোটবেলায় অনেক কিছু মনে রাখতেন।
সবাই গেছে তুই যাস নি কেন?
আমি কেন যাই নি সেটাও বাবা আমি তোমাকে বলেছি।
কখন বললি?
ভাত খাবার সময় বলেছি।
ভুলে গেছি। আরেকবার বল।
এক কথা একশবার বলতে ভালো লাগে না। তুমি কোনো ব্রেইন টনিক ফনিক খেয়ে ব্রেইনটা ঠিক কর তো।
রেগে আছিস কেন? বাড়ির বড় মেয়েকে হতে হবে শান্ত ধীর স্থির। অন্যরা রাগ করলেও বাড়ির বড় মেয়ে রাগ করবে না।
বাবা আমি সেতু। আমি বড় মেয়ে না।
ও আচ্ছা তাই তো। অন্ধকারে বসে আছিস বুঝতে পারি নি। MSN, তুই মাঝখানের s.
কী বলছ তুমি?
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হাসলেন। পারিবারিক সমস্যাটা MSN দিয়ে কাভার করা যাচ্ছে।
MSN টা কী?
আছে একটা ব্যাপার। বলা যাবে না।
সেতু বলল, না বললে নাই। বাবা যাও শুয়ে পড়ো। রাত বারোটা বাজে, এখনো হাঁটাহাঁটি করছো কেন?
তুইও শুয়ে পড়।
আমার ঘুম আসছে না।
তিন বোন একসঙ্গে থেকে থেকে এমন অভ্যাস করেছিস একা থাকলে ঘুম আসবে না। বিয়ের পর তো তোরা মহা বিপদে পড়বি। সবচে ভালো হতো কি জানিস? কোনো একটা ফ্যামিলির তিন ভাই-এর সঙ্গে তোদের তিনজনের বিয়ে দিয়ে দেয়া।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেললেন। হাসতে গিয়ে তার মনে পড়ল কেন সেতু তার ছোট খালার বাড়িতে যায় নি। সেতুর বিয়ের ফাইনাল কথা হচ্ছে। বিয়ের ফাইনাল কথায় কনে উপস্থিত থাকে না। উপস্থিত থাকা শোভন না। ছেলে দেশের বাইরে মালয়েশিয়া কিংবা জাপানে কোথায় যেন কাজ করে। বিয়েটা সেতুর পছন্দ না। তার আপত্তি হচ্ছে বড় বোনকে বাদ দিয়ে মেজো বোনের বিয়ে আগে কেন হবে? তারচেয়েও বড় আপত্তি হলো সেতুর পছন্দের একজন ছেলে আছে। কয়েকদিন তাকে এ বাড়িতে দেখেছেন। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলেন রিকশায় করে সেতু আর ঐ ছেলে যাচ্ছে। সেতু খুব হাত টাত নেড়ে গল্প করছে আর ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে। তাকে দেখতে পেলে দুজনই লজ্জা পাবে বলে তিনি দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটার নাম কী? নাম তিনি শুনেছেন কিন্তু মনে করতে পারছেন না। সেতুকে সেই ছেলের নাম জিজ্ঞেস করা একেবারেই উচিত হবে না। কায়দা করে অবশ্যি জিজ্ঞেস করা যায়। তিনি বলতে পারেন সেতু শোন, তোর কাছে মাঝে মাঝে একটা রোগা ছেলেকে আসতে দেখতাম। শ্যামলা রং, চশমা পরা। ছেলেটার নাম কী যেন? এখন জিজ্ঞেস করবেন?