দুলি চা আনতে গেল। ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসলেন। শরীরের ক্লান্ত ভাবটা পুরোপুরি চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে হেঁটে হেঁটে তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে ভালো লাগবে। ছাতায় বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগে। অনেক দিন ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে হাঁটা হয় না।
দুলি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ইস্তিয়াক টেলিফোন করেছে ও রাত বারোটার আগে ফিরতে পারবে না। তবে আপনার জন্যে গাড়ি পাঠিয়েছে। গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।
দরকার নেই। ছাতা থাকলে দাও। ছাতা নিয়ে চলে যাব।
অসম্ভব! আপনাকে গাড়ি ছাড়া পাঠাব না। ইস্তিয়াক বলেছে কাল সন্ধ্যার পর আপনাকে আসতে। আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। গাড়ি পাঠাবে।
গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। আমি চলে আসব।
আপনি সঙ্গে করে সঞ্জুকে আনবেন।
ও কোথাও যেতে চায় না।
নিজের মামার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। আপনি বলে টলে তাকে নিয়ে আসবেন।
আচ্ছা।
ও এবার এমএ পরীক্ষা দিয়েছে না?
হুঁ। ভাইভা বাকি আছে।
দুলি খানিকটা ইতস্তত করে বলল, তার মামা বোধহয় সঞ্জুর ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
সঞ্জুর কোন ব্যাপারে?
আমি ঠিক জানি না। তবে ব্যাপারটা জরুরি।
আমি তাকে নিয়ে আসব।
দুলাভাই আপনি কি একা একা যেতে পারবেন, না আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
আমি একাই যেতে পারব।
কাল রাতে আমাদের এখানে খাবেন। আমি আপনার জন্য বাইম মাছ রান্না করে রাখব।
আচ্ছা।
বাইম মাছ ছাড়া আপনার আর কী পছন্দ?
কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ। আমার মেয়েরা শুঁটকি মাছ খায় কিন্তু কাঁঠালের বিচি দিয়ে খায় না।
আমি কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ রান্না করে রাখব। আপনি কিন্তু কাল অবশ্যই সঞ্জুকে নিয়ে আসবেন।
আসতে না চাইলে জোর করে তো আনতে পারব না। ছেলে বড় হয়েছে, নিজের মতামত হয়েছে।
আসতে না চাইলে বলবেন হাসনাতের ব্যাপারে সঞ্জুর সঙ্গে তার মামা কথা বলবেন।
হাসনাত কে?
আপনি চিনবেন না। সঞ্জু চিনবে। হাসনাতের কথা বললেই সঞ্জু চিনবে।
আচ্ছা আমি হাসনাত সাহেবের কথা বলব। দুলি তুমি আমাকে একটা ছাতা জোগাড় করে দাও—ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যেতে ইচ্ছা করছে। গাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে না।
দেখি ঘরে ছাতা আছে কি-না। মেয়েদের রঙচঙা একটা ছাতা আছে, ঐ টা নিবেন?
আমার কোনো অসুবিধা নেই।
ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। মেয়েদের একটা ছাতা নিয়ে ফরহাদ উদ্দিন এগোচ্ছেন। তার খুবই ভালো লাগছে। রাস্তায় পানি জমে আছে। ফুটপাত পর্যন্ত এখনো পানি উঠে নি। তিনি ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে রাস্তার নোংরা পানিতে পা ফেলে ছপ ছপ শব্দ করতে করতে এগুচ্ছেন। হলুদ স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে। হলুদ আলো পানিতে নানা রকম নকশা তৈরি করছে। দেখতে এত ভালো লাগছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো আরেকটু পানি হয়ে পুরো রাস্তাটা ডুবে গেলে ভালো হতো। রাস্তাটাকে মনে হতো নদী। একটা মানুষ নদীর ওপর হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কী মজার ব্যাপার।
সঞ্জুর ঘর থেকে
সঞ্জুর ঘর থেকে ছরতা দিয়ে সুপারি কাটার মতো কুট কুট শব্দ হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে শব্দটা শুনছেন। কুট কুট কুটুর কুটুর। এর মানে কী? সঞ্জু সুপারি কাটবে কেন? মজার ব্যাপার তো!
রাত এগারোটা বাজে। ঘণ্টা দুএকের জন্যে বৃষ্টি থেমেছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। আজ রাতের ঘুমটা আরামের হবে। গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে শুতে হবে। মাথার কাছের জানালাটা খোলা থাকবে। খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট আসবে—আসুক। একটু আধটু বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় লাগলে কিছু হবে না। গত কয়েক রাত খুব গরম গেছে। আজ রাতটা আরামে যাবে। ঘুমুতে যাবার আগে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে এসেছেন। টুকটাক কিছু কথা বলবেন। হালকা গলায় জিজ্ঞেস করবেন–তোর মামার বাসায় শেষ পর্যন্ত তুই গেলি না, সবাই অপেক্ষা করে ছিল। অভিযোগ না, এমি কথার কথা। ঘুমুতে যাবার আগে কঠিন কথা বলা একেবারেই ঠিক না। এতে ঘুমের অসুবিধা হয়। বদহজম হয়। বদহজম মানেই দুঃস্বপ্ন দেখা।
কঠিন কথা বলতে হয় দিনে। সন্ধ্যার পর থেকে হালকা কথাবার্তা। টিভিতে নাটক ফাটক দেখা। ছবিওয়ালা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টানো। পরিবারের লোকজন নিয়ে সামান্য হাসাহাসি।
ফরহাদ উদ্দিন সঞ্জুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না মন স্থির করতে পারছেন না। কেন জানি ঘুম আসছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কনকের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। সে বাসায় নেই। রাহেলা তাকে নিয়ে কোথায় জানি বেড়াতে গেছে। কোথায় গেছে, কেন গেছে সবই তাকে বলা হয়েছে কিন্তু তিনি এখন মনে করতে পারছেন না। হয়তো শোনার সময় ঠিকমতো শুনেন নি।
ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরের দরজায় হাত রেখে সামান্য চাপ দিলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কি-না তার পরীক্ষা। তিনি ঠিক করে রেখেছেন ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া থাকলে তিনি আর ঢুকবেন না। সকালবেলা সঞ্জুর সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসে যাবার আগে ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে বলবেন—কাল রাতে তোর ঘরে কুটকুট শব্দ হচ্ছিল। ব্যাপার কী রে? সুপারি কাটছিলি না-কি? বিটল নাট কাটিং?