প্রশ্নটা করেই ফরহাদ সাহেব শঙ্কিত বোধ করলেন। এটা একটা ভুল প্রশ্ন হয়েছে। হয়তো এই মহিলার ছেলেমেয়ে হয় নি। এরকম দম্পতি আছে যাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় না। তাদের অফিসের বড় সাহেব কর্নেল হাবীবুর রহমান সাহেবেরই কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও স্ত্রীকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরে এলেন। যাদের বাচ্চা কাচ্চা হয় না তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় ছেলেমেয়েরা কেমন আছে তারা খুবই মনে কষ্ট পায়।
ভদ্রমহিলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ছেলেমেয়েরা ভালোই আছে। দুলাভাই, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
ফরহাদ উদ্দিন হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন। মহিলা হাসিমুখে বললেন—পারুল আপার মেজো ভাই ইস্তিয়াক। আমি তার স্ত্রী। আপনি এখন আবার বলে বসবেন না যে ইস্তিয়াককে চেনেন না।
কী যে তুমি বলো! কেন চিনব না।
ও কী করে বলুন তো?
ব্যবসা করে।
না, পুলিশ অফিসার। ডিবিতে আছে। এসপি। প্রমোশন হবার কথাবার্তা হচ্ছে। প্রমোশন হলেই ডিআইজি হবে।
বাহ্ ভালো তো।
আপনার সঙ্গে এখন আর এই পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই—আপনিও কিছু জানেন না। আমরাও আপনার ব্যাপারে কিছু জানি না।
ইস্তিয়াক কোথায়?
ও খুব জরুরি কাজে অফিসে আটকা পড়েছে। আপনি যে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন এই খবর সে জানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।
শাশুড়ি আম্মা, উনি কোথায়?
উনি তো এ বাড়িতে থাকেন না। ইস্তিয়াকের ছোট ভাই মনোয়ারের বাসায় থাকেন। মনোয়ার থাকে ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে। আপনি তো জানেন সে ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির টিচার।
ফরহাদ উদ্দিন কিছুই জানেন না তারপরেও বললেন, জানি। কিছু কিছু খবর রাখার চেষ্টা করি। কাজে কর্মে এত ব্যস্ত থাকি যোগাযোগটা রাখা সম্ভব হয় না। শাশুড়ি আম্মা চিঠি লিখেছিলেন এ বাড়িতে আসার জন্যে, তাই ভেবেছি উনি এ বাড়িতেই আছেন।
উনি আপনাকে কোনো চিঠি লিখেন নি। আমিই চিঠি লিখে আপনাকে আনিয়েছি। উনার হয়ে চিঠি লিখেছি যাতে আপনি আসেন।
ও।
মা’র শরীর খুবই খারাপ। প্যারালাইসিস হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকেন। কাউকে চিনতে পারেন না। কানে খুব ভালো শোনেন। কোনো মেয়ের গলা শুনলেই মনে করেন পারুল আপা এসেছেন। তার বড় মেয়ে যে মারা গেছে এই বোধ নেই।
কত দিন ধরে এই অবস্থা?
অনেক দিন, তবে মাঝে মাঝে সুস্থ থাকেন তখন সবাইকে চিনতে পারেন। সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন।
ও।
দুধটা খান।
আমি দুধ খাই না, ভালো লাগে না।
চা বানিয়ে আনব চা খাবেন?
আচ্ছা আন চা, এক কাপ খাই।
আমার নাম কি আপনার মনে আছে?
ফরহাদ উদ্দিন কিছুক্ষণ হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার নাম আমার মনে নাই।
এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ হয় না, নাম মনে না থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।
ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকে স্মৃতি শক্তি কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। শরীরটাও খারাপ।
শরীর যে খারাপ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন ভালো লাগছে না?
হুঁ এখন ভালো লাগছে।
গরম চা খেয়ে শুয়ে থাকুন। ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনাকে আর ডিসটার্ব করব। ইস্তিয়াক আসার পর ডেকে তুলব।
আচ্ছা।
আমার নাম তো আপনি আর জিজ্ঞেস করলেন না।
তোমার নাম কী?
দুলি। দুলালী থেকে দুলি।
এখন মনে পড়েছে।
দুলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিশ বছর কোনো মিথ্যা কথা বলবেন না। বিশ বছর মিথ্যা কথা না বললে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়। ঐ প্রতিজ্ঞা কি এখনো আছে? আপনার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়েছে?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত মুখে হাসলেন।
দুলি বলল, প্রশ্নের জবাব তো দিলেন না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এই বৎসর ডিসেম্বরের দিকে কুড়ি বছর হবে।
এতদিন কোনো মিথ্যা বলেন নি?
টুকটাক বলেছি। যেমন তুমি যখন জিজ্ঞেস করলে তোমার নাম মনে আছে কিনা। তখন আমার নাম মনে ছিল না, তারপরেও চিনেছি এই ভাব করে মাথা নাড়লাম।
আপনার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়েছে?
এখনো তো কুড়ি বছর হয় নি।
দুলি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কুড়ি বছর পর সত্যি যদি আধ্যাত্মিক কোনো ক্ষমতা হয় আমাকে বলবেন। আমিও মিথ্যা বলা ছেড়ে দেব।
তুমি কি মিথ্যা বলো?
আমি বেশির ভাগ কথাই মিথ্যা বলি। প্রয়োজনে তো বলিই, অপ্রয়োজনেও বলি।
দুলি বলল, আপনি অসুস্থ মানুষ তারপরেও আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। দুলাভাই কিছু মনে করবেন না।
না কিছু মনে করি নি।
আপনি তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা মানুষ। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আপনি হয়তো জানেন না, এ বাড়ির সবাই আপনাকে খুব পছন্দ করে। প্রায়ই আপনার কথা হয়। আমার শাশুড়ি যখন সুস্থ থাকেন তখন তিনি বলেন বাজার থেকে বাইম মাছ কিনে আন। বাইম মাছের ঝোল রান্না করে পারুলের জামাইকে খেতে বলো। বাইম মাছ নাকি আপনার খুব পছন্দ।
হ্যাঁ আমার খুব পছন্দ। এখন অবশ্যি খাওয়া হয় না বাসায় কেউ বাইম মাছ পছন্দ করে না। দেখতে সাপের মতো তো এই জন্যে।
আমি নিজেও বাইম মাছ খাই না, তবে আপনাকে একদিন রান্না করে খাওয়াব।
আচ্ছা।
আমি আপনার চা নিয়ে আসছি। চায়ে তো চিনি দেব না তাই না?
এক চামচ চিনি দিও। বিনা চিনির চা খেতে পারি না।