সঞ্জুর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না। চাপ পড়তেই দরজা ফাঁক হলো। ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় আলো এসে পড়ল। সঞ্জু গম্ভীর গলায় বলল, কে? ফরহাদ উদ্দিন বললেন, কী করছিস? সঞ্জু জবাব দিল না, তবে কুট কুট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। ফরহাদ উদ্দিন ঘরে ঢুকে পড়লেন।
সঞ্জু খাটে পা তুলে বসে আছে। তার হাতে চকলেটের টিন। কুট কুট শব্দ টিন থেকে আসছে। মনে হয় টিনটা বাঁকা হাতের চাপ লেগে শব্দ হচ্ছে। সঞ্জুর ঘর খুব গোছানো। এই বয়সের ছেলের ঘর গোছানো থাকে না। জিনিসপত্র এলোমেলো ছড়ানো থাকে। সঞ্জু তাদের মতো না। সুন্দর করে সাজানো ঘর দেখতে ভালো লাগে। ফরহাদ উদ্দিন আনন্দ নিয়ে চারদিকে তাকালেন। সঞ্জুর পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে আইনস্টাইনের বড় একটা পোস্টার। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল নিয়ে বিজ্ঞানী বসে আছেন। আউলা ঝাউলা চোখ।
আইনস্টাইনের ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন ফরহাদ উদ্দিন। হাসি মুখে বললেন—তোর খবর কী?
ভালো। সুপারি কাটার মতো কুট কুট শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম দেখি ঘটনা কী?
ফরহাদ উদ্দিন এগিয়ে এলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। সঞ্জু বলল, কিছু বলবে?
আলাদা রিকশা নিয়ে তুই কোথায় চলে গেলি। তোর মামার বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছিল। আমার নিজেরও শরীর খারাপ হয়ে গেল। ঐটা অবশ্যি কিছু না।
সঞ্জু বলল, মানুষের বাড়িতে বেড়াতে আমার ভালো লাগে না।
ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমারও ভালো লাগে না। তারপরেও সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ম্যান ইজ এ সোশ্যাল এনিমেল। সঞ্জু শোন, আগামীকাল তোকে অবশ্যি নিয়ে যেতে বলেছে।
বাবা, আমি যাব না।
এত করে বলছে, পাঁচ দশ মিনিট থেকে চলে আসবি। আমি অবশ্যি বলেছি ও কোথাও যেতে চায় না। তোর মামি শুনছে না।
না শুনলে কিছু করার নেই।
ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন সঞ্জুর কপালের রগ ফুলে উঠেছে। তার মন সামান্য খারাপ হলো—সঞ্জুকে রাগিয়ে দিয়েছেন। কাজটা ঠিক হয় নি। তিনি হালকা গলায় বললেন—যেতে ইচ্ছা না করলে আমি বুঝিয়ে বলব। সমস্যা হবে না। সবারই সুবিধা-অসুবিধা আছে!
সঞ্জু বলল, বাবা তুমি শুয়ে পড়। আমি একটা জরুরি কাজ করছি।
ফরহাদ উদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোর মামার বাড়ি যাওয়া নিয়ে তুই দুশ্চিন্তা করিস না। আমি বুঝিয়ে বলব। তোর মামি অবশ্যি বলছিল, হাসনাত সাহেবের কথা শুনলেই তুই যেতে রাজি হয়ে যাবি।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেবটা কে?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমি তো জানি না কে? তুই চিনিস না?
না।
তাহলে মনে হয় ওরা কোনো গণ্ডগোল করেছে। অন্য কোনো নাম হবে। কিংবা আমি শুনতে ভুল করেছি। তোর মামি হয়তো বলেছে এক নমি, আমি শুনেছি অন্য নাম। এমন সমস্যার মধ্যে পড়েছি, বুঝলি সঞ্চু! মাথা বেশির ভাগ সময়ই আউলা হয়ে থাকে। মানুষের নাম মনে রাখা নিয়েই বেশি সমস্যা হচ্ছে। কোনো একদিন দেখব তোর নামই মনে নেই। সঞ্জুর বদলে তোকে ডাকছি ভঞ্জু। হা হা হা। ডাক্তার দেখাতে হবে।
সঞ্জু এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার মতো হাসি দিলেন।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেবের কথা তোমাকে কে বলল?
তোর মামি বলেছে। তোর মামির নাম দুলি। দুলালী থেকে দুলি। আশ্চর্য কাণ্ড, বুঝলি সঞ্জু! আমি দুলিকেও চিনতে পারি নি। শুরুতে ভাব করেছিলাম চিনেছি। দুলি আবার খুব চালাক মেয়ে, সে ধরে ফেলল। আমি বিরাট লজ্জার মধ্যে পড়েছি।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেব নিয়ে মামির সঙ্গে তোমার এগজেক্ট কী কথা হয়েছে?
তেমন কোনো কথা না। তোর মামি বলল, হাসনাত নামটা শুনলেই সঞ্জু আসবে।
এটা এমন কী মহিমান্বিত নাম যে শুনলেই আমি দৌড়ে চলে যাব?
রেগে যাচ্ছিস কেন? বোঝাই যাচ্ছে একটা কিছু ভুল হয়েছে। ভুলটা তোর মামি করে নি। আমি করেছি। তোকে তো বলেছি আমার ব্রেইন কাজ করছে না।
সঞ্জু বলল, হাসনাত নামের কাউকে আমি চিনি না।
না চিনলে তো ফুরিয়েই গেল। তুই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রাত আছে। আরামে ঘুমাবি।
তিনি সঞ্জুর ঘর থেকে বের হলেন। নিজেই দরজা টেনে দিলেন। বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন—কুটুর কুটুর শব্দটা আবার শুরু হয় কি-না তার পরীক্ষা। শব্দ শুরু হচ্ছে না তার সামান্য খারাপ লাগছে, সঞ্জুর ঘরে আরো কিছুক্ষণ বসলেই হতো। গল্পই করা হলো না। একটা জরুরি বিষয় নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করা দরকার ছিল। অফিসের ব্যাপার। চাকরি করতে আর ভালো লাগছে না। তার আরো দুই বছর চাকরি আছে। ইচ্ছা করলে শারীরিক কারণে তিনি আর্লি রিটায়ারমেন্টে যেতে পারেন। পেনশন অতি সামান্যই পাবেন, সেটা একটা সমস্যা। তবে খুব বড় সমস্যা না। ঢাকা শহরে এখন তার নিজের বাড়ি আছে। দোতলার কিছু কাজ বাকি আছে। কাজটা শেষ ক দোতলা ভাড়া দিয়ে দেবেন। এর মধ্যে পাস করে সঞ্জু চাকরি শুরু করবে। চাকরির বাজার যদিও খুব খারাপ তবুও ব্যবস্থা একটা হবে। সালু-মামা কোনো কোনো ব্যবস্থা করে ফেলবেন। ছেলের সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা বলতে পারলে ভালো লাগত। ছেলে বড় হলে বন্ধুর মতো হয়ে যায়। বিলেত আমেরিকায় বাপ-বেটা এক টেবিলে মদ খেয়ে হাসাহাসি করে। বাংলাদেশে এটা সম্ভব না; তবে গল্পগুজব করা, হাসাহাসি করা খুবই সম্ভব।